ডিসেম্বরে বাংলাদেশে নির্বাচন, তার আগে জেল থেকে মুক্তি পাবেন না খালেদা জিয়া

বিএনপি-কে নির্বাচনে যোগ দিতে হবে, না হলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে

 |  5-minute read |   29-04-2018
  • Total Shares

যদি কোনও দৈব ঘটনা না ঘটে, হঠাৎ আসা কোনও প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড় বাংলাদেশের রাজনীতিকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়ার ক্ষমতা না রাখে, তা হলে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যত কী?

জবাব মিলবে একটাই, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে সোয়া দু’বার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ-ক্ষেত্র বিশেষ শত্রু। বিএনপির এই এবড়োখেবড়ো অবস্থায় আওয়ামী লীগ কি স্বস্তিতে? না, মোটেও না। ভবিষ্যত রাজনৈতিক ধারা নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগও। কেন আওয়ামী শিবিরের চিন্তা? তার কারন ভিন্ন।

এক, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। দুই, গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য সংসদে কার্যকর একটি বিরোধী দলের উপস্থিতি। বিএনপি একেবারে এলোমেলো হয়ে পড়লে সহসা এ দুটো পূরন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। যদিও বিএনপিকে বাইরে রেখে একটি মোটামুটি শক্ত বিরোধী দল গড়ার চেষ্টা সরকারের তরফ থেকেই হচ্ছে এমন বেশ কিছু খবর চাউর আছে রাজনীতির মহলে।

body1_042918123129.jpgবিএনপির চেয়ারপার্সন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পত্নী খালেদা জিয়া দুনীর্তির মামলায় এখন কারাগারে

পাঁচ বছর কারাবাসের দণ্ড হয়েছে তার। উচ্চ আদালতে এ মামলায় জামিনও হয়েছিল। তবে মুক্তি পাননি, আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। খালেদা জিয়ার সহসা জেল মুক্তির সম্ভাবনা দেখছেন না রাজনীতির বিশ্লেষকরা। মোট ১৯টি মামলার আসামী তিনি। এগুলোর মধ্যে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা মামলা এবং আরও দু’টি গুরুতর দুর্নীতির মামলা। তিনটি মামলা রায়ের অপেক্ষায়। আইনজীবীরা বলছেন, এই মামলাতেও তার দণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বাংলাদেশের দুর্নীতিদমন আইন সেটাই বলে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও এখন স্বীকার করছেন, তাঁরা ভুল করেছেন। ২০০৭ সালের পর থেকে মামলাগুলো আদালতে ঝুলছে। তাঁরা গা করেননি, পাত্তা দেননি। বরং খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা অনাহুত আদালতে আবেদন করে সময় নিয়েছেন। এখন দোরগোড়ায় নির্বাচন। চলতি বছর ডিসেম্বরেই বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। সময় আছে মাত্র আট মাস। কোনও মামলােতই খালেদা জিয়া জামিন নেননি। এখন মামলাগুলোতে জামিন নিতে গিয়ে যদি প্রতিটি মামলায় এক মাস করেও সময় লাগে তা হলে ১৯টি মামলায় জামিন পেতে সময়ের প্রয়োজন ১৯ মাস, অথচ নির্বাচনের বাকী আছে মাত্র আট মাস। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্ত হওয়ার কোনও সম্ভবনা দেখছেন না বিএনপির নেতারাও। বাংলাদেশের আইন অনুসারে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। আইন-আদালতের বাইরে খালেদা জিয়ার মুক্ত হওয়ার আরেকটি সম্ভাবনার দিক ছিল গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। বিএনপি তা পারেননি। কোনও আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি তারা।

বিএনপির রাজনীতি জিয়া পরিবার কেন্দ্রিক। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তী রাজনৈতিক পটভূমিতে সাবেক সেনানায়ক জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধিতাকে পুঁজি করে একটি রাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তার সৃষ্ট রাজনৈতিক ধারায় সহজেই সামিল হন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী।

body2_042918123248.jpgআদালত চত্বরে বিএনপি সমর্থকদের বিক্ষোভ

এ ছাড়াও রাজনীতির আরেকটি ধারা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মিলিত হন তারা হলেন একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া চৈনিক অনুসারী সমাজতন্ত্রীদের একটি অংশ। তবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জিয়াউর রহমানের মূল চালিকা শক্তি ছিল একাত্তরে পাকিস্তানে আটকে পড়া সেনা কর্মকর্তারা, যারা দেশে ফিরে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এদের মধ্যে আবার ১৫৬ জন যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশে অবস্থান করে পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে,বাঙালিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, যুদ্ধাপরাধ করেছে। এরা ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পন করে চুক্তি অনুসারে ভারত হয়ে পাকিস্তান গিয়ে আবার আটকে পড়া বাঙালি সেনা হিসেবে দেশে ফিরে চাকরিতে বহাল হয়।

