ছেলেদের ক্ষেত্রে পাকাচুল স্টাইল স্টেটমেন্ট হলে, কেন উল্টো নিয়ম মেয়েদের ক্ষেত্রে?
ছেলেদের কাঁচা-পাকা চুলকে আমরা 'স্টাইল স্টেটমেন্ট' বলে বাহবা দিই
- Total Shares
কয়েকবছর আগে একদিন জিমে যাওয়ার সময় যখন চুল বাঁধছিলাম তখন আমার ভাসুর এসে আমাকে বলেন যে আমার মাথায় নাকি অনেক পাকা চুল দেখা যাচ্ছে। আমি তাকে বলি আমিও সেটা লক্ষ করেছি। তাতে আমার ভাসুর আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি কি পাকা চুলগুলো ঢাকব না? আমি তাকে বলি পাকা চুল ঢাকব কিনা এখনও ভাবিনি। তারপর একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে এক পুরুষ আত্মীয় এসে আবার একই কথা বলে। অফিসেও আমার একজন সহকর্মী আমার পাকা চুল নিয়ে মন্তব্য করে। কিন্তু আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পাকা চুলের দিকে তাকিয়ে রইল তখন আমার মনে হল যে মানুষের বিশেষ করে পুরুষদের আমার পাকা চুল নিয়ে কেন এত সমস্যা?
কখনও ভাবিইনি যে আমি আমার পাকা চুল ঢাকব কিনা বা রং করব কিনা। একটা ব্যাপারটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।কিংবা এটাও কখনও ভাবতে পারিনি যে আমার পাকা চুল ঢাকার ব্যাপারটা এতগুলো লোকের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠবে।আমি এদের সকলের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট বলে কি আমার পাকা চুল তাদের নিজেদের বয়সের কথা মনে করিয়ে দিছিল।এঁরা প্রায় সকলেই নিজেদের সাদা চুল কালো করেন। আমার সাদা হয়ে যাওয়া চুল এদের সবার থেকে আমাকে আলাদা করে দিয়েছিল বলেই কি এদের অস্বাস্তি কারণ ঘটেছিল?সিনেমা ও টিভির বিজ্ঞাপনগুলিতে সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায় তা এখন গতে বাঁধা একটা ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে।সৌন্দর্যের এই নিখুঁত ছবিটাই আমাদের মনে একেবারে বদ্ধমূল ভাবে বসে রয়েছে।আমরা কেউ কোন দিন বোধয় এই সৌন্দর্যের এই ছবিটা মন থেকে সরাতে পারিনি।
পাকা চুল নিয়ে আমার কোনও দিন কোনও অস্বস্তি হয়নি
বালাজির অনুষ্ঠানে ঠিক যেমন আবহ সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়ে ঠিক তেমনই একটি গান ব্যবহার করে একটি বিজ্ঞাপনে একজন পাকা চুলওয়ালা মহিলাকে দেখানো হয় যাকে কেউ পিছন থেকে তিনবার 'মাসিমা', 'মাসিমা', 'মাসিমা' বলে ডাকে।এই বিজ্ঞাপনটা বোধহয় আমাদের সবার মনে আছে।পাকা চুল দেখলে আপনাকে সবাই বয়স্ক বলেই ভাবে। আপনি যে মাঝবয়সী, সেটার প্রমাণ আপনার পাকা চুল।
পাকা চুল নিয়ে আমার কোনও দিন কোনও অস্বস্তি হয়নি।আমি দুই সন্তানের মা। তাই অনেকে আমাকে অনেক সময়েই মাসিমা-কাকিমা বলে সম্বোধন করে থাকে। আমার বয়স বাড়লেও তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, আর আমি আমার বয়স লুকোতেও চাই না। আমার সন্তানের বয়স এগারো, সেই হিসাবে আমার বয়স খুব একটা কম হতে পারে না। আমার মনে হয় এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়। আমি আমার জীবন উপভোগ করি, যা করতে ভালো লাগে তাই করি। কার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ব বা কোন মদ খাব কিংবা কোন বইটা পড়ব, কার সঙ্গে কী নিয়ে আড্ডা মারব কিংবা কার সঙ্গে থাকব সেটা আমিই ঠিক করব।
শুধু যে এই কারণগুলোর জন্যই আমি চুল রং করা ছেড়ে দিয়েছি এমনটা নয়। চুল রং করার ইচ্ছে বা সময় দু'টোর একটাও আমার নেই।বন্ধুদের কাছে তাদের প্রথমবার চুল রং করার সব অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। তাদের কাছে শুনেছিলাম যে প্রথমে তারা ছ'মাসে একবার সাদা চুল রং করত তারপর সেটা এসে দাঁড়াল চার মাসে একবার তারপর দু'মাসে একবার, এবং অবশেষে প্রতি মাসে এসে ঠেকলো সাদা চুল রং করার প্রয়োজন। আমার জীবনে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল চাকরি করে দু'টো বাচ্চা সামলান। তবে আমারও যে পাকা চুল ঢাকার একটা ইচ্ছে আছে তেমনটা নয়। যদি সেলুন বা স্পায় যেতেই হয় তা হলে সেখানে গিয়ে আমি মালিশ করাব, মুখের কোনও চর্চা (ফেসিয়াল) করাব বা পায়ের যত্ন (পেডিকিওর) করাব। কিন্তু আমি খুবই অলস।
তা ছাড়া এ সব নিয়ে আমি তেমন একটা মাথাও ঘামাই না। সাজগোজে তেমন একটা ইচ্ছা আমার কোনও দিনই ছিল না তাই আয়নার সামনে অনেক সময় কোনও দিনই কাটাইনি। কোনদিন মনেও হয়নি যে না সাজলে আমাকে ভালো দেখায় না। এমন অনেক মহিলাকে আমি চিনি যারা প্রত্যেকদিন চোখে কাজল পরেন। আর যে দিন কাজল পরেন না সেদিন সবাই ভাবে ওঁর বোধহয় অসুখ করেছে। কারণ যাঁকে আমরা রোজ কাজল পরা দেখি তাঁকে একদিন কাজল ছাড়া দেখলে মনে হয়ে যেন তিনি অসুস্থ। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব নিয়ে আমার কোনও দিনই কোনও অস্বস্তি ছিল না। তা ছাড়া আর কতদিন পাকা চুল কালো করব? আমি এই দোটানায় পড়তে চাই না?
