বিজেপির বাংলা বনধ কেন কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাজ্যটিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তা বিজেপি জানে

 |  6-minute read |   28-09-2018
  • Total Shares

ক্ষমতায় এসে প্রথমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে পদক্ষেপটি করেছিলেন তা হল বাম আমলে রীতিতে দাঁড়িয়ে যাওয়া শাসকদলের ডাকে বনধ বন্ধ করে দেওয়া। একটা মজার কথা খুব চলছে যে রাজ্য সরকারি ছুটির দিন বাড়িয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় উৎসবগুলিতে, আর কর্মদিবসের ভারসাম্য বজায় রাখছেন বনধ তুলে দিয়ে। রাজ্য কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর পক্ষে এটি ভালো পদক্ষেপ।

তাঁর কৃতিত্ব হল, এই সিদ্ধান্ত তিনি কোনও রকম ব্যতিক্রম ছাড়া মেনে আসছেন। তাই জাতীয় রাজনীতিতে তিনি আরও গভীর ভাবে যুক্ত হলেও সম্প্রতি ১০ সেপ্টেম্বর বিরোধীদের ডাকা ভারত বনধ থেকে তিনি দূরে থেকেছেন তবে পেট্রোল ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

mamata1-copy_092818082526.jpgদড়িতে টান। আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছেন দিদি (ছবি: ইন্ডিয়াটুডে.ইন)

এ জন্য বুধবারের ডাকা বাংলা বনধ নিয়ে বিজেপির কোনও ভাবে আশাবাদী হওয়ার কোনও কথাই ছিল না। বিজেপির নেতারা এবং দিল্লিতে থাকা শীর্ষ নেতৃত্ব নিশ্চয়ই জানেন যে বুধবারের ডাকা বাংলা বনধ নিয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র উচ্চাশা থাকার কথা ছিল না। বিজেপির নেতারা এবং দিল্লিতে থাকা শীর্ষ নেতৃত্ব নিশ্চয়ই জানতেন যে বড় জোর রাজ্যের কোথাও কোথাও এই প্রতীকি বনধের সামান্য একটু প্রভাব পড়তে পারে। সুতরাং রাজ্যের কেন্দ্রস্থল কলকাতা ও তার আশপাশে কয়েকটি রাস্তা ও কয়েকটি জায়গায় বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া বিজেপির ডাকা বনধ যে মোটের উপরে ঘটনাবিহীন ছিল তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

সে যাই হোক, জাতীয় স্তরে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা দীর্ঘ দিন ধরেই ভাবছিলেন যে ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ দখল করাই হবে বিজেপির সম্প্রসারণে পরবর্তী কৌশল। এই বনধ হয়তো তাঁদের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটাতে পারবে না।

বিগত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ফাঁকা আওয়াজ দিয়েছে নচেৎ কিছুই করে উঠতে পারেনি। ওই দলটির কৌশল হয় সঙ্গতিবিহীন ছিল অথবা অনিশ্চিত ছিল। তাদের পুরো ব্যাপারটাই ছিল এক কদম এগিয়ে দু’কদম পিছিয়ে যাওয়া।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঠিকমতো বুঝে উঠতে না পেরে বিজেপির কোনও কোনও অবদান বলতে ছিল “শুরু করে দাও, আর এগিয়ো না” গোছের একটা অবস্থান। সহজাত রাজনাতিক ক্ষমতা থেকেই মমতা অবশ্য নরেন্দর মোদী-অমিত শাহ জুটির পদক্ষেপ আন্দাজ করে গেছেন। বিজেপি ও তৃণমূলের কার্যকলাপের দিকে যাঁরা নজর রেখেছিলেন তাঁরা দেখেছেন যে ব্যাপারটা ছিল নরমে-গরমে, সারদা ও অন্য তদন্ত নিয়ে মাঝেমধ্যে সারদার জুজু দেখিয়ে দেওয়া।

বহু বছর ধরে বেশ কয়েকটি জেলায় নিজেদের অস্তিত্ব আরএসএস প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও বিজেপি নেতৃত্ব কোনও ছাপই ফেলতে পারেনি। কয়েকটি মুখ বদল করে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বলে দিয়েছে, “যা কোনও দিন তোমাদের ছিল না তা তোমাদের অর্জন করতেই হবে।”

