তাজমহলের দরজায় কেন হামলা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের, সরকারের কী করা উচিৎ

ইতিহাস নিয়ে সত্য যাচাই করতে উৎখনন জরুরি, তবে এই সৌধ থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে হবে

 |  6-minute read |   14-06-2018
  • Total Shares

তাজমহলের দক্ষিণ দিকের দরজাটা ভাঙতে যাওয়া প্রতীকি-মাত্র। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইতিমধ্যেই দাবি করে বসেছে, মুগল সম্রাটদের নামে যে সব রাস্তা আছে, বদলে দিতে হবে সেগুলোও। কারণ হিসাবে তারা বলেছে, এ আসলে দাসত্বের চিহ্ন। খবরে প্রকাশ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক সাধারণ সম্পাদক চম্পৎ রাই চান, বদলে দেওয়া হোক দিল্লির শাহজাহান রোডের নামও। তাঁদের কাছে নাম-বদল অত্যন্ত জরুরি। ব্রিটিশদের দেওয়া পথ-ঘাটের নাম যে ভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে, ঠিক সেই ভাবেই বদলে দেওয়া উচিৎ মুগলদের নামও।

আওরঙ্গজেব রোডের নাম বদলে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের নামে করা হয়েছে। কালামও ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন, তাই ঔরঙ্গজেবের নাম বদলে কালামের নামে করায় অন্তত ধর্মের হ্রেষা শুনতে হয়নি। শাহজাহান রোডের নাম বদলে দশরথ মাঁঝির নামে করার প্রস্তাব উঠেছে। পাহাড় কেটে পথ তৈরি করে একসময় খবরের শিরোনামে এসেছিলেন তিনি, যাঁরা জানেন তাঁরা বুঝতেই পারছেন যে শাহজাহানকে যে ভাবে প্রেমের প্রতীক রূপে তুলে ধরা হয়, তার বদলে একজন হতদরিদ্রের প্রকৃত প্রেমকে তুলে ধরা হোক।

মুগল শাসকদের নামে থাকা রাস্তার নাম বদলের সঙ্গে অবশ্য তাজমহলে হামলার সম্পর্ক নেই। দীর্ঘদিন ধরেই একটি মহল দাবি করে আসছে, তাজমহল আসলে শিবের মন্দির। তাজমহল সম্বন্ধে অবশ্য এমন অনেক কিছুই প্রচলিত আছে। কোনও মতামত দেওয়ার আগে সেই সব প্রচলিত ধারনাগুলো কী, তা একবার দেখে নেওয়া যাক।

tajj_061418083142.jpgকালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জল, এ তাজমহল

ইতিহাস ও লোককথা

স্ত্রী মুমতাজের স্মৃতি রক্ষায় আগ্রায় তাজমহল তৈরি করেছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। তাজমহলের নির্মাণ সম্বন্ধে দু’টি প্রচলিত ধারনা আছে। সুন্দর এই সৌধ তৈরির পরে মূল স্থপতি ঈশা খান-সহ অনেকের হাত কেটে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান, যাতে তাঁরা এই ধরনের সৌধ আর নির্মাণ করতে না পারেন। দ্বিতীয় ধারনাটি হল, যমুনার যে পারে তাজমহল, তার উল্টোপারে একই রকম একটি সৌধ গড়া শুরু করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। তবে সেটি মূল তাজমহলের মতো মারকানা শ্বেতপাথরের তৈরি হচ্ছিল না, তৈরি করা হচ্ছিল কালো চুনাপাথরের, যাকে ইংরেজিতে বলে ব্ল্যাক মার্বেল। কোনও ইতিহাসবিদই এই দুই লোককথার এখনও কোনও সত্যতা খুঁজে পাননি। তাই এই দুই তথ্যের কোনওটিকেই এখনও ঐতিহাসিক তথ্য বলা যায় না।

