বফর্স থেকে রাফাল: গণতন্ত্র দুর্বল বলেই কি প্রচারে দুর্নীতি?

ইস্তাহারে গুরুত্বপূর্ণ অভিমুখ থাকে কম, প্রচারে শুধুই ঢক্কানিনাদ

 |  6-minute read |   18-12-2018
  • Total Shares

বফর্স দিয়ে শুরু। নির্বাচন যত এগিয়ে আসে ততই অভিযোগ উঠতে শুরু করে শাসক দলের বিরুদ্ধে। টু-জি কেলেঙ্কারি, ঘুষ কেলেঙ্কারি... তালিকা লম্বা। এ সব নিয়ে ছড়াও বাঁধা হয়েছে বিস্তর।

নব্বইয়ের দশকের একেবারে শেষ দিকে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং অভিযোগ করলেন যে বফর্স কামান কেনায় ঘুষ নিয়েছেন রাজীব গান্ধী। সে বার লোকের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল সেই কথা... গলি গলি মে শোর হ্যায়/ রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়

এই বফর্স কামান কাজে লেগেছিল কার্গিলের যুদ্ধে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর স্ত্রী ইতালিয়ান, এর উপরে কোয়াত্রোচ্চি (যিনি ঘুষ দেওয়ায় অভিযুক্ত) ইতালিয়ান হওয়ায় দুইয়ে দুইয়ে চার করতে সুবিধাও হয়েছিল।

তারপরে বিজেপি জমানায় ঘুষ কেলেঙ্কারি। স্টিং অপারেশনে দেখা গেল ঘুষ নিচ্ছেন বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণ। দেশ জুড়ে হইচই। আবার দেওয়াল লিখন... নোটন নোটন মন্ত্রীগুলো ঝোঁটন বেঁধেছে/  ও পারেতে জর্জ-জয়া ভেসে উঠেছে/ কে দেখেছে কে দেখেছে তহলকা দেখেছে/ তহলকার হাতে ডটকম ছিল ছুড়ে মেরেছে/ উঃ দিদির বড্ড লেগেছে

rajiv_121818063333.jpgরাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বফর্স কামান কেনায় ঘুষের অভিযোগ উঠেছিল (ফাইল ছবি: রয়টার্স)

জর্জ হলেন বাজপেয়ী সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ। জয়া হলেন জয়া জেটলি, জর্জ ফার্নান্ডেজের সমতা পার্টির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট যাঁকে তহলকার অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড-এ দু’লক্ষ টাকা ঘুষ নিতে দেখা গিয়েছিল। ডট-কম সম্বন্ধে তখন লোকের খুব-একটা ধারনা ছিল না, ছন্দ মেলানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। আর দিদি হলেন অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তহলকার স্টিং অপারেশন তখন বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল।

২০০৪ সালে বাজপেয়ী সরকার যখন ভোটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তখন ফিলগুড ফ্যাক্টর কথাটি খুব চালু হয়ে গেল। আমেরিকা ভারতের উপরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরেও সঙ্কটে পড়েনি দেশ, দেশের অর্থনীতিও ঊর্ধ্বমুখী ছিল। কিন্তু কফিন কেলেঙ্কারি সে বার ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিল বিজেপিকে। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) এবং কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, কার্গিল যুদ্ধের সময় কেনা কফিনে ১ কোটি ৮৭ লক্ষ ডলার লোকসান করেছে ভারত, এ ব্যাপারে তাদের অস্ত্র ছিল কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট। সিবিআই চার্জশিট দেয় ২০০৯ সালে এবং ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আদালত জানিয়ে দেয় যে অভিযুক্দের বিরুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। তার অনেক আগে, অভিযোগ ওঠার পরে আমেরিকা ও ভারতের রাষ্ট্রদূতরা লিখিত ভাবে কফিনের দাম জানিয়ে দেন।

manmohan-vajpayee_121818063414.jpgঅটলবিহারী বাজপেয়ী (ডান দিকে) সরকারের বিরুদ্ধে কফিল কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে, তারপরে টানা দশ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং (ফাইল ছবি: রয়টার্স)

তবে ২০০৪ সালে নির্বাচনে পরাজিত হয় অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকার। টানা দশ বছর জোট সরকার চালাল কংগ্রেস। তাদের জমানার শেষ দিকে একের পর এক কেলেঙ্কারি। কয়লার ব্লক বণ্টন, টু-জি এবং অগস্তাওয়েস্টল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হারাতে হল কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ সরকারকে।

