অনেকেই বিদ্রুপ করে জিজ্ঞাসা করেন, "মহিলাদের টয়লেটে যাবেন নাকি পুরুষদেরটায়?"

ছোটবেলায় বড়রা আমাকে শিখিয়েছিলেন সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখা উচিত

 |  3-minute read |   08-09-2018
  • Total Shares

প্রথমে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "ভাই তুমি তো সমকামী নও কিংবা তোমার মনটা একজন নারীর মতো নয়, তাহলে তুমি ওঁদের কথা এতো কেন ভাবছ...তুমি পড়াশোনায় মন দাও, এ সব বাদ দাও।" আমি উত্তরে তাঁদের বলি যে পুরুষরাই পুরুষদের কথা ভাববে এবং মহিলারাই মহিলাদের অসুবিধার কথা বলবে সেটা কেমন কথা।? আজ যদি আমি এঁদের কথা না ভাবি তাহলে পুরুষদের কোনও সমস্যা হলে নারীরাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে না। মহিলা, পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ বলে বিভাজন না করে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা উচিত। তাই মানুষ যে ওপর মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

t_body3_090818031641.jpgশোভন মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর পাবলিক টয়লেটে স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রকল্প 'বন্ধন'

ঠিক এই বিশ্বাস থেকে আমার পথ চলা শুরু হয়। ছোটবেলা থেকেই আমার বড়রা আমাকে শিখিয়ে ছিলেন যে সবাইকে সমান ভাবে দেখা উচিত। আমি যখন স্নাতকের ছাত্র তখন একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করি। পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যার বিষয় ছিল "চেনা তবু অচেনা"। সেই সংখ্যায় আমি এই মানুষগুলোর জীবন এবং তাঁদের লড়াই নিয়ে লিখব বলে ঠিক করি। তখন আমি এঁদের অনেকের সংস্পর্শে আসি এবং তাঁদের অনেক সমস্যার কথা জানতে পারি। তখনই জানতে পারি রাস্তাঘাটে বা কোনও শপিং মলে গেলে কিংবা কোনও পাবলিক টয়লেটে গেলে তাঁদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, এমনকি অপমানিত হতে হয় বললেও ভুল হবে না।

তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট ও আলাদা শৌচালয়ের বন্দোবস্ত। কারণ বহু অবিবেচক মানুষ তাঁদের বিদ্রুপ করে এমনও বলেন যে, "মহিলাদের শৌচালয় যাবেন, নাকি পুরুষদেরটায়?"

তখন আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্যা রঞ্জিতা সিনহার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। তিনি বলেন যে তাঁরাও বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন এবং সরকারের সঙ্গে কোথাও বলেছেন। তিনি বলেন যে পুরুষ ও মহিলাদের পাবলিক টয়লেটগুলোর পাশেই যদি আর একটি ভবন নির্মাণ করে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য পাবলিক টয়লেট যদি নির্মাণ করা যায় তা হলে সমস্যার সুরাহা হতে পারে। পুরো ব্যাপারটা শুনে আমার মনে হয়েছিল, চিন্তা ভালো হলেও তা যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনই এতে খরচও বিস্তর। পাশাপাশি আমার আরও একটা বিষয় খটকা লেগেছিল, আমার মনে হল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য যদি একটি আলাদা ভবন নির্মাণ করা হয় তা হলে তো চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে দেওয়া হবে যে এঁরা আমাদের থেকে আলাদা। তাই না?

t_body1_090818031724.jpgতৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য পাবলিক টয়লেট 'ত্রিধারা'

তখন আমার মনে হল আমাদের শহরে যে কটি ওয়ার্ড রয়েছে সেখানকার পাবলিক টয়লেটে যদি এই বন্দোবস্ত চালু করা সম্ভব হয়, তা হলে মন্দ হয় না।

তখন আমি বেশ কয়েকটি পাবলিক টয়লেট ঘুরে দেখি এবং সেখানে গিয়ে দেখি যে মহিলাদের এবং পুরুষদের পাবলিক টয়লেটে প্রায় আট থেকে ন'টি করে খোপ করা থাকে এবং সবকটি খোপই যে সব সময় ভরা থাকে তা নয়, একটা না একটা খোপ ফাঁকাই থাকে। তখন আমার মনে হল এতগুলো খোপের যদি একটিকে তাঁদের জন্য সংরক্ষিত রাখা যায় তাহলে কেমন হয়? অর্থাৎ রূপান্তরকামী পুরুষদের জন্য পুরুষ বিভাগে একটি টয়লেট এবং রূপান্তরকামী মহিলার জন্য মহিলাদের বিভাগে একটি। এই শৌচালয়ের নাম দিলাম "ত্রিধারা"। এরপর ত্রিধারা নামে অনেকগুলো স্টিকার ছাপিয়ে ফেললাম। শুরু হল মাঠে নেমে লড়াই। প্রচার শুরু করি। আমি যে ওয়ার্ডের বাসিন্দা, সেখান থেকে আমি প্রচার শুরু করি। আমি কলকাতা পুরনিগমের ১১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আমাদের কাউন্সিলর অনিতা কর মজুমদারের সঙ্গে দেখা করে স্থানীয় শৌচালয় স্টিকারটি লাগাবার ইচ্ছা প্রকাশ করি এবং অনুমতিও পাই।

আজ সারা শহরে ১৫টি পাবলিক টয়লেটে আমি এই বন্দোবস্ত করতে পেরেছি।

তারপরেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে দুঃখের বিষয় হল ওই ১৫টি পাবলিক টয়লেটের বেশি আমি আর এগোতে পারিনি। সবাই অনিতা কর মজুমদার হয়ে উঠতে পারেন না। সাধারণ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। প্রশাসনিক স্তরে কথা বলতে গিয়ে এমন কোথাও শুনেছি যে, "আমাদের ওয়ার্ডে এই সব চলবে না এতে আমার ওয়ার্ডের মহিলা ভোটার কমে যাবে।"

t_body2_090818031738.jpgতৃতীয় লিঙ্গের জন্য পাবলিক টয়লেট 'ত্রিধারা'

ন্যাশনাল ফাউনডেশন অফ ইন্ডিয়া আমাকে আমার এই কাজের জন্য পুরস্কৃত করে।

কাজটা করতে গিয়ে একটা জিনিস খুব ভালো ভাবে বুঝেছি যে পাবলিক টয়লেটে শুধু স্টিকার মারলেই হবে না, প্রত্যেকের মানসিকতাকে পরিবর্তন করতে হবে। তাই আমি আমার প্রচার শুরু করেছি একদম স্কুল থেকে।

এমনই একটি চিন্তার থেকে শহরের বহু পাবলিক টয়লেটে যাতে মহিলারা খুব সহজেই এবং অনেক কম খরচে প্রয়োজনে স্যানিটারি ন্যাপকিন পেতে পারেন সেই ব্যবস্থাও চালু করেছি।  

তবে আমি আমার লড়াই চালিয়ে যাব।  

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SOBHAN MUKHERJEE SOBHAN MUKHERJEE

Student | Social Activist

Comment