আসাম মডেলও তাই-ই ছিল।

কিন্তু হেমন্ত বিশ্বসর্মার মতো একানে বিজেপির কোনও ‘পিড়ী’ নেই যারা বাংলায় দলকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ধাক্কাটা দেবে।

bandh_092718032620_092818082621.jpgবনধ সর্বাত্মক ছিল না। বিজেপির ডাকা বনধ পুরোপুরি সফল হয়নি (ছবি: টুইটার/বিজেপি৪বেঙ্গল)

তাছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তরুণ গগৈ নন। তবে একটা কথা কিছুটা হলেও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে মুকুল রায় বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতাকে বিজেপিতে টানবেন তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানেন দলের মধ্যে বিদ্রোহ কী ভাবে দমন করতে হয়, কী ভাবে ছিদ্র মেরামত করতে হয়। তা ছাড়া রাজ্যের লোকের নাড়ির স্পন্দন তিনি তাঁর অঙ্গুলিস্পর্শেই বুঝে ফেলতে পারেন।

তবে অনেকে এ কথাও বলছেন যে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতেই কয়েক মাস আগে মুকুল রায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।

মুকুল রায়ের বিজেপিতে যোগদান খুব হইচই করে হয়নি। এর সম্ভাব্য কারণ হল অমিত শাহ চাননি বর্তমান নেতৃত্বকে কোনও ভাবে সমস্যায় ফেলতে এবং আরএসএসের রাজ্য শাখাও বাইরের কাউকে পদ দিতে চাইছে না। যদিও মকুল রায়কে প্রায়শই দলের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে এবং তিনি সুর চড়াচ্ছেন, তিনি এখনও তৃণমূল স্তরে কাজ করে চলেছেন। দলের নির্বাচনী সংগঠন তৈরি করার ভার তাঁকে দেওয়া হয়েছে, তৃণমূলে থাকাকালীন তিনি এই কাজটিই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে করতেন।

২০১৪ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত তৃণমূলস্তরে একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটেছে।

বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গে মূলত দু’টি ব্যাপারের উপরে ভরসা করেছিল বিজেপি। প্রথমটি হল রাজ্যের অবাঙালি বাসিন্দারা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মূলত ব্যবসার কাজে দীর্ঘদিন আগে রাজস্থান থেকে এ রাজ্যে চলে আসা লোকজনের বড় অংশ এবং শ্রমিকের কাজে পাশের বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে এ রাজ্যে আসা লোকজন। দ্বিতীয়টি হল মোদীর ঢেউ যা এই সব ভোট একত্রিত করতে (মেরুকরণের কথা কিন্তু বলছি না) পেরেছিল এবং হিন্দু মধ্যবিত্তদের ভোট বিজেপির পক্ষে চলে এসেছিল।

এই দুই কারণেই ২০১৪ সালে বিজেপির ভোট অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল।

আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়র জিতে যাওয়ার কারণ হল আসানসোলের অবাঙালি বাসিন্দা ও কয়লা ক্ষেত্রের ভোট সামান্য হলেও বিজেপির পক্ষে যাওয়া। অন্য এলাকায় এই দুটি ব্যাপার এক সঙ্গে কাজ করলেও বিজেপিও এক নম্বরে তুলে আনার পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল না।

রাজ্যে কংগ্রেসের ক্রমাগত ক্ষয় ও বামেদের প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গের উদীয়মান শক্তি।

তার পর থেকে হুগলি নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে এবং মোদী ওয়েভও স্তিমিত হয়ে পড়েছে।

babul_092718032042_092818082656.jpgবিজেপির সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় (ছবি: ইন্ডিয়াটুডে.ইন)

কেন্দ্রে সরকারের কাজকর্ম এবং বিজেপির নীতি দেখে ব্যবসায়ী ও বণিক সম্প্রদায়েরও বিজেপির প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছে।

