উত্তর কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠক ফলপ্রসূ হওয়ায় কেন স্বস্তি ভারত ও চিনের

এর সঙ্গে আরও অনেক দেশের সমীকরণ ও সম্পর্ক জড়িয়ে আছে

 |  6-minute read |   28-06-2018
  • Total Shares

ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন মার্কিন ধমক। উল্টে ছুড়ে দিয়েছেন বেপরোয়া হুমকি। চালিয়ে গিয়েছেন পারমাণবিক অস্ত্রের একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তীব্র তিক্ততার দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল ওয়াশিংটন ডিসি-পিয়ং ইয়ং সম্পর্ক। উত্তর কোরিয়ার উপর মার্কিন হামলা ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। এই অবস্থায় দুই দেশের আকস্মিক বিপরীতমুখী অবস্থান, সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার ইঙ্গিত। মুখোমুখি উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং-উন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াররুম থেকে সিঙ্গাপুরের স্যান্টোসা দ্বীপের বিলাসবহুল পাঁচতারা ক্যাপিলা রিসর্টের মিটিংরুমে। অন্তরঙ্গ করমর্দন এবং দুই প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র নায়কের হোটেলের লনে পদচারণা।

body3_062818053846.jpgস্যান্টোসা দ্বীপে এক সময়ের দুই যুযুধান কিম জং-উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প (রয়টার্স)

তাকিয়ে ছিল সারা বিশ্ব। বিশেষ করে এশিয়ার দুই দেশ ভারত এবং চিনেরও আগ্রহ ছিল এই বৈঠকের দিকে, ট্রাম্প-কিমের বৈঠকের ব্যাপারে। বৈঠকের পালে যে হাওয়া  লেগেছে, তা যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্কের ধারা কোন দিকে নিয়ে যাবে, তাতে বেশ বড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে। যদিও বৈঠক শেষে কিম ও ট্রাম্প দু’জনেই জানিয়েছেন যে আলোচনা সফল।

বাস্তবে বৈঠকের বিষয়বস্তু কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে চিন ও ভারতের বিদেশমন্ত্রক নিশ্চয়ই চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করে দিয়েছে। দুই দেশই চাইছিল যাতে উত্তর কোরিয়া ও আমেরিকার এই ঐতিহাসিক বৈঠক ইতিবাচক হয়, একান্তই নিজেদের   দেশের স্বার্থে।

চিনের কাছে উত্তর কোরিয়া এক বড় বোঝা। নয়া দিল্লির কাছে পিয়ং ইয়ং গলার কাঁটা। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া তাদের ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষা করেছে। কিম প্রশাসনের এই পারমাণবিক আস্ফালন যেমন খেপিয়ে তুলেছে ওয়াশিংটনকে, পুরোনো বন্ধু হলেও, বেজিংও উত্তর কোরিয়াকে দেওয়া অর্থনৈতিক অনুদানে রাশ টানতে পিছপা হয়নি। একেই রাষ্ট্রপুঞ্জ ২০০৬ সাল থেকে বেশ বড় আকারে ছেঁটে দিয়েছে তাদের যাবতীয় আর্থিক অনুদানও।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড একই ভাবে চালিয়ে গিয়েছে। মার্কিন তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে কিম প্রশাসনের হাতে একটা হাইড্রোজেন বোমা সমেত ৬০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। এ ছাড়াও তাদের খনিতে যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম মজুত আছে তাতে ফি বছর ছ’খানা করে পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব।

সামরিক খাতে কিম সরকার প্রতি বছর খরচ করে প্রায় ১০০০ কোটি মার্কিন ডলার (ভারতীয় মদ্রায় ৬৯,০০০ কোটি টাকা, ১ ডলার = ৬৯ টাকা হিসাবে)। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র 'দা ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক'-এর ২০১৭-র তথ্য অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার মোট বার্ষিক উৎপাদন বা জিডিপি হল ৪,০০০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালে এই জিডিপি বৃদ্ধি পায় মাত্র ৩.৯ শতাংশ। এখনও পর্যন্ত এটাই উত্তর কোরিয়ার সর্বাধিক উন্নয়নের মাপকাঠি।

