আনন্দ তেলতুম্বের গ্রেপ্তারি: একজন মাওবাদী বিরোধী কী ভাবে মাওবাদী যোগে গ্রেপ্তার হন

গ্রেপ্তার হলেন দলিত শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী, কিন্তু তিনি নিজেই তো সেই যুদ্ধ জয়ের উদযাপন চাননি

 |  6-minute read |   07-02-2019
  • Total Shares

দোসরা ফেব্রুয়ারী ভোর রাত সাড়ে ৩টেয় মুম্বইয়ের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর থেকে পুণে পুলিশ দলিত শিক্ষাবিদ তথা বুদ্ধিজীবী আনন্দ তেলতুম্বেকে গ্রেফতার করে। তাঁকে যাতে গ্রেপ্তার না করা হয়, সে জন্য পুণে আদালতে গ্রেপ্তারের আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি। গ্রেপ্তারের আগের দিনই সেই আর্জি খারিজ করে দেয় আদালত।

কিন্তু এর আগে, সুপ্রিম কোর্টও নির্দেশ দিয়েছিল যে তেলতুম্বেকে ১১ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তাঁকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের রক্ষাকবচ থাকায়, গ্রেপ্তারির পর, পুণের সেই দায়রা আদালতই জানাল যে তেলতুম্বেকে বেআইনি ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং আদালত তাঁকে বাড়ি ফেরার অনুমুতি দিল।

বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ এনে পুণে পুলিশ তেলতুম্বেকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু পুণে আদালত পুলিশের এই অভিযানকে বেআইনি ঘোষণা করে দেওয়ায় আপাতত খালি হাতেই ফিরতে হল পুলিশ আধিকারিকদের।

এমন অদ্ভুত দুর্ঘটনা ইতিহাসে সচরাচর চোখে পড়ে না।

body_020719013718.jpgএক গরিব দলিত পরিবারে জন্মিয়ে ছিলেন আইআইএম গোয়ার অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বে [সৌজন্যে: ইউটিউব]

তেলতুম্বের বিরুদ্ধে আইনবিরুদ্ধ জমায়েত, রাষ্ট্র ও সমাজের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র, মানুষের মধ্যে হিংসা ছড়ানো এবং শাসকদের আক্রমণ (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার) করার ষড়যন্ত্রের মতো বিভিন্ন মারাত্মক অভিযোগ আনা হয়েছে। সাধারণত এই ধরণের অভিযোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও অভিযুক্ত সব ক্ষেত্রেই একে ওপরের বিরোধিতা করে থাকে।

যা এক্ষেত্রে খাটছে না।

কারণ, এই মামলায় রাষ্ট্রের সমস্যা মাওবাদীদের কেন্দ্র করে। ভীমা-কোরেগাঁও লড়াইয়ের ২০০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপনের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর, এলগর পরিষদ বৈঠক আয়োজিত হয়। অভিযোগ, এই বৈঠকের পিছনে মাওবাদীদের হাত ছিল।

কিন্তু অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বে, যিনি গোয়ার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টে অধ্যাপনা করেন, ঘোরতর মাওবাদী এবং বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বিরোধী। এমনকি, তিনি ভীমা করগাঁও যুদ্ধ জয়ের উদযাপনেরও বিরোধী।

সব চাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয়ে, অনুষ্ঠানের দিন তিনি অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন না।

বরঞ্চ ২০১৮ সালের দোসরা জানুয়ারী তিনি লিখেছিলেন, "পেশোয়া শাসনের সময় তাঁদের উপরে হওয়া অত্যাচারের প্রতিবাদে ভীমা-করেগাওঁ যুদ্ধে নেমেছিল মাহার সেনারা - এমন একটি বর্ণনা দিয়েছিলেন খোদ বাবাসাহেব আম্বেদকর। কিন্ত তাঁর এই বর্ননা আদতে শ্রুতিকথা। হয়ত, একটি আন্দোলনের তৈরির স্বার্থে এই ধরণের শ্রুতিকথা তৈরি করার প্রয়োজন পড়েছিল তাঁর। কিন্তু আম্বেদকরের দেওয়া এই বর্ণনার একশো বছর বাদেও যদি আমরা তাঁর সেই শ্রুতিকথাকে আঁকড়ে ধরে থাকি তা খুবই চিন্তার বিষয়। এতে দলিতদের পরিচয় সঙ্কট তৈরি হতে পারে।"

তাঁর এই অবস্থানের জন্য তিনি শুধু মারাঠি মাহারদের সমালোচনার মুখে পড়েননি। শিক্ষিত দলিতরাও তেলতুম্বেকে কটু কথা শোনাতে ছাড়েননি।

body1_020719013847.jpgদলিতদের কাছে ভীমা-করেগাঁও দিবস স্মরণীয়, কিন্তু তেলতুম্বে তা সমর্থন করেন না [ছবি: পিটিআই]

কিন্তু, তা সত্ত্বেও, রাষ্ট্র তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করে, তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর রুজু করে এবং সুপ্রিম কোর্টের রক্ষাকবচ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

তেলতুম্বের ভাই মিলিন্দ মাওবাদী নেতৃত্বের সদস্য এবং নাগরিক অধিকার রক্ষা সংস্থা সিপিডিআরের সচিব। এই তথ্যটিকে হাতিয়ার করেই রাজ্যের তরফ থেকে আনন্দকেও মাওবাদী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এলগর পরিষদের বৈঠক মিলিন্দের নেতৃত্বে হয়েছিল এবং মাওবাদীরা সেই বৈঠকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করেছিল, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু তেলতুম্বেরের কিন্তু ভীমা-করগাঁও যুদ্ধের ২০০তম বার্ষিকী উদযাপনে সায় ছিল না।

