ভোটে নিরাপত্তার জন্য যে সশস্ত্র বাহিনী দরকার, তা রাজ্যের হাতে নেই

মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে এমন হিংসা আগে হয়নি এই রাজ্যে

 |  4-minute read |   27-04-2018
  • Total Shares

আমাদের রাজ্যের রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্রনাথ সিং গতকাল ঘোষণা করেছেন যে এই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে ১৪ মে এবং ভোট গণনা হবে ১৭ মে। মাঝে একটা দিন রাখা হয়েছে পুনরায় ভোট গ্রহণের যদি প্রয়োজন হয়, সে কথা মাথায় রেখে।

গত কয়েক দিন ধরে যে বিতর্কের আবহ তৈরি হয়েছিল, সেখানে আমরা দেখেছি, বিচার পেতে বিজেপি, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, সিপিএম এবং পিডিএস—এই চারটি রাজনৈতিক দল আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল, এমনকি তারা দেশের সর্বোচ্চ আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছিল। বিচারপতি মহামান্য সুব্রত তালুকদার যে রায় দিলেন, সেই রায়ের ভিত্তিতে ঐকমত্য হওয়ার সুযোগ ছিল, সেটা কিন্তু হল না। কারণ, এখানে যিনি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার, তিনি একজন প্রাক্তন আইএএস আধিকারিক। তিনি এই রাজ্যে কোনও একটি জেলার জেলাশাসক ছিলেন। কিন্তু তাঁর যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, তা কোথায় ঠেলে দিচ্ছে রাজ্যটাকে তা তিনি নিজেই জানেন না।

এই যে এতগুলো দিন আমাদের নষ্ট হল, এর কোনও অর্থ ছিল না। আমি দু’টো জেলাতে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব সামলেছি। আমি পঞ্চায়েত ভোট করেছি, আমার তত্ত্বাবধানে পুর নির্বাচন, বিধানসভা নির্বাচন ও লোকসভা নির্বাচনও হয়েছে।সেই অভিজ্ঞতার সূত্রে বলতে পারি, ১৯৬৭ সাল থেকে আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের যে আবহ তৈরি হয়েছে, সেটা আজও পর্যন্ত প্রশমিত হয়নি। এর কারণ হল, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি। নিকৃষ্ট রাজনীতির মধ্যেই এই ধরনের সন্ত্রাসের শিকড় রয়েছে।

আমরা আগে যে সব রাজ্যগুলোকে বাহুবলী রাজ্য বলতাম, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার, সেই সব রাজ্যগুলো অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে। তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে এই ধরনের সংস্কৃতি নির্বাপিত হয়ে যাচ্ছে। আর যে রাজ্য সম্বন্ধে এক সময় বলা হত, হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো, সেই রাজ্যের আজ কী অবস্থা! বাংলা আজ যে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কথা ভাবছে, ভারত সেটা অবশ্য অন্য ভাবে দেখছে। আমাদের রাজ্যেও ২০১৩ সালে একটা নজির তৈরি হয়েছিল, মীরা পাণ্ডে তখন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে পাঁচ দফায় ভোট করিয়েছিলেন এবং নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী আনিয়েছিলেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মীরা পাণ্ডে ঠিক ছিলেন নাকি রাজ্যের বর্তমান নির্বাচন কমনিশনার ঠিক।

আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েতস্তরে ৫৮,০০০-র কিছু বেশি বুথ আছে। একটা জায়গায় বা প্রেমিসেসের মধ্যে চার-পাঁচটা বুথও থাকে। অর্থাৎ একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে চার থেকে পাঁচটি বুথ থাকতে পারে। সে ভাবে দেখলে আমাদের রাজ্যে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের সংখ্যা হচ্ছে ৪৮,০০০-এর কিছু বেশি। অর্থাৎ যে সব কেন্দ্রে একাধিক বুথ রয়েছে, সেখানে নিরাপত্তাকর্মী প্রয়োজন।

body2_042718050928.jpgএখন প্রশ্ন হচ্ছে মীরা পাণ্ডে ঠিক ছিলেন নাকি রাজ্যের বর্তমান নির্বাচন কমনিশনার ঠিক।

আমাদের রাজ্যে এক লক্ষ দুহাজার মতো সিভিক ভলান্টিয়ার আছে। এগুলি সবই এই সরকারের নিয়োগ করা, এরা সকলেই রাজনৈতিক দলের মনোনীত। এদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করার অর্থ হল, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা। এ বার সরকারের হাতে কত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী আছে দেখা যাক। কলকাতা পুলিশকে বাদ দিয়ে রাজ্য পুলিশে ৫৬,০০০-এর কিছু বেশি কর্মী আছে। কলকাতা পুলিশ বাহিনীতে আছেন ২৬,০০০-এর কিছু বেশি। সব মিলিয়ে আশি থেকে বিরাশি হাজার পুলিশকর্মী থাকার কথা। কিন্তু অবসরগ্রহণ, মৃত্যু ও কর্মক্ষম না থাকার জন্য এই সংখ্যাটা অনেক কম থাকে। তা ছাড়া পুলিশের নিয়মিত কয়েক ধরনের কাজ থাকে। যেমন ভিআইপিদের নিরাপত্তা দেওয়া, কোষাগার ও বিভিন্ন ব্যাঙ্ক পাহারা দেওয়া, থানা পরিচালনা করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা—এ জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় বাহিনী দরকার হয়।

