বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে সাম্প্রদায়িকতা, নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তান

পাকিস্তানের তিন স্লোগান: ইসলাম ধ্বংস হল, ভারত কাশ্মীর নিয়ে গেল, হিন্দু হামারা দুষমন হ্যায়

 |  5-minute read |   05-05-2018
  • Total Shares

নিরন্তর চেষ্টা শুরু হয়েছে সেই সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় থেকে। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি জন্ম নেওয়ার পর থেকেই চেষ্টা চলছিল কী ভাবে বাঙালি মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক করে তোলা যায়, বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশ অংশে। পারা যায়নি-বাঙালি সংস্কৃতির গভীর মেলবন্ধনের কারণে। তবে ক্ষতিটা তারা বেশ করতে পেরেছে এবং পাকিস্তানিদের সেই চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে, তারা চেষ্টার ত্রুটি করছে না।

ইতিহাসের কিছু খোঁজ যাঁরা রাখেন নিশ্চয়ই তাঁদের জানা আছে, একজন সাবেক ভারতীয় রাজনীতিকের নাম: চৌধুরী খালেকুজ্জামান, জন্ম তার লখনউতে। একদা লখনউয়ের পুরসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সংসদীয় দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৩৬ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করে যোগদেন মুসলিম লিগে। দ্রুত মুসলিম লীগের নীতি নির্ধারক হয়ে ওঠেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর হন। বাংলাদেশে সম্প্রদায়িকতার মাঝে কেন এই প্রয়াত রাজনীতিকের কথা টানলাম? বিষয়টি হয়তো একেবারেই অপ্রাসাঙ্গিক।

তবে আমার কাছে কেন যেন চৌধুরী খালেকুজ্জামানের বিষয়টি প্রাসাঙ্গিক মনে হয়। হয়ত অনেকেই আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। তবুও বলছি, বর্তমানে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাই কমিশনার রফিউজ্জামানের পরিচিতি সম্পর্কে যাদের জানা আছে, তাঁরা হয়তো বিষয়টি কিছুটা অনুভব করতে পারবেন। এই রফিউজ্জামান হচ্ছেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামানের নাতির ছেলে। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর ভারতীয় অনেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসলেও চৌধুরী খালেকুজ্জামান আবাস গড়েন পশ্চিম পাকিস্তানে।

bangladesh_body_050518124510.jpgবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ

চৌধুরী খালেকুজ্জামান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর থাকার সময়ে তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের সে সময়কার মুসলিম লিগের নেতা ও তাঁদের পরিবারগুলোর সঙ্গে। অনেকেই মনে করেন, সেই সম্পর্ক ঝালাই, সুরক্ষা ও ভাবের আদান প্রদান রক্ষা করতে পাকিস্তান সরকার সুচিন্তিত ভাবে রফিউজ্জামানকে হাই কমিশনার হিসেবে ঢাকায় নিয়োগ দিয়েছেন। চমৎকার বাংলা ভাষা জানা রফিউজ্জামান ঢাকায় থাকতেই ঘটল রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা। রফিউজ্জামান হাই কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগেও এখানে হাইকমিশনে চাকরি করেছেন। তৎকালীন মুসলিম লিগ পরিবারগুলোর সন্তানদের সঙ্গে তার যোগাযোগের বিষয়টিও সবার জানা। রফিউজ্জামান বাংলাদেশে সম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছেন, আমি তা বলছি না। শুধু চেনা-জানার ও যোগসূত্রের সুবিধার কথাটা বলছি।

১৯৭৪ সালের জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে একজন পিরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে ধর্মহীন ভুট্টোর একজন পিরের সঙ্গে দেখা করার যৌক্তিকতা সে সময়ে কেউ খুঁজে পায়নি। পরবর্তীকালে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনী দলের নেতা কর্নেল ফারুক একাধিকবার সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে একজন পিরের কথায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভুট্টো ক’জন রাজনীতিকের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন।

ভুট্টোর মৃত্যুর পর তাঁর ব্যাক্তিগত গ্রন্থাগার ঘেঁটে ব্রিটিশ সাংবাদিক উলপট ‘জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান ’ নামে একখানা বই লিখেছেন। সে বইয়ে উল্লেখ আছে, এক সময়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চৈনিক পন্থী সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী বাম নেতা কমরেড আবদুল হক বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে অর্থ ও অস্ত্র চেয়ে জুলফিকর আলি ভুট্টোর কাছে চিঠি লেখেন এবং ভুট্টো তাঁর ব্যাক্তিগত সহকারিকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১৯৭৪ সালে ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে তাঁর পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার সুযোগ না পেলে হয়তো এ ধরনের ঘটনা নাও ঘটতে পারত।

