খেলোয়াড়দের কি রাজনীতির ময়দানে যাওয়া উচিত? শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক

শুধু মাশরাফি নন, আজহার থেকে ইমরান, বেবেতো-কাসপারভরাও রাজনীতি করেছেন

 |  7-minute read |   13-11-2018
  • Total Shares

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর। চলছে দলীয় ভাবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও দাখিলের প্রক্রিয়া। এরই মাঝে খেলার মাঠ থেকে সরাসরি রাজনীতির মাঠে হাজির হয়েছেন বাংলাদেশে জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্তজা। পশ্চিমের জেলা নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচনের লক্ষ্যে রববার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন তিনি। এর আগে তিনি গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোয়া নেন। চারদিকে কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল- রাজনীতিতে নাম লেখাতে চলেছেন ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।

সেই জল্পনা-কল্পনাই সত্য হল। খেলার মাঠের এই নায়ক এবার সরাসরি পা বাড়ালেন রাজনীতির মাঠে। শুরু করলেন বর্ণাঢ্য জীবনের নতুন এক ইনিংস। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নড়াইল-২ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান মাশরাফি। নির্বাচিত হলে নিজ জেলা নড়াইলকে সুন্দর ও আধুনিক করে গড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন মাশরাফি। এর আগেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে খেলোয়াড়দের যোগদান হয়েছে। কিন্তু তারা রাজনীতিতে এসেছেন অবসর গ্রহণের পর। কিন্তু মাশরাফি যখন রাজনীতিতে এলেন তখন তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়ক। স্বাভাবিক ভাবেই আলোচনা একটু বেশিই।

মাশরাফি বিন মুর্তজা এরই মধ্যে খেলাধুলার পাশাপাশি নিজ এলাকায় জনকল্যাণমূলক কাজে জড়িয়েছেন। গত বছর তিনি গড়ে তোলেন 'নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন' নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। দুঃস্থ মানুষকে আর্থিক সাহায্য, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি-বীজ বিতরণ, সোলার প্যানেল বিতরণ, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে এই ফাউন্ডেশন। এখন প্রশ্ন এসেছে তবে কি আগেই রাজনীতির প্রস্তুতি নামার প্রস্তুতি ছিল মাশরাফির?

body3_111318051500.jpgজাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি মোর্তাজা [ছবি: এএফপি]

রাজনীতির মাঠে যেসব খেলোয়াড়

ইমরান খান: এক সময় পাকিস্তান ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ইমরান খান। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে এনে দিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ। তার ২৬ বছর বাদে ইমরান খান আবার পাকিস্তানের নেতৃত্বে, এবার আর কাঁধে ১১ জনকে সামলানোর ভার নয়। কাঁধে নিলেন দেশটির ২০ কোটি মানুষের ভার। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। ইমরান খানের মতো আরও অনেক তারকা খেলোয়াড় থেকে রাজনীতির ময়দান দাপাচ্ছেন।

মনসুর আলী খান পটৌদি: সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক পটৌদিকে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক বলে ভাবা হয়। মনসুর আলী খান ১৯৯১ সালে কংগ্রেস দলের প্রতীকে ভোপাল থেকে সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে হেরে যাওয়ায় রাজনীতির ভবিষ্যৎ সেখানেই শেষ হয় নবাব সাহেবের।

নভজোৎ সিং সিধু: ইদানীং টিভিতেই বেশি চমক দেখালেও সাবেক ভারতীয় ওপেনারের ক্যারিয়ারটা জমজমাট ছিল। ১৯ বছরের খেলোয়াড়জীবন শেষে ২০০৪ সালে বিজেপিতে যোগ দেন। বিজেপির হয়ে অমৃতসর থেকে সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন সিধু। ২০১৬ সালে পঞ্জাব থেকে রাজ্যসভায় তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয় কিন্তু সিধু সেবার দল থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৭ সালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে অমৃতসর থেকেই আবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন সিধু।

বিনোদ কাম্বলি: শচীন তেন্ডুলকারের স্কুলের বন্ধুর ক্রিকেটজীবন অকালেই শেষ হয়েছিল। অভিনয়ে কিছুদিন সময় পার করে পরে রাজনীতিকেই আশ্রয় মেনেছেন কাম্বলি। লোক ভারতীতে যোগ দেওয়া কাম্বলিকে দলের সহসভাপতি করা হয়। ২০০৯ সালের বিধানসভা নির্বাচনে লোক ভারতীর হয়ে মুম্বাইয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন কাম্বলি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মতোই রাজনীতিতেও অনুজ্জ্বল কাম্বলি নির্বাচনে হেরেছিলেন।