তাদের অন্যতম ছিলেন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল আমজাদ। এঁদের কারণে জিয়াউর রহমান একদিকে সেনাবাহিনীতে আরেক দিকে রাজনীতিতে একটি ধারা দাঁড় করান। জিয়ার মৃত্যুর পর এদের প্রধান আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে জিয়া পরিবার। খালেদা জিয়ার পর জিয়া পরিবারের রাজনীতির হাল ধরার কথা তার সন্তানদের। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন। বড় ছেলে তারেক রহমান লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে। দেশে একটি দুর্নীতির মামলায় তিনি দণ্ডিত।

উচ্চ আদালতে আপিল করতে হলে তাকে দেশে ফিরতে হবে। আবার ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড ছুড়ে তাঁকে হত্যা পরিকল্পনার মূল হোতা তারেক রহমানের মামলাটি শেষের পথে, রায়ের অপেক্ষায়। এই গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনা রক্ষা পেলেও, আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। আবার ইতিমধ্যে তারেক রহমান বাংলাদেশী পাসপোর্ট সমর্পন করে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,তারেক রহমান আর বাংলাদেশের নাগরিক নন। আগামী নির্বাচনে তারেক রহমানের অংশ গ্রহণও অনিশ্চিত। শোনা যাচ্ছিল, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমান দেশে ফিরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং তিনি বিএনপির হাল ধরবেন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জোবায়দা রহমান বাংলাদেশের ভোটারই হননি। তা হলে আগামী নির্বাচনে জিয়া পরিবারের কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। মুক্তাবস্থায় থেকে দল পরিচালনাও করতে পারছেন না। তা হলে কি হবে বিএনপির ভবিষ্যৎ? এ নিয়ে আলোচনা আছে খোদ বিএনপির ভিতরেই।

body3_042918123314.jpgএরশাদের জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলেও মানুষের কাছে কোনও গ্রহণযোগ্যতাই নেই তাদের

তা হলে কি ২০১৪ সালের মত বিএনপি নির্বাচন বর্জন করবে? রাজনীতির সাধারণ কর্মীদের কাছে এমন আলোচনা থাকলেও সেটাও বোধ হয় সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপিকে নির্বাচনে আসতেই হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের আইন অনুসারে কোনও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল পরপর দু’টি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। এখন বিএনপি কি নিবন্ধন বাতিল হওয়ার ঝুঁকি নেবে? হয়ত নেবে না। যদি না নেয় তা হলে দলটির নেতৃত্ব কার হাতে থাকবেয এমনিতেই দলটি অভ্যন্তরীণ বিরোধে জর্জরিত। বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধী সেই জিগির আর এখন খুব একটা কাজে লাগছে না। বিএনপির ভিতরের শক্তি জামায়াত ছিন্নভিন্ন, মাথা তুলে দাড়াঁতে পারছে না। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদকে বারবার উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেও তেমন একটা লাভ করতে পারেনি জামায়াত-বিএনপি।

তা হলে কী ভাবে হচ্ছে আগামী নির্বাচন? নির্বাচনে বিজয়ের নিশ্চয়তা থাকার পরও চিন্তার রেখা আওয়ামী লীগের কপালে। প্রগতিশীল ধর্ম নিরপেক্ষ দলগুলো এগিয়ে আসতে পারছে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের জাতীয় পাটি বর্তমান সংসদে বিরোধী দল-তবে বিরোধী দল হিসেবে মানুষের কাছে কোনও গ্রহণযোগ্যতাই নেই তাদের। আগামীতেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। আবার বিএনপি-জামায়াত জোট যদি অলৌকিক কোনও পথে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে, প্রলয় ঘটবে বাংলাদেশে। ড.কামাল হোসেন, বি.চৌধুরীরা একটি জোট গড়ার চেষ্টা করছেন। সেখানে অন্য সমস্যা। ড.কামাল হোসেনের প্রতি আস্থার সঙ্কট আছে। তিনি বলেন, করেন না। সাধারণ মানুষের মাঝে ধারনা আছে এরা অন্যর শক্তির উপর নির্ভর করে আছেন। ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তাতে ইন্ধন ছিল কয়েকজন রাজনীতিকের। এঁরা পর্দার আড়ালে খেলতে ভালোবাসেন। তাঁদের কেউ কেউ আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। নানা আলোচনা আছে রাজনীতির মাঠে বলাবলি আছে বিএনপি ভাঙছে। বিএনপির একটি অংশ জিয়া পরিবার ত্যাগ করে এরশাদের সঙ্গে জোট গড়ে সংসদে বিরোধী দল হয়েছে।

বিএনপি অনিশ্চিত-তা হলে কী? চিন্তা এখন ক্ষমতাসীনদের বেশি। হয়ত সামান্য সময়ের ব্যবধান স্পষ্ট হচ্ছে রাজনীতি। এখন যদিও সক্রিয় নানা মহল পর্দার বাইরে সক্রিয়-আড়ালেও সক্রিয়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

LAYEK UZZAMAN LAYEK UZZAMAN

Journalist and Political commentator in Bangladesh.

Comment