বাংলাদেশকে ঘিরে অতি সম্প্রতিকালের সবচে বড় ঘটনা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। দশ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ। রোহিঙ্গাদের সাহায্য সহায়াতর নামে তৎপর দেশী-বিদেশি অনেকগুলো সাহায্য সংস্থা। তাদের মধ্যে কারা সঠিক কারা উগ্রতা ছড়ায়, এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে তা বুঝে নেওয়া মুশকিল। বাধা দেয়াও বিপদ, কারণ বিষয়টির সঙ্গে মানবিকতা জড়িত। কঠোর হতে গেলে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভিন্ন বার্তা পৌঁছে দেয়া হবে।

mujib_body1_050518124625.jpgশেখ মুজিবুর রহমান

হঠাৎ কেন বাংলাদেশে এই রোহিঙ্গা ঢল? নেপথ্যে কারা, উদ্দেশ্য কী? ধীরে ধীরে অনেক কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে যারা রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের অনেকেই এখন বলছেন, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলতে সুকৌশলে রোহিঙ্গা ইস্যু তৈরি করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, বেপরোয়া ভাবে রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে আসতে থাকলে নিসন্দেহে শেখ হাসিনার সরকার তাদের গ্রহণ করবে না, অনুপ্রবেশে বাধা দেবে। শেখ হাসিনা বাধা দিলেই মুসলিম চেতনা জাগ্রত করে শেখ হাসিনাকে মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে মাঠে নামানো হবে এবং এটাই হবে খালেদা জিয়ার নির্বাচনী জয়ের প্রধান ইস্যু, যেমন করে এক সময়ে জিয়াউর রহমান ভারত বিদ্বেষ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন।

আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামের একটি সংগঠন আছে রোহিঙ্গাদের। তারা স্বাধীন রোহিঙ্গা রাজ্য দাবি করে। আনুষ্ঠানিক ভাবে আরসা গঠনের আগে তারা ফেইথ মুভমেন্ট নামে প্রচরানা চালাত। এই আরসার মূল নেতা আতাউল্লার জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে। তাঁর পিতা আরাকান থেকে করাচিতে যান।

পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ট লোক হিসেবে পরিচিত আতউল্লা পাকিস্তান থেকে চলে যান সৌদি আরবে। তারপর হঠাৎ দেখা যায় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে মিয়ানমারের সেনা চৌকিতে হামলা করে ২৪ জন মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশকে হত্যা করে। অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে যে সকল নিরাপরাধ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ভিটেমাটি ছেড়ে ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, এই আতাউল্লা বা আরসার নামও তারা শোনেনি। মিয়ানমারে এক সময়ে রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে জড়িত ছিলেন এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এমন একজন আমাকে বলেছেন, আতাউল্লার সেনা ছাউনিতে হামলার ঘটনাটাই একটি গভীর ষড়যন্ত্র।

mujhi_body2_050518124720.jpgবাংলাদেশকে ঘিরে অতি সম্প্রতিকালের সবচে বড় ঘটনা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ

দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে এখন ধর্মীয় উগ্রতা জাগছে। আসলে রাজনীতি এবং সমাজজীবন থেকে প্রকৃত আদর্শ হারিয়ে গেলে তা পূরণ করতে এক শ্রেণীর লোক ধর্মকে রাজনীতির হাতির হিসেবে ব্যবহার করে। এতে সবচে বড় সুবিধে সাধারণ মানুষকে বিনা প্রশ্নে শাসন করা যায়। যে রাষ্ট্রগুলো নিজস্ব নৈতিকতা হারিয়েছে তারা কেবল ধর্মকে বা ধর্মীয় উগ্রতাকে বেছে নিয়েছে। এ সকল রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ধর্মীয় উগ্রতার শাসনকে বৈধ করতে দুনিয়ার দেশে দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়াতে বিপুল পরিমান অর্থকড়ি খরচ করে। তাদের মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্র পাকিস্তান। এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি তারা আজো মানেনি।

বাংলাদেশ যাতে এগোতে না পারে, এখানে সম্প্রদায়িকতা লেগে থাকে, মৌলবাদের উত্থান ঘটে নিরন্তর ভাবে পাকিস্তান সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ৭১ বছর পেরিয়ে গেলেও জন্মলগ্নের সেই তিন শ্লোগান এক) ইসলাম ধ্বংস হল, দুই) ভারত কাশ্মীর নিয়ে গেল, তিন) হিন্দু হামারা দুষমন হ্যায় -ধারন করেই চলেছে। দেশের মানুষের কী অবস্থা, কী তাদের জীবনমান, দেশে গণতন্ত্রের কী অবস্থা তা নিয়ে কোনও কথা নেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর।

ভারতে হিন্দুত্ববাদের সাময়িক উত্থানের পর পাকিস্তানীরা মিয়ানমারে বৌদ্ধত্ববাদকে জাগিয়ে তুলে বাংলাদেশে মুসলিম জাগরণ সৃষ্টি করতে চায়, এ জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ নিয়ে মাঠে নেমেছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা, এ সব কথা এখন বাংলাদেশের শিশু পর্যন্ত জানে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

LAYEK UZZAMAN LAYEK UZZAMAN

Journalist and Political commentator in Bangladesh.

Comment