আগ্রায় ইদিমাতদ্দৌল্লার যে সমাধি রয়েছে, অনেকে তাজমহলের গঠনে তারই ছায়া দেখতে পান। দুই সৌধের গঠনশৈলির মধ্যে আপাত ভাবে বেশ মিল পাওয়া যায়। কারুকাজের ধরনেও মিল রয়েছে। যদিও অন্য একটি মন্দিরের সঙ্গেও অনেকে এর মিল পান। তাজমহল গড়তে যে ২২ বছর সময় লেগেছিল বলে ধরা হয়, তা নিয়েও বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।

মালিকানার দাবি, পাল্টা দাবি

২০১৫ সালে হরিশঙ্কর জৈন নামে এক আইনজীবী দাবি করেছিলেন, তাজমহল আসলে শিবমন্দির। সেখানে উপাসনা করতে চেয়ে তিনি স্থানীয় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। অযোধ্যা রামজন্মভূমি মামলায় হিন্দুদের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ছিলেন হরিশঙ্কর জৈন। তাঁর দাবি, তাজমহলে প্রকৃতপক্ষে কোনও কবর নেই। অনন্তকাল ধরে ওই জায়গাটি অগ্রেশ্বর মহাদেবের থান বলেও তিনি মামলায় দাবি করেন (অগ্রেশ্বর মহাদেবের নাম থেকেই আগ্রা নামের উৎপত্তি বলে দাবি)। তাই ওই জায়গার মালিকানা দাবি করা হয় মামলায়। দাবি করা হয়, দেবোত্তর সম্পতির মালিকানা বদল করা যায় না। কোনও রাজাও ইচ্ছা করলে দেবোত্তর সম্পত্তির মালিকানা বদলে ফেলতে পারেন না। মালিকানা নিয়ে এই মামলা খারিজ করে দেয় আদালত।

ইতিমধ্যে ওয়াকফ বোর্ডও এখন তাজমহলের মালিকানা দাবি করে বসেছে, তাদের যুক্তি, সমাধিক্ষেত্র মানেই তা ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি। বর্তমানে তাজমহল হল ভারত সরকারের, যার রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বা আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এএসআই)। 

প্রার্থনার দাবি ও বিতর্ক

জৈন দাবি করেছিলেন, তাজমহলে যেন মুসলমানদের প্রার্থনা করতে না দেওয়া হয়। একই সঙ্গে হিন্দু দেবতার পুজো করার অনুমতিও তিনি চান।

সাধারণ ভাবে তাজমহল খোলা থাকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। শুক্রবার বন্ধ থাকে। তবে প্রতি শুক্রবার এই সৌধে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনা করেন বা নমাজ পড়েন। তাজমহলের দক্ষিণের একটি অংশের সৌধকে মসজিদ বলে দাবি করা হয়। সেই অংশের ফটকেই সম্প্রতি হামলা করেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সমর্থকরা।

তাজমহলকে শিবের মন্দির বলে দাবি করে ওই সৌধে নমাজ পড়া বন্ধ করে সেখানে হিন্দু মতে পুজো করার অধিকার চাওয়া হয় মামলায়। মামলা খারিজ হওয়ায় এই দাবিও খারিজ হয়ে যায় তিন বছর আগেই।

পুরুষোত্তম নাগেশ ওকের দাবি

তাজমহলকে মন্দির বলে দাবি করেছেন হিন্দু ইতিহাসবিদ পুরুষোত্তম নাগেশ ওক। এ নিয়ে তাঁর বইও আছে, যার নাম দ্য তাজমহল – এ টেম্পল প্লেস। তাঁর দাবি, এই সৌধের প্রকৃত নাম তেজো মহালয়। রাজপুতদের কাছ থেকে এই প্রাসাদ দখল করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। মহল শব্দটি যে কোনও ভাবেই সমাধির সঙ্গে যুক্ত নয়, সেই যুক্তিও তিনি দিয়েছেন।

মুমতাজ মহল থেকেও এই নামের উৎপত্তি হয়নি বলে দাবি করে তিনি বলেছেন, শাহজাহানের স্ত্রীর নাম ছিল মুমতাজ-উল-জামানি। তা ছাড়া নাম সংক্ষিপ্ত করতে হলে আদ্যাক্ষরগুলিই নেওয়া রীতি, প্রথম অংশ বাদ দিয়ে শেষাংস দিয়ে নামকরণ করার রীতি দেখা যায় না।

শাহজাহানের সময় ইউরোপীয়রা এই সৌধকে তাজ-ই-মহল বলে উল্লেখ করেছেন, যা আসলে তেজো-মহালয় (তেজ-ও-মহালয়)। যেখানে তাঁর স্ত্রীর পবিত্র সমাধি, যেখানে কোরানের ১৪টি অধ্যায় উৎকীর্ণ করা আছে, সেই স্থানে শাহজাহান সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করবেন, তা হতে পারে না।

মন্দিরের পক্ষে তাঁর যুক্তি, কোনও কবরস্থানে জুতো খুলে প্রবেশ করতে হয় না, কিন্তু তাজমহলে প্রবেশের সময় জুতো খুলেই প্রবেশ করতে হয়। কোনও স্মৃতিসৌধে একশো আট সংখ্যায় কিছু থাকে না, এটা একেবারেই হিন্দুদের মন্দিরের পবিত্র সংখ্যা, ১০৮ শিবমন্দির হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। তা ছাড়া একাংশ একেবারে সাদামাঠা, অন্য অংশ চিত্রিত। তাই একটি সৌধের উপরে যে কারুকাজ করা হয়েছে তাও স্পষ্ট।

তাঁর দাবি, রক্ষণাবেক্ষণের সময়ে মাটির নীচে শিবলিঙ্গ ও গেঁথে ফেলা হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও নাকি দেখেছেন সংরক্ষকরা। মার্বেলের নীচে বেলেপাথরের নির্মাণও তাঁরা দেখেছেন। ইতিহাস গোপন করার অভিযোগ তুলে এ ব্যাপারে তিনি আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভেকেও দুষেছেন।

body4_061418083452.jpgএ দেশের সমস্ত পুরাতাত্ত্বিক সম্পদের মালিক দেশ

এ ছাড়াও তিনি বলেছেন, শাহজাহানের দরবারে লেখা বাদশানামায় উল্লেখ রয়েছে যে মুমতাজের কবরের জন্য গম্বুজ সম্বলিত একটি অনবদ্য সৌধ নেওয়া হয়েছিল জয়পুরের মহারাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে।

ঔরঙ্গজেবের একটি চিঠি উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ১৯৫৩ সালে যদি তার নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়, তা হলে তা মেরামত করার দরকার হল কেন। তা ছাড়া মুমতাজের মৃত্যুর ১৫-২০ বপে জয় সিংয়ের থেকে মারকানা মার্বেল চেয়ে পাঠানো হয়েছিল, সে ব্যাপারে তিনটি ফরমান জারি করা হয়। যদি সেটি ২২ বছর ধরে নির্মিত হয়ে থাকে তা হলে মারকানা মার্বেল কেন এত পরে চাওয়া হল, সেই প্রশ্নও তুলেছেন ওক।

ফরাসি পর্যটক তাভেরনিরের বিবরণে উল্লেখ আছে, মুমতাজকে তাজ-ই-মকানে কবরস্থ করেছিলেন শাহজাহান। আরও বেশ কয়েকটি প্রমাণও তিনি দিয়েছেন।

body_dome_061418091731.jpgসৌধের চূড়ায় ত্রিশূল এবং কলসও রয়েছে যা হিন্দু মন্দিরের সাক্ষ্যও বহন করছে