২০০৬-০৭ সালে কেনা অগস্টাওয়েস্টল্যান্ড ভিভিআইপি চপার কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, সনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আহমেদ প্যাটেল প্রমুখের বিরুদ্ধে। তাঁদের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।

এ বার প্রশ্নের মুখে রাফাল চুক্তি। আদালতে ক্লিনচিট পেয়েও স্বস্তি নেই সরকারের। রায়দান যার ভিত্তিতে, সেখানেই নাকি গলদ আছে। সরকারের বক্তব্য, আদালত ভুল ব্যাখ্যা করে মুখবন্ধ খামে পেশ করা বয়ানের। আর গণমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, ভুলটা করেছে সরকারই, কারণ যে অংশ নিয়ে বিভ্রান্তি সেখানে ব্যাকরণগত ত্রুটি ছিল, যার ফলে ভবিষ্যৎ কাল বদলে অতীত হয়ে গেছে।

বারে বারেই ভোটের আগে অভিযোগ ওঠে। এই তালিকায় কয়লার ব্লক বণ্টন, টু-জি কেলেঙ্কারির মতো নানা অভিযোগ রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ সবরে কোনও নিস্পত্তি হয় না বা হয়নি। কিন্তু কেন্দ্রে পালাবাদল ঘটে যায়। তা হলে এটি কি দুর্বল গণতন্ত্রের লক্ষণ? প্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক বিষয় থেকে নজর ঘোরানোর কৌশল?

ইতিমধ্যেই রাহুল গান্ধী অভিযোগ করতে শুরু করেছেন ‘চৌকিদার চোর’ – নরেন্দ্র মোদী নিজেকে চৌকিদার (পুলিশ বা রক্ষক) বলে প্রচার শুরু করেছিলেন। তাঁকে ‘চোর’ বলে প্রচার করে তাঁর বাবার বিরুদ্ধে প্রচারের হয়তো বদলা নিচ্ছেন। তবে নরেন্দ্র মোদীও ছাড়ার পাত্র নন, তিনিও অগস্টাওয়েস্টল্যান্ড কপ্টার নিয়ে খোঁটা দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন।

modi-rahul_121818063458.jpgএখন ‘চৌকিদার’ ‘নরেন্দ্র মোদী’কে চোর বলছেন রাহুল গান্ধী (ছবি: রয়টার্স)

প্র্তিপক্ষের বিরুদ্ধের একের পর এক অভিযোগ করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ, কিন্তু গঠনমূলক কথা বলে তা দিয়ে জনমত পক্ষে এনে নির্বাচনে জেতা কঠিন। তাই পৃথিবীর বৃহত্তম (নাকি দুর্বলতম) গণতন্ত্রে ভুল বোঝানোর মতো সহজ রাস্তাই বেছে নেন রাজনৈতিক নেতারা। যাঁরা ভোট দেবেন তাঁরাও তলিয়ে ভাবেন না।

নরেন্দ্র মোদী ভোটের প্রচারে বললেন তিনি ক্ষমতায় এলে কালোটাকা উদ্ধার করে সকলের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেবেন। খুব ভালো কথা। যাঁরা এই কথায় বিশ্বাস করে ভোট দিলেন তাঁরা ভাবলেনই না তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে কিনা। ভাবলেন না কালো টাকা তিনি কী ভাবে উদ্ধার করবেন আর কী ভাবেই বা ১২০-১৩০ কোটি বাসিন্দার প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে এই টাকা পৌঁছে দেবেন। এটাও ভাবলেন না যে এই টাকা পেয়ে ছ’মাস দেশের সব লোক কাজকর্ম বন্ধ করে দিলে কী হতে পারে।

জিএসটি নিয়েও হইচই। উৎস খুঁজলে দেখা যাবে ২০০২ সাল থেকে তোড়জোড় চলছে। এর জন্য রাজ্যগুলির অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে যে কমিটি হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে সেই কমিটির প্রধান হয়েছেন বিভিন্ন জমানায় বিভিন্ন বিরোধীদলের সরকারের অর্থমন্ত্রীরা। এই তালিকায় এ রাজ্যের দুই অর্থমন্ত্রী রয়েছেন – অসীম দাশগুপ্ত ও অমিত মিত্র। অর্মন্ত্রীদের এমপাওয়ার্ড কমিটির প্রধান যাতে সিলমোহর লাগাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী তার বিরোধিতা করছেন। লোকে প্রশ্নও করছে না।