শহুরে মধ্যবিত্তরাও এখন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের নেতৃত্বের প্রতি ও তাঁরা জাতির উদ্দেশে যে ভাবে কথা বলছেন তা দেখেশুনে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

এ সব মিলিয়ে রাজ্যের খেলাটাই বদলে গিয়েছে, তাই বিজেপিকেও এ বার নতুন করে নির্বাচনী নীতি নির্ধারণ করতে হবে, যেমন তারা দেশের বাকি অংশে করছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও তারা যে মধ্যবিত্ত হিন্দু ভোট পেয়েছে তার উপরে আর ভরসা করে থাকতে পারবে না।

যদি কোথাও কোনও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে তা হল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল।

বাম আমলে যেমন দলের স্থানীয় নেতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গাছের একটা পাতাও পড়তে পারত না, রাজ্যের বেশ কয়েকটি অংশে এখন আবার সেই একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই কারণে সেই সব অঞ্চলে আবার অসন্তোষ তৈরি হয়েছে যার প্রভাব সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোটেও লক্ষ্য করা গেছে।

এই সব জায়গাতেই আশার আলো দেখছে বিজেপি – বিশে্ষ করে সেই সব জেলায় যেখানে সম্প্রতি কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িক জনবিন্যাস ভীষণ ভাবে বদলে গেছে। এই কারণেই এই সব জায়গায় মেরুকরণের কৌশল তারা নেবে।

বুধবারের বনধে সে জন্যই বিজেপি রাজ্য সভাপতির গলায় ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শোনা গেছে যা ২০১৪ সালের ভোটের আগে শোনা যায়নি। এর মধ্যেই ভাষাগত অন্ধ দেশহিতৈষীতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে – উর্দু বনাম বাংলা। অবশ্য শেষ পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটা বাংলাদেশিতে গিয়ে দাঁড়াবে এবং রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীকরণের বিষয়টি সামনে উঠে আসবে।

গত কয়েক দিন ধরে আরেকটি কথাও শোনা যাচ্ছে যে কংগ্রেসে যে কয়েকজন মাত্র নেতা অবশিষ্ট আছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম অধীর চৌধুরী বিজেপিতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ জেলায় অধীর চৌধুরীর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাই মুকুল রায়ের পরে অমিত শাহের পছন্দে তিনিও বিজেপিতে আসতে পারেন।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হারানোর তেমন কিছু নেই। তবে এখন শক্তি প্রদর্শন করে তারা কতটা কী লাভবান হবে তা এই অবস্থায় আন্দাজ করা খুবই মুশকিল হবে।

আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে জাতীয় স্তরে হিন্দুত্ব ও রামমন্দির নিয়ে কী অবস্থান নিচ্ছে বিজেপি একই সঙ্গে প্রতিবেশী রাজ্য অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ নিয়ে তারা কী করছে। বাংলায় এর ঘোরতর প্রভাব যে পড়বে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

ডেইলিও তে আমার আগের প্রতিবেদনে লিখেছিলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছন।

তর্কাতীত ভাবে তিনি এই রাজ্যের সর্বকালের জননেতাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য এবং তাঁর সমর্থন এখনও মোটামুটি অটুটই আছে।

বিজেপি এ কথা জানে এবং সে জন্যই তারা তাঁকে এ রাজ্য নিয়ে ব্যস্ত রাখতে চাইছে। আপাতত তাঁর দলে কোনও সঙ্কট নেই, এই অবস্থায় বড় কিচু না ঘটলে জাতীয় স্তরেও তাঁর ভাবমূর্তির উপরে কোনও প্রভাব পড়বে না।

তাই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান কাজ হল রাজ্যে সুস্থিতি বজায় রাখা। তাঁর সামনে নানা ঝুঁকি রয়েছে, তবে তিনি অত্যন্ত দক্ষ রাজনীতিক এবং এই পরিস্থিতেক তিনি হাতের বাইরে চলে যেতে দেবেন না।

তিনি জানেন যে তাংর সেরা সময় এখনও আসেনি।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SANDIP GHOSE SANDIP GHOSE @sandipghose

Writer and blogger on current-affairs.

Comment