গুগাবাবা: উপেন্দ্রকিশোর ও সত্যজিৎকে গেঁথেছে বিনিসুতোর মালায়

ঠাকুর্দা ও নাতির যুগলবন্দিতে তৈরি হল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিরোধী এক চলচ্চিত্র

 |  3-minute read |   12-05-2018
  • Total Shares

তিনি ছিলেন রবি ঠাকুরের ব্যক্তিগত বন্ধু। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয় তাঁর বন্ধু ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও। তাঁর বাড়ির ছাদে বসানো ছিল একটা টেলিস্কোপ, সেই টেলিস্কোপে চোখ রেখে মহাবিশ্বের গ্রহ-নক্ষত্র-নীহারিকাপুঞ্জ পর্যবেক্ষণ করাটা ছিল তাঁর অন্যতম নেশা। আর তাই নিয়ে ছোটদের জন্য সাবলীল সহজবোধ্য বাংলাভাষায় বই লিখেছেন তিনি। ছোটদের জন্য তার পাশাপাশি রচনা করেছেন পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে অসামান্য সব গল্প।

তাঁর লেখা ছোটদের রামায়ণ আর মহাভারত পড়েই সাধারণত রামায়ণ-মহাভারতের ঘটনা ও কাহিনির সঙ্গে পরিচয় হয় আপামর আধুনিক বাঙালি শিশুদের। শুধু রামায়ণ মহাভারত কেন তাঁর ‘টুনটুনির বই’ আর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ পড়েনি এরকম বাঙালি পাঠক বোধহয় কেউ নেই। কিন্তু এটুকুতেই এই আশ্চর্য মানুষটার পরিচয় সীমাবদ্ধ নয়- বেহালাবাদক তো তিনি ছিলেনই তার সঙ্গে ছিলেন একজন যথার্থ সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীতসাধক! দক্ষিণ এশিয়ায় মুদ্রণ শিল্প সম্পর্কে প্রকৃত ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম, যিনি স্থাপন করেছিলেন তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা। যে ছাপাখানায় অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে ছাপা হত তাঁর নিজের আঁকা ছবিও। তৎকালীন সুপ্রসিদ্ধ মুদ্রণ বিষয়ক পত্রিকা Penrose-এ নিয়মিত ছাপা হতো তাঁর প্রবন্ধ। হ্যাঁ আমি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কথাই বলছি!

upen_body_051218122518.jpgউপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

তাঁর ব্যবহার করা, ছবি আঁকার তুলিগুলো ছোটবেলায় ব্যবহার করার সুযোগ মিললেও এরকম অসাধারণ এক ঠাকুর্দার সঙ্গে সরাসরি কখনও সাক্ষাৎ হল না অসাধারণ এক নাতির। সেই নাতির জন্মের ছ’ বছর আগেই যে পরলোকগমন করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর।

সন্দেশ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য ঠাকুর্দার প্রতিষ্ঠিত সেই ছাপাখানায় নিজের আঁকা আঁকিবুকি, ছবিপত্তর নিয়ে ছোটবেলায় হানা দিতেন ক্ষুদে সত্যজিৎ কিন্তু কখনো আর ছাপা হয়ে ওঠেনি সে সব!

অনেক পরে, বড় হয়ে তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “...উপেন্দ্রকিশোরের বহুমুখী প্রতিভার বিচার করার ক্ষমতা তখন ছিল না। সেটা সম্ভব হয়েছিল আরও পরিণত বয়সে। তখন বুঝেছিলাম যে শিশুসাহিত্য রচনায়, কাহিনির ইলাস্ট্রেশনে, সঙ্গীত রচনায় এবং প্রাঞ্জল ভাষায় জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্য বর্ণনে ও বিশ্লেষণে তাঁর সমতুল্য এদেশে কমই আছে।”