মহম্মদ আজহারউদ্দিন: ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে ২০০০ সালে খেলোয়াড়জীবন শেষ হওয়ার আগে আজহার ৪৭টি টেস্টে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৯ সালে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন আজহারউদ্দিন। উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদ থেকে সাধারণ নির্বাচনে লড়ে নিয়ে সে বছরই সাংসদ হন আজহারউদ্দিন।

রোমারিও: ব্রাজিলের অনেক তরুণ এখনো রোমারিওর মতো হতে চায়। এমন আশা কেউ ব্যক্ত করলে পরিষ্কার করে শুনে নেওয়া ভালো। তিনি রোমারিওর মতো ফুটবলার হতে চান নাকি রাজনীতিবিদ। নাকি ফুটবলার, রাজনীতিবিদ দুটোই হতে চান তিনি। ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া ফুটবলার রোমারিও দেশটির গভর্নর হওয়ার দৌড়ে আছেন। এর আগে দু'বার রিও ডি জেনিরোর সিনেটর হয়েছেন তিনি।

 body_111318051636.jpg

body1_111318051648.jpg

body2_111318051701.jpgখেলার পর রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করেছেন আজহার, সিধু, রণতুঙ্গার মতো ক্রীড়াবিদরা

বেবেতো: ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলজয়ী ব্রাজিল দলে ছিলেন বেবেতো। সেবার দলের হয়ে তিন গোল করেন তিনি। এরপর ১৯৯৮ বিশ্বকাপে আবার ব্রাজিল ফাইনালে ওঠে। ফ্রান্সের কাছে হারলেও ১৯৯৮ বিশ্বকাপে নিজের নামের পাশে তিন গোল লেখেন তিনি। বর্তমানে বেবেতো ব্রাজিলের সংসদের নিম্ন সভাকক্ষের সদস্য। নামতে চান সেনেটর হওয়ার লড়াইয়ে।

অর্জুনা রণতুঙ্গা: ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন রণতুঙ্গা। এরপর রাজনীতিতে নামেন। বর্তমানে তিনি দেশটির জাহাজ ও জল পরিবহণমন্ত্রী।

সনৎ জয়সূর্য: শ্রীলঙ্কার হয়ে মাঠ কাঁপানো ব্যাটসম্যান সনৎ জয়সূর্ষ রাজনীতির মাঠও কাঁপিয়েছেন। ২০১০ সালে ক্রিকেটার থাকা অবস্থায় দেশটির সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। মাতারা থেকে শ্রীলঙ্কার সংসাদও নির্বাচিত হন। মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। মাতারার আসন থেকে তিনি রেকর্ড ভোটে নির্বাচিত হন। তবে ২০১৫ সালের নির্বাচনে আর অংশ নেননি তিনি।

গ্যারি কাসপারভ: পুতিনের বিপক্ষে রাজনীতির মাঠে লড়তে গেলে মাথায় অঢেল বুদ্ধি থাকা চাই। গ্যারি কাসপারভ হয়তো তা পারবেন। কারণ তিনি বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন। তাঁকে বিশ্বের সেরা দাবাড়ুও বলা হয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিপক্ষে রাজনীতিতে নেমেছেন কাসপারভ। ২০০৫ সালে দাবা ছাড়ার পর কাসপারভ ওই বছরই দল গঠন করেন। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জনমত গঠনের।

ভারতের অলিম্পিকে রূপা জয়ী রাজ্যবর্ধন রাঠোর, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ব্রিটিশ তারকা সেবাস্তিয়ান কো, আমেরিকার বাস্কেটবল তারকা বিল ব্র্যাডলিরা খেলার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠ গরম করছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে খেলোয়াড়

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগে থেকেই খেলোয়াড়দের যোগদানের নজির রয়েছে।

আরিফ খান জয়: বর্তমান বাংলাদেশের মন্ত্রী পরিষদে রয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ খান জয়। জয় যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলাচ্ছেন। নেত্রকোনা জেলার একটি সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত জয় সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নাইমুর রহমান দুর্জয়: বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়। দেশের হয়ে ৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন ২৯টি। এরপর রাজনীতিতে নামা দুর্জয়ের। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-১ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি।