তাই শুধুমাত্র তাঁর ভাই মাওবাদী বলে এবং আদর্শগত ভাবে বর্তমান সরকারকে গদিচ্যুত করতে চান বলে তেলতুম্বেকে দায়ী করা যায় না। মূলস্রোতের রাজনীতিতেও একই পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হতেদেখা যায়।

তাঁর লেখা কিংবা কর্মকান্ডে দেখে কোথাও কখনও তেলতুম্বেকে মাও-দরদী হিসেবে মনে হয়নি। তাঁর বইতেও তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে মাওবাদীদের ধারণা ও মাওবাদী অভ্যুথানের নিন্দা করেছেন।

body2_020719013946.jpgআমাদের সংবিধান কিন্তু মানবাধিকারের কথাই বলে [সৌজন্যে: উইকিম্যাপিয়া কমন্স]

এটা ঠিক যে তিনি সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তিনি তো শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়েই কাজ করে থাকেন। মানবাধিকার রক্ষা শুধুমাত্রই মাওবাদীরাই করে না। তবে, বহু মানবাধিকার কর্মীই মাওবাদীদের সমর্থন করেন। মার্ক্সিস্টদেরও আগে, জন লক ও থমাস পেন মানবাধিকার আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

কিন্তু বর্তমান শাসকরা মানবাধিকার কর্মীদের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টিকর্তা হিসেবেই দেখতে পছন্দ করে। কিছুদিন আগেই আমনেস্টি আন্তর্জাতিক বলে একটি সংস্থার উপর আক্রমণ করা হল। বিখ্যাত সাংবাদিক আকার প্যাটেল এই সংস্থার সভাপতি। আরএসএস ও বিজেপি সকলের সমঅধিকারে বিশ্বাসী নয়। তাঁদের কোনও বুদ্ধিজীবীই কোনও মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গেই যুক্ত নয়। তা সত্ত্বেও, তাঁরা দাবি করেন যে তাঁরা সংবিধানে বিশ্বাস করেন।

দেশের আইনব্যবস্থা কিন্তু শাসকদের এই বিপরীতধর্মী অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।

আমাদের সংবিধান, এমনকি বিশ্বের সমস্ত সংবিধানই - মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে।

বিশ্বের প্রথম স্বীকৃত সংবিধানও, মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান, থমাস পেনের "দ্য রাইটস অফ ম্যান" এর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। মানবাধিকার না থাকলে গণতন্ত্রেরও কোনও জায়গা নেই।

যে কোনও মানবাধিকার কর্মীকেই সংবিধান ও দেশের শাসনব্যবস্থা মেনে কাজ করতে হয় - তেলতুম্বেও তাই করছেন।

body3_020719014101.jpgমাওবাদীরা জাতি ভেদাভেদকে গুরুত্ব দেননা বলেই মনে করেন আনন্দ তেলতুম্বে [ছবি: পিটিআই]

তাঁর জাতি যে সমাজের চোখে অচ্ছুৎ, আনন্দ তেলতুম্বের কাছে এটি একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিষয়।

তিনি জানেন যে মাওবাদীরা এখনও জাত পাত কিংবা অচ্ছুৎ সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে হতে পারে বলে মনে করেননা। তাঁদের কাছে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের হাতে আক্রান্ত মানেই মনোনবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে।

সংবিধানের জনক আম্বেদকরকে তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। তাঁদের নেতা মার্ক্স ও মাও।

কিন্তু আনন্দ তেলতুম্বে কিন্তু নিজের মতো করেই আম্বেদকরকে পুজো করেন। এক গরিব দলিত পরিবারে জন্ম হওয়া তাঁকেও একটা সময়ে অচ্ছুৎ হওয়ার যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছিল। এর ফলেই হয়ত তিনি মানবাধিকার কর্মী হয়ে উঠেছেন।

একদিকে দলিত পরিবারের সদস্য ও আম্বেদকর ভক্ত, অন্যদিকে আইআইটি বা আইআইএমের মতো সংস্থার অধ্যাপক - এমন ধরণের খুব বেশি চরিত্রের কথা আমার জানা নেই।

তেলতুম্বের এমন প্রচুর মতামত রয়েছে যার সঙ্গে আমি একমত নই। কিন্তু এই মামলায় আমি জীবনের শেষ দিন অবধি তেলতুম্বেকে সমর্থন করে যাব।

এই মামলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চক্রান্তে তেলতুম্বেকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ, বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি বেশ জনপ্রিয়, তাঁর প্রচুর লেখা রয়েছে এবং তিনি যে মাওবাদী আন্দোলনে বিশ্বাসী নয় তাও সকলেরই জানা।

দেশের বিচারব্যবস্থার উপরই দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নির্ভরশীল। আশা করি, দেশের সেই বিচারব্যবস্থা আনন্দ তেলতুম্বের বিরুদ্ধে কোনও রকম অন্যায় হতে দেবে না এবং তিনি আবার শান্তিতে শিক্ষা দিতে ও লিখতে পারবেন।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

KANCHA ILAIAH SHEPHERD KANCHA ILAIAH SHEPHERD

The author is political theorist and social activist.

Comment