প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কারখানা থেকে অস্ত্র পাচার হয়ে মাওবাদীদের হাতে, খরচ পড়ছে অর্ধেক
চিন বা বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর থেকেও এই সূত্র বেশি ভয়াবহ, বেশি আতঙ্কের
- Total Shares
পশ্চিমবঙ্গ বা ছত্তিসগড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যে ডেরা বেঁধে থাকা মাওবাদীদের হাতে এত উন্নতমানের অস্ত্র আসে কী ভাবে? এ নিয়ে তদন্ত বা গবেষণার কোনও শেষ নেই। বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ থেকে শুরু করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) এমনকি দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা গোয়েন্দা বিভাগ রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র) এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিভিন্ন সময় হন্যে হয়ে তদন্ত করেছে। আর তাদের তদন্ত রিপোর্টে কখনও বলা হয়েছে যে মাওবাদীরা চিন থেকে অস্ত্র আমদানি করে, আবার কখনও জানানো হয়েছে যে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো মাওবাদীদের অস্ত্র সরবারহ করে।
কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স রবিবার রাতে বাবুঘাটে অভিযান চালিয়ে বিহারের দুই কুখ্যাত অস্ত্র পাচারকারী অজয়কুমার পাণ্ডে ওরফে গুড্ডু পণ্ডিত ও জয়শঙ্কর পাণ্ডেকে গ্রেপ্তার করেছে। এই গ্রেপ্তারের পর মাওবাদীদের অস্ত্র সংগ্রহের একটি নতুন সূত্র আবিষ্কার হল। চিন বা বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর থেকেও এই সূত্র বেশি ভয়াবহ, বেশি আতঙ্কের।
বিহারের দুই অস্ত্র পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে কী তথ্য উঠে এল তদন্তকারী অফিসারদের হাতে?
খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের অস্ত্র কারখানা থেকে অস্ত্র পৌঁছায় মাওবাদীদের হাতে
মাওবাদী অস্ত্রের নতুন সূত্র
গুড্ডু পণ্ডিত ও জয়শঙ্কর পাণ্ডে ছাড়াও পুলিশের জালে ধরা পড়ে নোয়াপাড়ার বাসিন্দা উমেশ রায় ওরফে ভোলা ও কার্তিক সাউ। উমেশ ও কার্তিক অস্ত্রের যন্ত্রাংশ পাচার করতে যাচ্ছিল গুড্ডু ও জয়শঙ্করকে। এরপর তদন্তকারী অফিসারদের জেরার মুখে ধৃতরা জানায় যে ইছাপুরের নোয়াপাড়ার গোয়ালাপাড়ার আর এন চ্যাটার্জি স্ট্রিটের সুখদা মুর্মু ওরফে মুনমুন ও ইছাপুরের নবাবগঞ্জের মাঝেরপাড়ার সুশান্ত বসু তাদের অস্ত্র পাচারে সাহায্য করেছিল। সুশান্ত হল ইচ্ছাপুর অস্ত্র কারখানার জুনিয়র ওয়ার্কস ম্যানেজার এবং সুখদা হল মেকানিক।
এখন প্রশ্ন হল সরকারি অস্ত্র কারখানা থেকে পাচার হওয়া এই যন্ত্রাংশগুলো যাচ্ছিল কোথায়? বিহার থেকে আসা পাচারকারীদের লিঙ্কম্যানরা এই অস্ত্রের যন্ত্রাংশ নিয়ে প্রথমে বিহারে পাড়ি দিত। এরপর বিহারে যন্ত্রাংশগুলি জোড়া লাগিয়ে গোটা অস্ত্র তুলে দেওয়া হত মাওবাদীদের ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন গুলোর হাতে। এমনকী, নেপাল ও উত্তর-পূর্বের জঙ্গিরাও তার ভাগ পেত। রবিবার রাতে বাবুঘাট থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া অস্ত্রগুলোর বরাত এসেছিল বিহারের মাওবাদী ও আরও দুটি জঙ্গি সংগঠন - বাহুবলী ও তৃতীয় প্রস্তুতি কমিটির কাছ থেকে।
তার মানে শুধু চিন বা বাংলাদেশি জঙ্গিসংগঠনগুলো থেকে নয়, খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের অস্ত্র কারখানা থেকে অস্ত্র পৌঁছায় মাওবাদীদের হাতে।
পিপল'স লিবারেশন আর্মি থেকে অস্ত্র ক্রয় করেছিল মাওবাদীরা
পুরোনো সূত্র
২০১২ সালে মাওবাদী সংক্রান্ত একটি মামলার চার্জশিট পেশ করেছিল এনআইএ। সেই চার্জশিটে বলা হয়েছিল যে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে মণিপুরের সশস্ত্র অভ্যুত্থানকারী সংগঠন পিপল'স লিবারেশন আর্মি থেকে বিপুল পরিমাণ ও অস্ত্র ও উন্নতমানের যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্রয় করেছিল মাওবাদীরা। ক্রয় করা সামগ্রী মাওবাদীদের হাতে পৌঁছাবার আগেই তিনটে কিস্তিতে ৩৩ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। চিন থেকে আমদানি করে এই বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মাওবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছিল পিআইএল, যা মিয়ানমার হয়ে গুয়াহাটি ঘুরে কলকাতায় এসেছিল। কলকাতা থেকে তা মাওবাদীদের বিভিন্ন ডেরায় সরবারহ করা হয়।