কিম জং-উন তাঁর উত্তর কোরিয়াকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও তা ধোপে টেকেনি। আড়াই কোটি জনসংখ্যার উত্তর কোরিয়া খুবই গরিব দেশ। আর্থসামাজিক অবস্থা তলানিতে। দারিদ্র্য  দূরীকরণের ক্ষেত্রে কর্মরত মার্কিন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘দা বর্গেন প্রজেক্ট’-এর তথ্য অনুযায়ী, সে দেশের জনসংখ্যার ৪০% মানুষ বসবাস করে দারিদ্র সীমার নীচে। শ্রমিকদের দিনে সর্বাধিক আয় ভারতীয় মুদ্রায়  দেড়শো টাকার মতো।

body2_062818053911.jpgএকান্ত বৈঠকের আগে দুই রাষ্ট্রপ্রধান (রয়টার্স)

সামাজিক পরিকাঠামোও ভগ্নপ্রায়। নিজের দেশের রেল ও রাস্তার এতটাই বেহাল দশা যে কিম বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি মুন জাই-ইন তাঁর দেশে গেলে তিনি অস্বস্তিতে পড়বেন। এমন অবস্থায় পারমাণবিক কর্মসূচির অর্থনৈতিক ধকল সামলাতে না পারলে, এবং অনুদানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলে দেশের অর্থনীতি আরও সঙ্গীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এখানেই চিনের বড় আশঙ্কা। উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়লে সে দেশের একটা বিপুল জনসংখ্যা স্মরণার্থী হয়ে ঢুকে পড়বে চিন ভূখণ্ডে, যা শি জিনপিং সরকার কোনও মতেই চাইবেন না। বিরাট সংখক উদ্বাস্তু সামলানোর পরিকাঠামো এই মুহূর্তে চিনের নেই। তাদের কমিউনিস্ট সরকার কোনও ধরনের পুনর্বাসন নীতিও প্রণয়ন করেনি।

এ ছাড়াও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি কতটা সুরক্ষার ঘেরা টোপে বাধা, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরেই তাদের পুংগেইরি পারমাণবিক পরীক্ষাকেন্দ্রে  একটা সুড়ঙ্গ ধসে ২০০ জন  শ্রমিক মারা যান। উত্তর  কোরিয়ার এই পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো একেবারে চিন সীমান্তের লাগোয়া। যদি কোনও দিন ১৯৮৬ সালের চের্নোবিল ধরণের পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তার ক্ষয়ক্ষতি যে শুধু উত্তর কোরিয়াকেই পোহাতে হবে তা নয়, রেহাই পাবে না চিনের এক অংশও।

এ হেন নড়বড়ে উত্তর কোরিয়ার পরিকাঠামো যদি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে, তবে কোরীয় উপদ্বীপে দুই কোরিয়া মার্কিন ছত্রছায়ায় চলে আসতে পারে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকার বন্ধু দেশ। চিনকে চাপে রাখার জন্য সে দেশের মাটিতে মার্কিন প্রশাসন তাদের অস্ত্রসম্ভার ছাড়াও আঠাশ হাজারের মতো সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে। দুই কোরিয়ার সহযোগে মার্কিন জমি বাড়লে, তাদের ঘাঁটি আরও পোক্ত হবে। কোরীয় উপদ্বীপে মার্কিন শক্তি যদি বৃদ্ধি পায়, সেটা হবে বেজিংয়ের জন্য পর্বতপ্রমাণ মাথা ব্যথার কারণ। এই জোটের সঙ্গী যখন জাপানও, তখন তো শি জিনপিংয়ের কপালে আরো বড় চিন্তার ভাঁজ পড়বে।

অতএব বেজিং সবসময়ই মুখিয়ে থাকবে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের দিকে। ফলে ট্রাম্প কিমের এই বৈঠক সফল ভাবে বাস্তবায়িত হওয়া চিনের কাছে একান্ত কাঙ্ক্ষিত। এই মর্মে গত মে মাসে চিনের ডালিয়ানে জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে কিম জানান, সংশ্লিষ্ট পক্ষ তাদের আগ্রাসী মনোভাব বর্জন করলে তাঁর দেশও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে উদ্যোগী হবে।