upen_body3_051218122554.jpgগুগাবাবা

সঙ্গে সঙ্গে একথাও জানাতে ভোলেননি যে তাঁর গল্পগুলির মধ্যে যেগুলি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় তার অন্যতম ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। তাই হয়তো এটা খুব স্বাভাবিকই ছিল যে ছোটদের জন্য যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন সিনেমা পরিচালক সত্যজিৎ রায় তখন প্রথম হাত পড়ল তাঁর ঠাকুর্দার ঝুলিতেই! আর তার থেকে বার করে ছোটদের জন্য এমন একটা সিনেমা বানালেন তিনি যেটা চমকে দিল তাবৎ পৃথিবীকে। পরলোকগত ঠাকুর্দা আর জীবিত নাতির যুগলবন্দিতে নির্মিত হল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিরোধী এক চলচ্চিত্র যা ছোটদের এবং বড়দের সমান ভাবে আজও টানে। কাহিনি, সংলাপ, সঙ্গীত, সিনেমাটোগ্রাফি ও অভিনয় এই চলচিত্রে সমানতালে টেক্কা দিয়ে চলে একে অপরের সঙ্গে।

গল্পটা দিদিমা আর মার মুখে শুনে শুনে এবং পরে নিজে পড়ে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। বাড়ির রেকর্ড প্লেয়ারে প্রায় রোজই শোনা হত গানগুলো। তারপর একদিন হলে গিয়ে দেখার সৌভাগ্য হল সিনেমাটা। সিনেমাটা প্রথম দেখেছিলাম বছর পাঁচেক বয়সে, আর তারপর থেকে কত বার দেখেছি জানি না, এখনো যখন কখনো টিভিতে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ দেখানো হয় নিজের অজান্তেই বসে পড়ি টিভির সামনে। কিছুদিন পরে পরে ওটা না দেখলে কী রকম যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে। আজকাল ছেলেও বুঝতে পারে সেটা, সিডিটা নিয়ে এসে বলে অনেকদিন দেখা হয়নি- চালাও তো! আর আশ্চর্য ব্যাপার কখনও পুরোনো হয় না, কখনো একঘেঁয়ে লাগে না এই সিনেমাটা। প্রত্যেকটা দেখাতেই যেন নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকি কিছু একটা ।

upen_body2_051218122627.jpgসত্যজিৎ রায়

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমার মতো পলিটিকাল স্টেটমেন্ট সত্যজিৎবাবুর খুব কম সিনেমাতেই আছে কিন্তু সেটা কোথাও কলার ধরে মোটা দাগে দেখানো কোনো স্টেটমেন্ট নয়- কাহিনি, ছবি এবং এই চলচিত্রের গানের সঙ্গে খুব সহজ, সরল, স্বাভাবিক ভাবে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে সেই ভাবনা। গোটা চলচ্চিত্রটাই তো একটা মানবিকতার দলিল এবং একই সঙ্গে এর আদ্যন্ত জুড়ে আছে এক ভীষণ রকম বাঙালি হিউমার। সত্যজিৎবাবু স্বয়ং ছোটদের চলচিত্র নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একবার লিখেছিলেনঃ “...শিশুচিত্রে যে তিনটি গুণ না থাকলে নয়- অর্থাৎ সারল্য, সাবলীলতা ও সর্বজনীনতা- এই তিনটে গুণের সমাবেশ সচরাচর দেখা যায় না।” নিঃসন্দেহে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সত্যজিৎ রায় নির্মিত সেই চলচ্চিত্র যার মধ্যে ঘটেছে এই তিনের অপূর্ব সমাবেশ। আর ভাবতে আরও অবাক লাগে যে এই সিনেমাটিতেই তিনি প্রথম নিজের চলচ্চিত্রে নিজে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন!

১২ মে উপেন্দ্রকিশোরের জন্মদিন আর ক’দিন আগেই পঞ্চাশে পা দিয়েছে সত্যজিতের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SARASIJ SENGUPTA SARASIJ SENGUPTA

Associate Professor Department of Bengali St. paul's C.M. College

Comment