যক্ষ্মায় ভারতে প্রতি ঘণ্টায় ১৮ জন মহিলার মৃত্যু হয়: আমরা কেন কিছু ভাবছি না?
মহিলারা রোগটা অনেক সময় চেপে যায় বলে চিকিৎসাও পায়ে না তাঁরা
- Total Shares
৮ মার্চ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। ঠিক তার দু'সপ্তাহের মধ্যেই শুধু টিউবারকুউলোসিসে (টিবি) আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রায় কুড়ি হাজার মহিলার মৃত্যু হয়েছে, এই তালিকায় ভারত রয়েছে তৃতীয় স্থানে। ২৪ মার্চ বিশ্ব টিউবারকুউলোসিস দিবস আর তার আগের মাত্র দু'সপ্তাহে টিবি-তে মৃত্যু হল ২০ হাজার মহিলার
প্রতি ঘণ্টায় ১৮ জন মহিলা টিবিতে মারা যান। যতজন মহিলা মাতৃত্বকালীন তথা অন্য রোগে মারা যান, টিবি-তে মৃত্যুর সংখ্যা মোটামুটি তার তিন গুণ। তাই আন্তর্জাতিক টিউবারকুউলোসিস দিবসে রোগটি নিয়ে সচেতন করতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা হয়।
টিবি একটি বায়ু-বাহিত রোগ। যাঁরা টিবি রোগীদের শুশ্রুষা করেন বা টিবি রোগীদের কাছাকাছি থাকেন, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জীবাণু ঢুকে তাঁদের ফুসফুস, মেরুদণ্ড, মস্তিস্ক ও শরীরের অন্যান্য জায়গার টিবি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। দেখা গেছে রোগটি প্রতিরোধের ক্ষমতা থাক বা না থাক, পরিবারের কোনও ব্যক্তির টিবি হলে মহিলাদের এই রোগটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে অনেক বেশি, কারণ তাঁরাই রোগীর সেবা করে থাকেন। বিসিজি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা খুব কম দিন থাকে। দশ বছর বয়সের পরে শরীরে এই রোগটির প্রতিরোধের টিকা কোনও কাজ করে না বলেই চলে, তাই তারপরে এই রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়, এই রোগ হয়ও।
যাঁরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজকর্ম করেন এবং যাঁদের পুষ্টিকর খাবারদাবারের অভাব রয়েছে, তাঁদের এই রোগটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে অনেক বেশি। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মহিলাদের অভ্যাস হল, নিজে না খেয়ে পরিবারের অন্যদের ভালোটা খাওয়ানো। পরিবারের লোকজনও ধরেই নেন যে বাড়ির মহিলারা কখনও কোনও বিষয়ে কোনও রকম অভিযোগ-অনুযোগ করবেন না।
২০১৬র ল্যানসেট সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের সবকটি দেশের মধ্যে ভারতে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তরে প্রায় ১০১ মিলিয়ন বা ১০ কোটির বেশি মহিলার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। তা ছাড়াও প্রায় ৮০ শতাংশ মহিলার ভিটামিন ডি-র অভাব রয়েছে।
ছবি: এপি
মহিলাদের ওজন কম হলে ও ভিটামিন ডি-র অভাব হলে টিবির আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। টিবি রোগীরা অপুষ্টিতে ভোগেন। স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সামাজিক সমস্য়াও শুরু হয়ে যায় এমন একজন মহিলা যাঁর কাঁধে একসময় পুরো পরিবারের দায়িত্ব ছিল, সংসারের বিভিন্ন কাজ যিনি দক্ষতার সঙ্গে সামলাতেন, পরিবারের সকলের যত্ন করতেন, সেই মহিলার যদি টিবির মতো ছোঁয়াচে রোগ ধরা পড়ে, তখন সেই মহিলাকেই তাঁ পরিবার বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। তখন পরিবারের সম্মান রক্ষা করার জন্য বাকিরা ভয়ে পেয়ে তাঁকে একঘরে করে দেন।
আর সেই রোগী যদি হয়ে বাড়ির মেয়ে হয় তা হলে সবার মনে যে প্রশ্নটা প্রথম দেখা দেয়, সেটা হল এবার একে কে বিয়ে করবে? রোগী যদি পরিবারের বউ হন, তা হলে প্রশ্ন উঠবে, এ বার বাড়ির কাজ কে করবে বা তিনি কী ভাবে সন্তান ধারণ করবেন কিংবা সংসারের আয় বাড়াতে কী ভাবে সাহায্য করবেন? সেই রোগী যদি কোনও সংস্থার কর্মী হন তাহলে তার এই রোগের জন্য সংস্থার যে সময় ও টাকা নষ্ট হল তা কে পূরণ করবে? পরিবারের লোকের এই ধরনের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় রোগীকে।
অথচ সেই মহিলার ছেলে বা স্বামী কিংবা ভাই অথবা বাবার যদি এই রোগটা হয়ে তখন তিনি কোনও কিছুর পরোয়া না করে বাড়তি দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেন। তিনি যেমন রোগীর সেবাযত্ন করেন তেমনই রোগীকে মানসিক শক্তি জোগান আবার প্রয়োজনে সংসারের জন্য উপার্জন করতেও বের হন। কিন্তু যদি সেই মহিলার কখনও টিবি ধরা পড়ে তখন কিন্তু তিনি নিজেই নিজের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেন, তখন তিনি কাউকে পাশে পান না।
নিম্নবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে চিন্তাটা আরও বেশি এবং সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পাওয়ার পথে বাধাও অনেক। অল্প খরচে উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। আর যাঁরা নিজে থেকে চিকিৎসা করাচ্ছেন বা যাঁদের জোর করে চিকিৎসা করানো হচ্ছে তাঁরা অনেক সময় ধৈর্যের অভাবে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করতে পারেন না, কারণ প্রায় ন'মাস ধরে চলে এই চিকিৎসা।
সামাজিক কলঙ্ক এড়াতে এবং পরিবারের উপর যাতে তাঁর রোগের জন্য কোনও রকম আর্থিক চাপ না সৃষ্টি হয় তাই একটা অপরাধ বোধ থেকে সেই রোগী, রোগের উপসর্গ কম হতে শুরু করলেই চিকিৎসা করানো বন্ধ করে দেন। তাই ভারতে টিবি রোগের সংক্রমণের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে বহু মহিলাদের রোগটা ধরাই পড়ে না বা তাঁকে তার রোগ সম্বন্ধে জানানো হয় না কিংবা কেউ কেউ আবার অর্ধেক চিকিৎসা করিয়ে মাঝ পথেই চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। ভারতে প্রতি ঘণ্টায় ১৮ জনেরও বেশি মহিলা এই রোগে মারা যান, তা ছাড়া এমন আরও অনেক মহিলা রয়েছেন, যাঁদের এই রোগে মৃত্যু হলে সেটা নথিভুক্তই করা হয় না।
যাঁদের এই রোগ অনেকটা বেড়ে গেছে অর্থাৎ যাঁদের ক্ষেত্রে মাল্টি-ড্রাগ রেসিট্যান্ট (এমডিআর) বা এক্সটেন্সিভলি ড্রাগ রেসিট্যান্ট (এক্সডিআর) এবং আরও খারাপ টোটালি ড্রাগ রেসিট্যান্ট (টিডিয়ার)- টিবিতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেই ধরণের টিবি নিরাময় করা অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ ও বেশ কঠিন। ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট টিবির তুলনায় নন-ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট টিবি সারাতে খরচ পড়ে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। এই ধরণের টিবি সারাতে যে সব কড়া ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো একজন মহিলার স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রভাব ফেলে। এর ফলে নানা পার্শ্ব ক্রিয়াও হয় যেমন- বন্ধ্যাত্ব, কানের সমস্যা ও বিভিন্ন মানসিক সমস্যা।
থাইরয়েড বেশি বেড়ে যাওয়া বা খাদ্যনালীর ঘা কিংবা ডেঙ্গির সঙ্গে যেমন কোনও সামাজিক কলঙ্ক যুক্ত থাকে না, ঠিক তেমনই টিবির সঙ্গে কোনও সামাজিক কলঙ্ক জড়িত থাকে না। ঠিক সময় ধরা পড়লে টিবি পুরোপুরি সেরে যায়। অবশ্য যদি সময় মতো ধরা পড়ে। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে আগেকার সময়ের মতো এ যুগেও এই রোগটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আতঙ্ক ও লজ্জা। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে চরক সংহিতায় এই রোগের বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এই দীর্ঘ ২০০০ বছর ধরে পৃথিবীতে যে দশটি রোগে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়ে তার অন্যতম হল টিবি।
সব টিবি রোগীই সহানুভূতি ও যত্ন চান। মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা একটু বেশি, কারণ যুগ যুগ ধরে চলে আসা মানসিকতা অনুসারে এবং তাঁদের সমাজ যে চোখে দেখে, তার ফলে তাঁদের মানসিক যন্ত্রণাও অনেক বেশি। ফলে মানসিক যন্ত্রনাটা অনেক বেশি অনূভব করেন তাঁরা। সমাজ যদি এভাবেই টিবি মহিলা টিবি রোগীদের অবহেলার চোখে দেখেন তাহলে সংকোচে ও ভয়ে অনেকেই তাদের রোগ চেপে যাবেন ও চিকিৎসা করবেন না। এর ফলে এমন সব ব্যাকটেরিয়া (সুপারবাগ) এর জন্ম হতে পারে যা মারাত্মক ধরণের টিবির জন্ম দেবে যেগুলো সরানো হয়ে উঠবে প্রায় অসম্ভব।
তাহলে ২০২৫-এর মধ্যে দেশ থেকে টিবিকে সম্পূর্ণ ভাবে মুছে ফেলার যে চিন্তাভাবনা করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সেটা স্বপ্নই থেকে যাবে। যতক্ষুন না তিনি 'বলোদিদি' বিজ্ঞাপনটির পরামর্শদাতা মহিলা, যারা নিজেরাই টিবির সঙ্গে লড়াই করে আজ সমাজ কর্মী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাদের সঙ্গে কথা না বলছেন। 'বেটি পাড়াও, বেটি বাচাও' আমাদের দেশে অনেকাংশে প্রভাব ফেলেছে। এখন পরবর্তী প্রকল্প হওয়া উচিত 'বলোদিদি'।