আবার পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের এই প্রয়াসের  পিছনে ক্ষুদ্র হলেও তাদের স্বার্থও লুকিয়ে। ওয়াশিংটন এবং পিয়ং ইয়ং উভয় পক্ষই ভালোই জানে, কেউ কারও বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যাবহার করবে না। কিম আমেরিকার সামরিক শক্তি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তিনি জানেন, আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া হবে আত্মহত্যার সামিল।

body4_062818053940.jpgতাঁদের দিকে তখন তাকিয়ে সারা বিশ্ব (রয়টার্স)

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্প তাঁর আলগা মন্তব্য, সিদ্ধান্ত ও খামখেয়ালিপনার জন্য প্রভূত দুর্নাম কুড়িয়েছেন। গত বছরের শেষ দিকে জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসাবে মান্যতা দিয়ে বসেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত নস্যাৎ করে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪ সদস্য রাষ্ট্র বিরুদ্ধে মত দেয়। এই বছরের গোড়ার দিকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়ে ট্রাম্প  পৃথিবীর বাকি দেশগুলোর ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ান। এই কার্যকলাপ ঢাকতে এবং তাঁর পূর্বসূরিরা যা পারেননি, কম সময়ের মধ্যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভূখণ্ডে এমন শান্তি বৈঠকের আয়োজন করে ট্রাম্প নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার সুযোগ করে নিলেন।

ট্রাম্প-কিমের এই বৈঠকের সাফল্য নয়া দিল্লিকেও স্বস্তি দেবে বলে আশা করা যায়। পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ৪০ বছরের পুরোনো। ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো যান উত্তর কোরিয়ায়। সই করেন নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তিতে। আমেরিকার অভিযোগ ছিল, সেই থেকেই শুরু এই দু’দেশের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি সংক্রান্ত্র আদান প্রদান।

পরবর্তীকালে পিয়ং ইয়ং ইসলামবাদকে নোডং-১ ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রযুক্তির তথ্যসম্ভার হাতে তুলে দেয় বলে শোনা যায়। পাকিস্তানের ঘাউরি ১ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়েছে নোডং ১ বা রোডং ১ ক্ষেপণাস্ত্রের নকশা মেনে। পারমাণবিক ক্ষমতার নিরিখে উত্তর কোরিয়া পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে। তাদের হাতে রয়েছে ১০০ কিলোটন শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা। পাকিস্তান এখনও এমন বোমা বানিয়েছে বলে খবর নেই। এই বোমা তৈরির কারিগরি তথ্য যদি পাকিস্তানের হাতে চলে আসে তা হলে  দুশ্চিন্তা  বাড়বে ভারতের, বিঘ্নিত হবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কুটনৈতিক স্থিতিশীলতা।

body1_062818054009.jpgযদি বন্ধু হও: বৈঠক শুরুর আগের মুহূ্র্ত (রয়টার্স)

সিঙ্গাপুর বৈঠকের ফলস্বরূপ উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের দিকে এগোতে পারে, কমতে পারে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম চালাচালি। শিথিল হতে পারে আর্থিক অনুদানের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা। নয়া দিল্লির সঙ্গে পিয়ং ইয়ংয়ের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মসৃণ হতে পারে। শুরু হতে পারে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যও।

ট্রাম্প কিমের এই বৈঠকের কিছুদিন আগেই ভারতের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী জেনারেল ভিকে সিং উত্তর কোরিয়া সফর করেছেন। বৈঠক করেছেন সে দেশের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে।

সংশ্লিষ্ট সব দেশই চাইছিল সংযত হোক উত্তর কোরিয়া। এখন উত্তর কোরিয়াও হয়তো সংযত হচ্ছে নিজের স্বার্থেই।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

KAUSHIK BHOWMIK KAUSHIK BHOWMIK

IT Analyst, Executive Management, Indian Institute of Management, Indore

Comment