আমার প্রশ্ন হল, এক যুগের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন জোট (কংগ্রেস ও বিজেপির নেতৃত্বাধীন) যে ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছে, সেই ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরে সকলে কেন বলছে যে তাড়াহুড়ো করা হল? পদ্ধতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে ত্রুটি যত না ছিল হইচই তার চেয়ে বেশি হয়েছে, কোথায় ত্রুটি, কী ভাবে তা দূর করা যায় তা নিয়ে আলোচনা নেই, শুধু সমালোচনা আছে। তবে একটি কথা মানতেই হবে, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের খুবই সমস্যা হয়েছে।

গঠনমূলক আলোচনা না করে কেন সরকারকে আক্রমণ করাই যেন রীতি। রাজীব গান্ধীর সময়ে দেশে কম্পিউটারের বিরোধিতা করেছে বামেরা, মনমোহন সিংয়ের সময়ে তারা বিরোধিতা করেছে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির। কেন করেছে? যদি বামপন্থী আদর্শেই দেশকে পরিচালনা করার ইচ্ছা তারা পোষণ করে তা হলে জ্যোতি বসুকে কেন প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি?

আমাদের দেশে বিরোধীরা শুধু বিরোধিতা করে যান, সমাধান কী তা বলতে তাঁদের ঘোর অনীহা। যিনিই বিরোধী আসনে বলেন তিনিই ভর্তুকি তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করেন। প্রশ্ন হল ভর্তুকি দেয় কে? কোথা থেকে সেই টাকা আসে? করদাতাদের টাকা থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। করদাতা কারা ? যাঁরা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি রোজগার করেন। তার মানে সরকারের চোখে রোজগার করা হল অপরাধ!

ক্ষমতায় এলে করকাঠামো কী হবে, দেশের পরিকাঠামো উন্নয়নে কে কী করবে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকার কী ভাবে উদ্যোগী হবে এবং যখন শিল্পায়ন বনাম পরিবেশের দ্বন্দ্ব হবে তখন কোন ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান কী হবে সে কথা কেন নির্বাচনী ইস্তাহারে রাজনৈতিক দলগুলি স্পষ্ট করে না?

উত্তর সহজ। এ সব কথা যুক্তিসঙ্গত ভাবে লিখলে দেশের মানুষ শিক্ষিত হবেন, তখন তাঁদের ভাঁওতা দেওয়া সহজ হবে না। তাই আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা চান বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র য়েন কোনওদিনও পরিপক্ক গণতন্ত্র না হতে পারে। তাই প্রতিবেশী রাষ্টকে সবক শেখানোর কৃতিত্ব নেয় রাজনৈতিক দল (সরকার নয়) এবং একবার যুদ্ধ জিতলে পরের বার ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করে ফেলেন।

rafale_121818063529.jpgরাফাল হাতছাড়া করতে চাইছে না কংগ্রেস (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

বফর্স নিয়ে অভিযোগ তোলার পরে প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, তিনি বফর্স মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে কী করেছেন সে কথা কেউ জানেন না, সকলে জানেন মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে।

কফিন কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে কী করেছে ইউপিএ সরকার? কেন সিবিআই-এর পাঁচ বছর লেগে গেল চার্জশিট দিতে? উত্তর নেই।

এবার নরেন্দ্র মোদীর পালা। অগস্তাওয়েস্টল্যান্ডের অভিযোগ ওঠার পরে সাড়ে চার বছর ধরে তিনি ক্ষমতায়। তদন্তের কী হয়েছে? সেই জবাব দেশের লোক চায় না, তারা চায় ১৫ লক্ষ টাকা কেন পেল না সে কথা জানতে। চায়ের কাপে তারা তুফান তোলে এই টাকা নিয়ে। বিমুদ্রাকরণে নিজের কী ক্ষতি হয়েছে সেই প্রশ্ন তোলে না, প্রশ্ন তোলে সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট দেখে। রাজনৈতিক নেতারা চান দেশের মানুষের ভাবনার অভিমুখে নিয়ন্ত্রণ করতে, তাঁদের সাফল্যই দেশের দুর্বল গণতন্ত্রের কাঠামো।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment