করাচিতে চিনের দূতাবাসে হামলার কেন চিনের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে

এই ঘটনার দায় নিয়েছে বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলসি)

 |  5-minute read |   30-11-2018
  • Total Shares

কোনও ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলে সাধারণত তার ছাপ চিনাদের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যায় না – জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে। যত বড় বিপদ বা সমস্যার মুখোমুখি তারা হোক, সব সময় তাদের মুখে সাহসী ভাবই দেখা যায়। যাই হোক, ২৩ নভেম্বর করাচিতে তাদের দূতাবাসে যখন ভয়ঙ্কর ধরনের জঙ্গি হামলা হল, তখন অবশ্য এ কথা পুরোপুরি খাটেনি। নিশ্চয়ই তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল এবং এই ঘটনা তাদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল, বাইরে থেকে যতটা বোঝা গেছে ভিতরে ভিতরে শঙ্কাটা তার চেয়ে বেশিই ছিল।

বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) সঙ্গে বেশ ভালো যোগ রয়েছে এমন তিন জঙ্গি এই ভয়াবহ হামলার দায় স্বীকার করেছে। ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধানোর জন্য তারা সম্ভবত ভিসা হলের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল যদিও সেখানে পৌঁছনর আগেই তাদের মৃত্যু হয় গুলির লড়াইয়ে।

ওই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে কোয়েটা থেকে ভিসার জন্য আসা দু’জনের মৃত্যু হয় – তবে ওই দু’জনের মৃত্যু জঙ্গিদের গুলিতেই হয়েছে নাকি পুলিশের গুলিতে সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জঙ্গি হামলার ছক বানচাল হয়ে গেলেও, ঘটনাস্থলেই দুই পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়, ওই দু’জনকে তৎক্ষণাৎ শহিদ বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়।

attack1-copy_1127180_113018022948.jpg করাচিতে চিন দূতাবাসে জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়, তাঁদের শহিদ বলে ঘোষণা করা হয়। (ছবি:  রয়টার্স)

পুলিশের দিক থেকে বিচার করলে একটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হবে, এক তরুণ মহিলা পুলিশ আধিকারিক এই ঘটনায় জঙ্গি হামলাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পুরো বাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এলাকাটিকে জঙ্গিদের কবল থেকে মুক্ত করেন।

এই ঘটনার একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে এখন সকলে আলোচনা করছেন, তা হল পাকিস্তানিরা কেন চিনের দূতাবাসকে নিশানা বানাল? যতই হোক চিন ও পাকিস্তান সব সময়ের বন্ধু, অতিসম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরকারি সফরে চিনে গিয়েছিলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তিনি অর্থসাহায্য চাইতেই গিয়েছিলেন, কারণ পাকিস্তানের অর্থভাণ্ডার এখন কার্যত পুরো খালি।

নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেছন যে চিন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্প ভালো চোখে দেখছেন না বালুচিস্তানের বাসিন্দারা। তাঁদের আশঙ্কা, বালুচিস্তানের মাটির নীচে জমে থাকা কয়লাই হল চিনের আসল লক্ষ্য।

ইতিমধ্যেই আরব সাগরের তীরে গদর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চিনের ঝিনজিয়াং প্রদেশের যুক্ত করার যে বিশাল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেটির বিরোধিতা করেছেন পাকিস্তানের রাজনীতিকদের একাংশই। চিনের এই প্রদেশের উইঘুর মুসলমানরা নিয়মিত ভাবেই খবরের শিরোনামে থাকে কারণ চিন সরকার তাদের নিশানা করে রেখেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ইসলামি সন্ত্রাসের মদতদাতা এবং তারা চিনে একটি স্বায়ত্তশাসিত পৃথক এলাকা দাবি করছে।

চিনা দূতাবাসে হামলার পরে অবশ্য তারা নিজেদের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান নিয়ে ভাবতে বাধ্য হবে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের জঙ্গিদের মদত দেওয়ার নিন্দা করার প্রসঙ্গেও ভাবতে বাধ্য হবে। জৈশ-ই-মহম্মদের (জেইএম) প্রধান মাসুদ আজহার এবং লস্কর-ই-তৈবার (এলইটি) প্রধান হাফিজ সঈদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসঙ্ঘে নিন্দার সিদ্ধান্ত হলেও চিনের আধিকারিকদের মুখে নিন্দার কথা শোনা যায়নি। কেউ কেউ মনে করছেন যে চিনের দূতাবাসে যে ঘটনা ঘটেছে এর পরে অন্তত চিন তাদের সন্ত্রাস সংক্রান্ত নীতি পুনর্মূল্যায়ন করবে এবং জঙ্গি কার্যকলাপ দমনের ক্ষেত্রে তারা সহযোগিতা করবে।

attack2-copy_1127180_113018023023.jpgযে তিনজন জঙ্গি এই ঘটনার দায় স্বীকার করেছে তারা তিনজনই বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মির সঙ্গে যুক্ত (ছবি: রয়টার্স)

