সেই কথক তো গল্প বলতেন না, যেন ম্যাজিক করতেন
ওনার গল্প শুনে মনে হত আমরা বুঝি গল্পটা টেলিভিশন স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছি
- Total Shares
তখন রেডিয়ো আর টেভিশনের কোনওটাই ছিল না। অবসর বিনোদন বলতে ছিল কথকের গল্প শোনা। উত্তরপ্রদেশে কথককে বলা হত দাস্তানগি।এ যুগেও সেই পুরোনো দিন ফেরানোর চেষ্টা করছেন দুই বৃদ্ধ মাহমুদ ফারুকি ও দানিস হুসেন।
সপ্তাহ কয়েক আগে আমি একটি অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমার ঠাকুরদা উত্তরপ্রদেশের পূর্ব প্রান্তে গাজিপুরে আইনজীবী ছিলেন। গাজিপুরে তাঁর একটা প্রাসাদোপম বাড়ি ছিল। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমার ছেলেবেলায় আমরা জনা কুড়ি মিলে ছুটি কাটাতাম সেখানেই।
সেই সময় আমাদের বিনোদনের জন্যে ঠাকুরদা গ্রামের দাস্তানগিদের আমাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান করবার জন্য ডাকতেন। এই দাস্তনগিরা আমাদের তিলিসম-ই-হসরুবা থেকে গল্প শোনাতেন।
ঐতিহাসিক তথা অনুবাদক মুশারফ আলি ফারুকির মতে, উর্দু লেখক মুহাম্মদ হুসেন (যিনি জাহ ছদ্মনামে লিখতেন) সর্বপ্রথম তিলিসম-ই-হসরুবা রচনা করেন পরবর্তীকালে যাতে আরও অনেকেরই অবদান রয়েছে। উনিশ শতকের শেষ দিকে লখনৌয়ের প্রকাশক নাভাল কিশোর তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন।
তিলিসম শব্দটির অর্থ হচ্ছে জাদু। হসরুবা হচ্ছে একটি কল্পিত সাম্রাজ্য যেখানে বিভিন্ন ধরণের জিন, ডাকিনি, যোগিনী, জাদুকর ও উদ্ভট সব জীবজন্তুর আস্তানা।
এই সব গল্পগুলো হয় অলৌকিক, না হয় ইন্দ্রজালের উপরে ভিত্তি করে রচিত। প্রায় আট হাজার পাতার এই বইয়ে যত গল্প রয়েছে, সে সবই আমির হামজাতার সাহসিকতা নিয়ে লেখা, তিনিই নায়ক। অনেকেই মনে করেন যে হ্যারি পটারের গল্পগুলো এ থেকেই অনুপ্রাণিত।
আমাদের বাড়িতে একজন ৭০ বছরের বৃদ্ধ দাস্তনগি আসতেন। প্রতিদিন নৈশভোজের পরে সাদা লুঙ্গি ও কুর্তা পরিহিত এই বৃদ্ধ বাড়ির ছাদে বসে আমাদের গল্প শোনাতেন। বাড়ির ছোটরা ছাড়াও প্রতিবেশীর ছেলেমেয়েরাও আমাদের এই গল্প শোনার আসরে যোগ দিতেন। লেখাপড়া জানতেন না ওই বৃদ্ধ। কিন্তু একটি বালিশে হেলান দিয়ে নিজের স্মৃতি থেকে হসরুবার গল্প বলে যেতেন তিনি। একদিন যেখানে শেষ করতেন পরের দিন ঠিক সেখান থেকেই আবার নতুন করে শুরু করতেন। ওঁর গলার স্বর ও গল্প বলার ধরণ দেখে মনে হত উনি বুঝি কোনও নাটকের বা যাত্রাপালার অভিনেতা।
আমরা অবাক হয়ে ওঁর গল্প শুনতাম। কোনও রকম মঞ্চ দরকার হত না, ওঁর গল্প শুনে মনে হত আমরা বুঝি গল্পটা টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাচ্ছি।
বহু বছর পরে বড় হয়ে আমি ‘আঁধা গাওঁ’ উপন্যাসটি পড়েছিলাম। আমার কাকা রহি মাসুম রাজা এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। এই বইয়ের মুখ্য চরিত্র ফুন্নন মিয়াঁর চরিত্রটি আদতে আমাদের গ্রামের বৃদ্ধ দাস্তানগি। এই বৃদ্ধের বলা গল্পের মতোই তাঁর জীবনটাও যথেষ্ট দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতায় ভরা। তিনি এক কালে দস্যু ছিলেন। বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে চাষের জমিতে ঢুকে ফসল চুরি করতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া আরও অনেক অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি, যা নিয়ে বাড়ির বড়রা আমাদের কাছে খুব একটা মুখ খুলতেন না।
লেখাপড়া জানতেন না ওই বৃদ্ধ। কিন্তু একটি বালিশে হেলান দিয়ে নিজের স্মৃতি থেকে হসরুবার গল্প বলে যেতেন।
একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে তিনি প্রতিবেশীর বাড়ির পাঁচিল টপকে নিজের বাড়িতে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় তাঁর প্রতিবেশীর স্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি এখন একা আছেন, তাই এই সময় অন্য পুরুষ বাড়িতে ঢুকলে গ্রামবাসীরা ভালো চোখে দেখবে না। তখন দাস্তানগি ওই মহিলাকে একেবারে চ্যাংদোলা করে আবার পাঁচিল টপকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। মহিলা আর কোনওদিন তাঁর স্বামীর ঘরে ফেরেননি। তাঁর স্বামীও আর কোনওদিন সাহস করে স্ত্রীকে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেননি। যদিও স্বামীর মৃত্যুর পর ওই মহিলা নিজের শাঁখাপলা ভেঙে ফেলেছিলেন।
দাস্তানগি তাস খেলতে খুব পছন্দ করতেন এবং জুয়া খেলেও রোজগার করতেন। একদিন জুয়ার আসরে বাজি লাগিয়ে এক দারোগার খাকি পোশাক জিতে নিয়েছিলেন। দারোগা দাস্তানগিকে মোটা টাকার বিনিময় ওই পোশাক ফিরিয়ে দেওয়ার আর্জি জানান। কিন্তু দাস্তানগি এই আর্জি খারিজ করে দেন। দারোগা রীতিমতন ক্রুদ্ধ হয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দাস্তানগিকে গ্রেপ্তার করেন। হাজতে তাঁর ওপর ভীষণ অত্যাচার কেরন এবং এমনকী গোঁফের খানিকটা উপড়ে নেন। মুক্তি পাওয়ার পরে দাস্তানগি দলবল নিয়ে থানায় হামলা করেন এবং থানাতে আগুন লাগিয়ে দেন। এটি ১৯৪২ সালের ঘটনা, যখন মহাত্মা গান্ধী দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে থানায় হামলার কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং দাস্তানগি এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
সকালবেলায় তিনি আমাদের তাস নিয়ে নানা ধরণের খেলা শেখাতেন। ঠাকুরদার কাছে খবর পৌঁছাতেই ঠাকুরদা দাস্তনগিকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ঠাকুরদাকে জানালেন যে তিনি ছোটদেরকে শুধুমাত্র একটি 'খেলা' শেখাচ্ছেন।
আমি এই খেলায় খুব একটা পারদর্শী হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু আমার অন্য ভাইরা পেরেছিল। তারা একদিন দাস্তানগিকে পরাজিত করে তাঁর সমস্ত টাকা জিতে নেয়। সেই টাকা দিয়ে শহরে গিয়ে কয়েকটি জিনিস কেনার কথা ছিল দাস্তানগির। এর পর তিনদিন তিনি আর আমাদের বাড়িতে আসেননি। পরে শুনেছিলাম, তিনি ফের অর্থ উপার্জনের জন্যে জুয়ার ঠেকে গিয়েছিলেন।এই দাস্তানগি আবার গাজীপুর জেলা দায়রা আদালতে পেশাদার সাক্ষী হিসেবে রোজগার করতেন। তাই তিনি আদালতের প্রতিটি উকিল ও বিচারককে চিনতেন। সেই সময় এক একবার সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তিনি দুটাকা করে নিতেন।
আমার বাবা কিন্তু এই বৃদ্ধ দাস্তানগিকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেখানে আমার বাবা পড়াতেন) পরীক্ষার হলে জল দেওয়ার চাকরি দেন দাস্তানগিকে। সেখানে তিনি তাবিজের ব্যবসা শুরু করে দেন, তবে তাঁকে বেশিদিন পির হিসাবে কাজ করেননি, কিছুদিন পরেই তিনি গ্রামে ফিরে আসেন।
সত্যি, আমাদের গ্রামের বৃদ্ধ দাস্তানগির কাহিনি আজও মনকে নাড়া দেয়। বড় হয়েও আমি ওঁর সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে যেতাম, ওঁর সান্নিধ্যে আমি অভিভূত হয়ে যেতাম।