আব্দুস সালাম মুর্শেদী: বাংলাদেশের সাবেক জাতীয় দলের ফুটবল খেলোয়াড় আব্দুস সালাম মুর্শেদী খুলনা-৪ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে বর্তমানে জাতীয় সংসদে রয়েছেন।

body4_111318051828.jpgপ্রাক্তন ফুটবল অধিনায়ক আরিফ খান জয় এখন যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী

এছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে রয়েছেন- এককালের সাড়া জাগানো ফুটবলার মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, খুরশিদ আলম বাবুল, আমিনুল হক, সাইদুর রহমান প্যাটেল, বাদল রায়, একরামুল করিম চৌধুরী, কায়সার হামিদ, সাবেক অ্যাথলেট মাহবুব আরা বেগম গিনি।

মাশরাফির রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে বিতর্ক

মাশরাফি আওয়ামী লীগের মনোয়ন ক্রয়ের পর এনিয়ে চলছে ব্যাপক বিতর্ক। বিরোধী শিবির বিএনপি এবং জামাতপন্থীদের সোশ্যালমিডিয়া গ্রুপগুলোতে তাকে নিয়ে চলছে সমালোচনা। আবার আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা স্বাগত জানিয়েছেন রাজনীতির মাশরাফিকে। শোভন হোসেন নামে একজন লিখেছেন, নেতা যদি হতেই চাও ইমরান খানের মত আলাদা দল গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হও, আমরা আছি তোমার সঙ্গে। রমজান রাজ নামের একজন লিখেছেন, আমি চাই না মাশরাফি বুড়ো বয়সে জেলে যাক, আমি চাই না দেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার, ক্লিন ইমেজের মানুষটির দিকে আঙুল তাক করে কেউ কটু কথা বলুক! পরিশেষে তিনি যোগ করেছেন, "দেশের রাজনীতি তোমার মতো ব্যক্তির জন্য নয় 'বস'। প্লিজ ফিরে এসো ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে।" অন্যদিকে সাধুবাদও এসেছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বিপুল সংখ্যক মানুষ সমালোচনা করলেও মাশরাফির সিদ্ধান্তের সমর্থন দেয়ার মানুষও কিন্তু কম না। অনেকেই মাশরাফির রাজনীতি যোগ দেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাঁদের মতে, মাশরাফির মতো জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগ দিলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ধারা পাল্টে যাবে। আরমান মালিক লিখেছেন, মাশরাফির মতো ভাল লোকগুলো রাজনীতিতে আসা উচিত, এরাই দেশকে বদলাবে! আরেকজন মন্তব্য করেছেন, একজন ভালো মানুষ দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতো চিন্তার কিছু নেই। আমরা তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, যাতে সবার সামনে থেকে দেশের জন্যে নেতৃত্ব দিতে পারে।

রাজনীতির মাশরাফির জন্য শুভ কামনা

বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সফল অধিনায়ক মাশরাফির আওয়ামী লীগের মনোনয়ন সংগ্রহে এলাকায় আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। মাশরাফিভক্ত, নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন এবং সাধারণ মানুষ তার শহরে আনন্দ মিছিল বের করেন। মাশরাফির মনোনয়নপত্র কেনায় নড়াইল পৌর, উপজেলা এবং জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মাশরাফি নির্বাচিত হলে অবহেলিত নড়াইলের সার্বিক উন্নয়ন হবে।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের লোকজন জাতীয় দলের এই ক্রিকেটারকে রাজনীতিতে স্বাগত জানিয়েছেন।ব্রাজিলের অনেক তরুণ এখনও রোমারিওর মতো হতে চায়। এমন আশা কেউ ব্যক্ত করলে পরিষ্কার করে শুনে নেওয়া ভালো। তিনি রোমারিওর মতো ফুটবলার হতে চান নাকি রাজনীতিবিদ। নাকি ফুটবলার, রাজনীতিবিদ দুটোই হতে চান তিনি। ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া ফুটবলার রোমারিও দেশটির গভর্নর হওয়ার দৌড়ে আছেন। এর আগে দু'বার রিও ডি জেনিরোর সিনেটর হয়েছেন তিনি।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SAHIDUL HASAN KHOKON SAHIDUL HASAN KHOKON @hasankhokonsahi

Bangladesh Correspondent, TV Today.

Comment