স্বাভাবিক ভাবেই আপনি চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার পরুলিশকর্মী পাবেন। এই সংখ্যক পুলিশকর্মী দিয়ে আপনি ৫৮,০০০ বুথ বা ৪৮,০০০ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রকে নিরাপত্তা দেওয়া অসম্ভব। শুধু বুথ ম্যানেজমেন্টই নয়, পুলিশ পেট্রলিংয়ের জন্য, নির্বাচন পরিদর্শকের জন্যও নিরাপত্তাকর্মী দরকার। তাঁরা সশস্ত্র বাহিনীর কাউকে চান, এ কাজ কখনোই সিভিক ভলান্টিয়ার দিয়ে হবে না। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দেখা য়াবে প্রচুর সংখ্যায় নিরাপত্তা কর্মী দরকার যা আমাদের হাতে নেই। অঙ্ক তাই বলে, আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতাও সেই কথাই বলে। কেউ যদি বলেন যে এই ৪৮,০০০ পুলিশকর্মী দিয়ে আমি সমস্ত বুথ এবং প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেব, তা অসম্ভব।

body1_042718045820.jpg৪৮,০০০ পুলিশকর্মী দিয়ে আমি সমস্ত বুথ এবং প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেব, তা অসম্ভব

এ ক্ষেত্রে কয়েকটি উপায় আছে। রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে আধাসামরিক বাহিনী চাইতে পারে। তা না চাইলে আমাদের পাশের কানও রাজ্যের থেকে, অর্থাৎ বিহার, ওড়িশা বা ঝাড়খণ্ড থেকে পুলিশবাহিনী চাইতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রতিটা রাজ্যেরই এক একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রবণতা রয়েছে। আমি যদি উত্তরপ্রদেশ থেকে বাহিনী নিতে যাই তা হলে বলবে ওটা যোগী আদিত্যনাথের বাহিনী। যদি বিহারের বাহিনী নিতে যাই তা হলে বলবে ওটা নীতীশ কুমারের বাহিনী, ওড়িশা থেকে বাহিনী আনালে বলবে ওটা নবীন পট্টনায়কের বাহিনী। যেন প্রত্যেকেরই একটা করে রাজনৈতিক ছাপ রয়েছে।

কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী, অর্থাৎ বিএসএফ, এসসএবি বা সিআরপিএফ—তাদের সেটা থাকে না। তারা ওই ভাবে কাজ করে না। তবে রাজ্য সরকারের একটা বিতৃষ্ণা কাজ করে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে বাহিনী নেওয়ার ক্ষেত্রে। কেন্দ্রে মোদী সরকারের প্রতি বিদ্বেষ থাকার জন্য তারা কোনও ভাবেই কেন্দ্রীয় বাহিনী নিতে রাজি নয়। তাই আমাদের প্রশ্ন হল, নিরাপত্তা কোথায়, নিরাপত্তা কে দেবে? সিভিক ভলান্টিয়ার দেবে, নাকি হোমগার্ড সেই নিরাপত্তা দেবে যাদের হাতে কোনও অস্ত্র নেই? অর্থাৎ নিরাপত্তা কে দেবে?

আমার মনে হয়, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নতজানু হয়ে রাজ্য সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। তিনি যা করেছেন, লোকে বুঝতেই পারছেন। তিনি রাজ্য সরকারের নীতির সঙ্গে আপোস করে নিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী যাই বলুন, নির্বাচনে নিরাপত্তার দিকটা দেখা হয়নি। গত প্রায় এক মাস ধরে মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে আমরা যে কাণ্ডটা এই রাজ্যে দেখছি, তাতে তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এতগুলো লোক মারা গিয়েছে, এত হিংসা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে আমরা মনোনয়নের দিনে যা আমরা দেখিনি। ভোটগ্রহণের দিন আমরা অনেক হিংসা দেখেছি, কিন্তু মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন এই ধরণের ঘটনা কখনও দেখিনি। তাই শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব ধরনের মানুষের কাছে এটা একটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে আছে। এই দুশ্চিন্তা দূর করতে হবে।আমরা জানি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে অনেকগুলো দল যাবে। শেষ কোথায় তা রায় না দেখে বলতে পারব না।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000
Comment