আমিও চুলে রং দিয়েছি, চুল সোজা করিয়েছি ও চুলকে পার্ম করিয়েছি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সহজাত জিনিসের প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়েছে।যদিও অনেকে বলেন তাঁদের নাকি চুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তবুও তাঁরা চুলে রং লাগান বন্ধ করেন না। মেহেন্দি একটি ভেষজ উপাদান। তাই মেহেন্দি দিয়ে চুল রং করলে চুলের তেমন একটা ক্ষতি হয় না। তবে সেলুনগুলোর মতে, দীর্ঘদিন ধরে মেহেন্দি ব্যবহার চুলের ক্ষতি হতে পারে। মেহেন্দির গন্ধ আমার ভালো লাগে না বলে আমি কখনও মেহেন্দি লাগাইনি। আমার যদি পাকা চুল ঢাকার তাগিদ থাকত তাহলে নিশ্চয়ই কোনও একটা বিকল্প উপায় ঠিক বের করে ফেলতাম।
কী অদ্ভুত না? আপনি মানুষটা ঠিক কেমন সেটা এখন বিচার করা হচ্ছে চুলের রঙের মতো একটা তুচ্ছ জিনিস দেখে। এমন কয়েকজন দৃঢ়চেতা মহিলা আছেন যাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁরা কেউ তাদের পাকা চুল রং করেন না। তাহলে কি আমি এঁদের অনুকরণ করছি না এটা শুধুই সমাপতন? হয়ত অনুকরণ করছি। আমি খুব ভেবে চিন্তে যে এমন করছি তা নয়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই আমার এই মানসিক বদল এসেছে।যাঁদের আমরা শ্রদ্ধা করি, মনে মনে হয়ত তাদের মতোই হতে চাই।
তাই প্রায় চার বছর পার করে যখন চুলের বেশ কিছুটা অংশে পাক ধরেছে, তখন নতুন করে আমার একটা উপলব্ধিও হয়েছে।পাকা চুল ঢাকা না দেওয়ার তাগিদ যেমন গতে বাঁধা সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটিকে ভেঙে দেয়ে ঠিক তেমন ভাবেই মহিলা ও পুরুষের মধ্যে লিঙ্গ-বৈষম্যও একটু হলেও কমায়। পাকা চুল নিয়ে পুরুষদের তেমন সমস্যা নেই, তাদের সমস্যা টাক। ছেলেদের কাঁচা-পাকা চুলকে আমরা 'স্টাইল স্টেটমেন্ট' বলে বাহবা দিই, কিন্তু মেয়েদের তো এমনটা হয়ে না। যে সব মহিলাদের কাঁচা-পাকা চুল আছে তাদের আমার হয়ত মার্জিত বা অভিজাত বলতে পারি কিন্তু 'স্টাইলিশ' বলি না।
কয়েকজন মহিলা যদিও মনে করেন তাঁদের প্রকৃত সৌন্দর্য্য চুলের রঙের উপর নির্ভর করে না। এঁরা মনে করেন কোনও মানুষের ব্যক্তিত্ব তার সৌন্দর্য্যের উপর নির্ভরশীল নয়। তবে যারা এমনটা মনে করেন না তাদের প্রতি কোনও বিরূপ মনোভাব আমার নেই। চুল রং করার ব্যাপারটা একেবারে একটা নিজস্ব সিদ্ধান্ত। বহু মহিলা তাদের পাকা চুল রং করেন বলে এটা অন্যদের উপরেও চাপিয়ে দেওয়াটা উচিত্ হবে না।খুবই অবাক লাগে যখন পেকে চুল রং করা নিয়ে কত অজস্র এবং অযাচিত উপদেশ পাই। কিন্তু আর না।
স্কুলের পুরোনো বন্ধুদের জমায়তের ছবিগুলো যখন দেখি যেই বন্ধুর পাকা চুল দেখা যাচ্ছে আমার চোখটা স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর দিকেই চলে যায়। আমি কি তাহলে পাকা চুল নিয়ে সকলের চুল চেরা বিচার করছি? না তেমনটা তো নয়। আমি কি তাহলে ছবিতে আমার এই বন্ধুটির বিচার করছি? অবশ্য কারণ ছবিতে যেই মহিলাটির পাকা চুল দেখা যাচ্ছে শুধু সেই আমার মনের মতো।