এগারো বছর আগে ২০০৭ সালের সেই ঘটনার কথা আরেকবার ফিরে দেখা যাক, সেই বহুল প্রচারিত পাকিস্তানের লাল মসজিদ অবরোধের ঘটনা যেখানে প্রতি মুহূর্তে তৎকালীন পাক রাষ্ট্রপতি পারভেজ মুশারফকে ঘটনার অনুপুঙ্খ খবর দিয়ে গিয়েছিল চিন, লাল মসজিদ অবরোধের দুষ্কর্মে সরাসরি যুক্ত ছিল উইঘুররা। বন্ধুত্বের জন্য ও সদ্ভাবনা প্রকাশ করতে ওই ঘটনায় যুক্ত উইঘুরদের চিহ্নিত করে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছিল চিন। মনে করা হয় যে পরবর্তীকালে চিনই ওই উইঘুরদের শাস্তি দিয়েছিল। পাকিস্তানের এখনও দ্বিমুখী অবস্থানই দেখা যাচ্ছে – আর এ কথা চিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য – তারা মনে করে যেখানে নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে সেখানে সন্ত্রাসবাদ ক্ষতিকারক।

যাই হোক, যা আশা করা হচ্ছে তার বিপরীতে গিয়েই বলছি, পাক জঙ্গিদের ব্যাপারে নির্দিষ্ট তথ্য থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান কোনও দিনই ভারতের হাতে জঙ্গিদের তুলে দেবে না এবং পাকিস্তানের সেই ঔদাসীন্য ও নীরবতাকে সমর্থন করবে চিন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল ২৬/১১-র জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছে পাকিস্তান যারা নিপুণ ভাবে পৈশাচিক ষড়যন্ত্র করে সমুদ্রযাত্রা করেছিল।

এখন প্রশ্ন হল চিনের দূতাবাসে এই ভয়ানক হামলার নেপথ্যে কে রয়েছে? একটা ব্যাপার বোঝাই যাচ্ছে যে এর নেপথ্যে তাদের নিজেদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বহু বহু বছরের অবহেলার তীব্র অভিযোগ। বালুচিস্তানের প্রতি এই মাত্রাছাড়া অবহেলা ও অবজ্ঞা, ঔদাসীন্য এবং চরম ঔদ্ধত্যই বিদ্রোহী করে তুলেছে এই এলাকার বাসিন্দাদের, এই জন্যই বালুচিস্তানে বিরোধিতা ও বিদ্রোহ দেখা যাচ্ছে।

পাকিস্তান সরকার নিয়মিত ভাবে বলে আসছে যে বালুচিস্তানে সন্ত্রাসে মদত দিচ্ছে ভারত। তাৎপর্যপূর্ণ হল, বালুচিস্তান একই রকম ভাবে অশান্ত থেকে যাচ্ছে, চিনের প্রতি তাদের মনে চরম বিতৃষ্ণা এবং সহজাত ঘৃণা রয়েছে। ব্যাপারটা এই রকম যে, বিদ্রোহী কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষে বাণজ্যনগরী করাচিতে কার্যত দুর্গের মতো চিনা দূতাবাসে হামলা করা একেবারেই আশ্চর্যজনক ঘটনা নয়।

china4-copy_11271809_113018023051.jpgচিনের কাছে এটা বিপদের বার্তা (ছবি: রয়টার্স)

এ ক্ষেত্রে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ও ঘটেছে, পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী মেহমুদ কুরেশি জানিয়েছেন যে জঙ্গিরা অবরোধের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছিল, ইমরান খানের অতি সাম্প্রতিক চিন সফরের সয়য় চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে সবেমাত্র যে বাণিজ্যচুক্তি হয়েছে সম্ভবত তারা সেটারই বিরোধিতা করতে চাইছিল।

বিদেশমন্ত্রী এ কথাও বলেছেন যে চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত এই সম্পর্ক কোনও এক শক্তি বানচাল করে দিতে চাইছে। এই ইঙ্গিত কি ভারতের দিকেই? এই রকম একটা অস্পষ্ট ও রেখেঢেকে দেওয়া ইঙ্গিতের সঙ্গে কি আসন্ন সার্ক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রণ জানানোর ভাবনা? হয়তো তাদের এই সংযম ও বিগলিত ভাব সামান্য কিছুদিনের জন্যই স্থায়ী হবে, যা আগেও দেখা গিয়েছিল।

যাই হোক একটা বিষয় স্পষ্ট যে চিনকে এখন তার অতীত কর্মের মুখোমুখি হতে হবে। মারাত্মক জঙ্গি হামলার নিরিখে বলা যায় যে করাচি এখন ভয়াবহ জায়গা হয়ে উঠেছে এবং পাস্তুন-সমেত যে সব জায়গা এ ব্যাপারে যুক্ত তাদের প্রতি সহনশীলতা দেখানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। চিনকে নিশানা বানানোর সম্ভবত এটিই  প্রধান ও আবশ্যিক কারণ।

এখন যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SHANTANU MUKHARJI SHANTANU MUKHARJI @shantanu2818

The author is a retired IPS officer who has held key positions in the Government of India handling sensitive security issues within and outside India

Comment