বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলেকে নিয়ে মায়ের গর্বিত পথচলা
বৈদূর্য্য অটিজমযুক্ত আট বছর বয়সের প্রাণবন্ত একটি ছেলে
- Total Shares
বৈদূর্য্যর মা। আর পাঁচটা মায়ের মতো আমিও ওই পরিচয়টাতেই সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। আমিও কারও মা। তবে সবাই হয়তো ভাবছেন এটা ঘটে করে বলার মতো কী এমন ঘটনা! আসলে আমার সন্তান বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন। বৈদূর্য্য অটিজমযুক্ত আট বছর বয়সের প্রাণবন্ত একটি ছেলে। বিশেষ শিশুর মা হয়ে, প্রত্যেকদিন আমি বৈদূর্য্যর চোখ দিয়ে এই পৃথিবীটাকে নতুন করে দেখি আর অনেক নতুন সব জিনিস শিখি।
ছোট্ট বৈদূর্য্য
একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা হিসাবে বলতে চাই যে, বাচ্চার জন্মের পর থেকে আমরা যখন তার টিকাকরণ কর্মসূচি শুরু করি, তখন থেকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে বাচ্চার শরীর ও মন যে ভাবে বিকসিত হওয়া উচিৎ, ঠিক তেমনটি হচ্ছে কিনা। এই ব্যাপারে প্রথম থেকেই ডায়েরিতে নোট রাখা উচিৎ। উদাহরণ স্বরূপ এখানে বলা যায়, বাচ্চা কবে কাউকে দেখে হাসতে শুরু করছে, কত মাস বয়সে তার ঘাড় শক্ত হচ্ছে প্রভৃতি।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে: বাচ্চা ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না, যেন সে শুনতেই পাচ্ছে না। শিশুরা সাধারণত যে ভঙ্গিমা করে থাকে নিকটজনদের দেখলে, তেমন কিছু করছে না, কথা বলতে দেরি করছে, সকলের সঙ্গে মিশতে অসুবিধা হচ্ছে, তখন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। যদি জানতে পারেন অটিজম বা অন্য কোনও ধরনের বিকাশ-জমিত সমস্যা আপনার বাচ্চার রয়েছে, তা হলে ভেঙে না পড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুর চিকিৎসা শুরু করুন। যদি সম্ভব হয়, তা হলে কোনও পেরেন্ট ট্রেনিং কোর্স বা এই ধরনের ছোটখাট ওয়ার্কশপে যোগ দিয়ে নিজে প্রশিক্ষিত হয়ে শিশুকে উপযুক্ত ভাবে বড় করতে পারেন।
অটিজম আছে জানতে পারলেই বহু আত্মীয়-স্বজন বলে থাকেন, কোনও পাপের ফলেই এমনটা হয়েছে। আজ্ঞে না, কোনও পাপ নয়, এটা একটা অসুবিধা যা ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনও শিশুর হতে পারে। আমাদের বাচ্চাদের যেমন আচরমষ সামাজিক মেলামেশা, বাক্যালাপে সমস্যা থাকে, তেমনই তাদের পছন্দও কয়েকটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই সেই একাগ্রতা কাজে লাগিয়ে কোনও ব্যাপারে তারা অন্যদের চেয়ে ভালো ফল করতে পারে। তাই দেখা গেছে, অটিজম-যুক্ত ব্যক্তি অতি বড় মাপের যন্ত্রশিল্পী, সাঁতারু, চারুকলা শিল্পী হয়েছেন। তাই মা হিসাবে বলছি, আপনার বাচ্চার উপরে বিশ্বাস রাখুন। এই ধরনের বাচ্চাদের আরও বেশি করে সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। ওর পছন্দের বিষয় ওকে শিখতে সাহায্য করুন। ওকে ঘরে আটকতে রাখবেন না। আপনার বাচ্চা আপনার শক্তি। আপনি এগিয়ে আসলে সমাজও এগিয়ে আসবে।
আমাকে আমার ছেলের ডাক্তার বলেছিলেন, ওকে একটি সাধারণ স্কুলে ভর্তি করতে। ও সে রকম একটি স্কুলেই পড়ে যেখানে স্পেশ্যাল এডুকেটর ওকে সর্বতো ভাবে সাহায্য করেন।
মোটামুটি আড়াই বছর বয়সের পর থেকে বুঝতে পারি ওর কিছু অসুবিধা রয়েছে। তবে ওর অসুবিধাগুলোর কথা আজ বলবো না। বরং আমার প্রাপ্তিগুলো বলি। কেমন!
বৈদূর্য্যকে ওর যখন আড়াই বছর বয়স তখন ওকে একটা স্কুলে ভর্তি করি। প্রত্যেকদিন স্কুলে যায় আর আসে। এরম প্রায় মাস আটেক চলার পর ওর ক্লাস টিচার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তো ভয় অস্থির যে না জানি ছেলে আবার কী করলো ! ওর ক্লাস টিচার আমাকে বললেন যে, "বৈদূর্য্য আজ বলেছে মাম্মা যাবো।" টিচারের কথাটা শুনে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না ওনার সামনেই আনন্দে কেঁদে ফেললাম। বড় পাওণা সেদিন আমার কাছে আর কিছু ছিল না। আমার ছেলের টয়লেট ট্রেনিং ও এই স্কুল থেকেই হয়েছিল।
ছেলেকে নিয়ে মায়ের পথ চলা
আবার একদিন আমার ছেলের স্কুল থেকে ওর টিচার আমাকে ডেকে পাঠালেন। যথারীতি আবার ভয় ভয় গেলাম। ওর শিক্ষিকা আমাকে বললেন, "আজ আমি খুব খুশি, বৈদূর্য্য আমাদের গান শুনিয়েছে...গানটা হল বিন্দাস হয় নাচো রে ।" বৈদূর্য্য যেকোনও গান শুনলেই ও আর সেই সুর ভোলে না।
বৈদূর্য্য এখন
আর মজার কথা কী জানেন, বাবা-মা ও বাড়ির অন্যদের ছাড়াও ওর অসম্ভব প্রিয় আর একজন মানুষ হলেন সালমান খান। এমনকি ও নিজেকেও সালমান খান মনে করে। সালমান খান যখন 'বাজরাঙ্গি ভাইজান' বা 'সুলতান' কিংবা 'টিউবলাইট' অথবা 'টাইগা'-রে মার খায় তখন আমার ছেলে রুদ্ধশ্বাসে সেদিকে তাকিয়ে থাকে আর ওর দু'চোখ জলে ভোরে যায়।
বৈদূর্য্যর আর একটা প্রিয় জিনিস হল সাঁতার কাটা। সাঁতার ওর প্রাণ।
মাবাবার সঙ্গে বৈদূর্য্য
এভাবেই ওকে নিয়ে এগিয়ে চলেছি প্রত্যেকদিন। সাধারণ আর পাঁচটা বাচ্চার মায়েরা যখন তাঁদের ছেলে কিংবা মেয়ে একশোয় একশো নম্বর পেলো কি না সেই ভেবে হতাশ হয়, তখন আমরা অসাধারণ বাচ্চার মায়েরা আমাদের সন্তানদের ট্যারাব্যাকা লাইন টানা দেখে খুশিতে নতুন স্বপ্ন বুঁনি।