এনআইএ এই সূত্র জানতে পারল কী ভাবে? এই মামলায় মাওবাদী নেতা পল্লব বরবরাহ ও ইন্দ্রনীল চন্দ এবং পিএলএর আভ্যন্তরীণ বিষয়ক প্রধান আসেম ইবতোম্বি সিংকে যথাক্রমে অসম, ওড়িশা ও কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার করেছিল এনআইএ। ধৃতদের জেরা করে এই তথ্য উঠে এসেছিল। চার্জশিটে এনআইএ জানিয়েছিল মাওবাদীরা মূলত লোক মাধ্যমে কাজ করতে পছন্দ করে তাই তাদের তরফ থেকে কোনও তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। উল্টোদিকে, পিআইএ কিন্তু যথেষ্ট টেক-স্যাভি। তাঁদের নেতাদের সঙ্গে তাঁদের মিয়ানমারের সংঠনের নেতাদের (পড়ুন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের) নেতাদের বেশ কিছু ইমেল চালাচালি হয়েছে যাতে স্পষ্ট যে চিন থেকে অস্ত্র আমদানি করে সেই অস্ত্র মাওবাদীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
শুধুমাত্র পিআইএ নয়, তদন্তকারী সংস্থাগুলো মনে করে যে থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোর অস্ত্র পাচারকারীদের থেকে সরাসরি অস্ত্র আমদানি করত মাওবাদীরা।
২০১২ সালে কলকাতার বন্দর এলাকার মেটিয়াব্রুজে একটি বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং অজানা কারণে কলকাতা পুলিশ দ্রুত এই ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিতে উদ্যত হয়। পুলিশের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে রাজনৈতিক হিংসা ছড়াবার জন্য ওই বাড়িটিতে বোমা মজুদ করা হচ্ছিল যার থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে। এর দু'বছরের মাথায় বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ ঘটে যার তদন্তভার যায় এনআইএর হাতে। এনআইএর তদন্তে উঠে আসে খাগড়াগড় ও মেটিয়াব্রুজ কাণ্ডের যোগসূত্র।
তদন্ত চলাকালীন এনআইএ দাবি করে যে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলো থেকে মাওবাদীরা অস্ত্র জোগাড় করত তার ইঙ্গিত তারা পেয়েছে। যদিও মাওবাদী বিশেষজ্ঞরা মানতে নারাজ যে বাংলাদেশের জঙ্গিসংগঠন গুলোর সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে মাওবাদীরা।
এনআইএ দাবি করে যে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলোর থেকে মাওবাদীরা অস্ত্র জোগাড় করত
নতুন সূত্র কতটা বিপজ্জনক
সরকারি অস্ত্র কারখানা থেকে যদি অস্ত্র মাওবাদীদের হাতে পৌঁছে যায় তা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক প্রবণতা হিসেবেই ধরে নিতে হবে। প্রথমত প্রশ্ন উঠবে সরকারের অস্ত্র কারখানার সুরক্ষা ব্যবস্থার উপর। দামি দামি অস্ত্রের যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাওয়া মানে সরকারি অর্থেরও অপচয়। তদন্তে জানানো হচ্ছে যে এই চুরি গত বছর পাঁচেক ধরে হয়ে আসছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারখানার আধিকারিকরা তা এতদিন আঁচও করতে পারেননি।
কথায় আছে কারুর সর্বনাশ তো কারও পৌষমাস। এই সূত্র থেকে অস্ত্র মজুদ করতে পারলে মাওবাদীদের প্রভূত সুবিধা। কারণ বিদেশ থেকে অস্ত্র আনতে যা ব্যয় হয় তার অর্ধেকেরও কম খরচে এই সরকারি কারখানা থেকে পাচার হওয়া অস্ত্র কিনতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, একই টাকা খরচ করে অনেক বেশি অস্ত্র মজুদ করে নিতে পারবে মাওবাদীরা। বিষয়টি যথেষ্ট ভয়াবহ।
হাটে হাড়ি ভাঙার পর এবার নিশ্চয়ই কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হবে। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে যে অস্ত্র পাচার হয়ে গেল তার কী হবে?
'সারফারোস' সিনেমায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করবার পর এক পুলিশ অফিসার বলেছিলেন, "আমাদের দেশের শত্রুরা খুবই ভাগ্যবান। যুদ্ধ করতে তাঁরা লোক পাঠায় না শুধু অস্ত্র পাঠায়।" বাস্তবে শত্রুদের ভাগ্য কিন্তু আরও বড়, তাদের অস্ত্রও পাঠাতে হয় না। সরকারি কারখানা থেকে তা বিভিন্ন সংগঠনের হাতে পৌঁছে যায়।