যেমন কার্বন ১৪ পরীক্ষা (যেখানে বলা হয়েছে শাহজাহানের রাজত্ব শুরুর বছরের চেয়ে অন্তত ৩০০ বছরে পুরোনো ওই সব দরজা), বেশ কয়েকেটি পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ (চণ্ডীসেবা মন্দিরের অনুকরণে তৈরি, কেন্দ্রীয় অংশ চতুষ্কোণ, যার সঙ্গে হিন্দু মন্দিরের মিল আছে, চারটি মিনারও হিন্দু রীতিতে যেগুলি বিয়ের সময়ে করা হত, আট কোণও হিন্দুদের আট দিকের নির্দেশ প্রভৃতি)। এ ছাড়া সৌধের চূড়ায় ত্রিশূল এবং কলসও রয়েছে যা হিন্দু মন্দিরের সাক্ষ্যও বহন করছে।

সৌধের উপরে হামলা ও সরকারের করণীয়

এ দেশের সমস্ত পুরাতাত্ত্বিক সম্পদের মালিক দেশ। তা কোনও গোষ্ঠী বা ধর্মাবলম্বীর হতে পারে না। তাজমহল কোনও মন্দির হোক বা কবরস্থান, এখন তার পরিচয় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবেই। তার উপরে হামলাকে ইংরেজিতে ভ্যান্ডালিজম বলাই যায়, অর্থাৎ সৌন্দর্যের উপরে হামলা করে তা ধ্বংস করা।

আমাদের দেশে মন্দির ধ্বংস করে বা পরিবর্তন করে মন্দির তৈরির অনেক উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু এখন আবার নতুন করে সেই সব মন্দিরের অধিকার পাওয়ার আইনি লড়াইয়ে না গিয়ে সে সব সংরক্ষণ করাই জরুরি। দরকারে সেই সমস্ত স্থানে কোনও ধর্মীয় আচরণ বন্ধ করে তা পুরোপুরি সংরক্ষিত করা হোক। তাজমহলের মতো যে সব স্থানে পর্যটকদের আকর্ষণ রয়েছে, সেই সব স্থানে কোনও রকম ধর্মীয় কার্যকলাপ বন্ধ করে তা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে, এই সব স্থান নিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা ও দাবি সমূলে মিনাশ করা উচিৎ।

বামিয়ান থেকে জর্ডন, বহু জায়গাতেই ধ্বংস করা হয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক। কিন্তু তা কোনও মতেই সভ্য সমাজে কাম্য নয়। ভারতের বহমান সংস্কৃতি ও সভ্যতার যে সব চিহ্ন রয়েছে, তা শুধুমাত্র সংরক্ষণই করা হোক, তার অধিকার নিয়ে লড়াই বন্ধ হোক।  

 body2_061418091401.jpgতাজমহল কোনও মন্দির হোক বা কবরস্থান, এখন তার পরিচয় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবেই

সত্য উদ্ঘাটন জরুরি

একটি সৌধের গুরুত্ব কতটা, তা নির্ভর করছে তার ইতিহাসের উপরে। তাই যে সব সৌধ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে সেই সব সৌধের ক্ষেত্রে তার প্রকৃত ইতিহাস জানা জরুরি। ঐতিহাসিক গবেষমায় যদি দেখা যায় তাজমহল আসলে শিবের মন্দির তা হলে তার গুরুত্ব বাড়বেও না, কমবেও না। তবে যদি দেখা যায় এই সৌধ একাদশ শতকে তৈরি, তা হলে আমরা বলতে পারব, সেই সময়েও ভারতের এমন সৌধ তৈরির ক্ষমতা ছিল।

কোনও সৌধ তার ধর্মীয় পরিচয়ে নয়, খ্যাত হোক ঐতিহাসিক পরিচয়েই। বন্ধ হোক তা নিয়ে ধর্মের পেশী-প্রদর্শন আর আইনি লড়াই। ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করা হোক ইতিহাস হিসাবেই।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment