সাধারণ নির্বাচন বনাম রাজ্য নির্বাচন: মোদী ও বিজেপির ক্ষেত্রে মানুষের রায় ভিন্ন হতে চলেছে
২০১৩ বা ২০১৪ সালের মতো এবার মোদী হাওয়া রাজ্য নির্বাচনে কাজে দেবে না
- Total Shares
নির্বাচনী মরসুম এসে পড়ল বলে। তাই তো রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি ও উন্মাদনার পারদ ধীরে ধীরে তুঙ্গে উঠতে শুরু করে দিয়েছে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এবং নতুন নতুন তর্ক-বিতর্ক দানা বাঁধছে। দুর্ভাগ্যবশত, এদের মধ্যে কয়েকটি সত্যি সত্যিই ভীষণভাবে কুরুচিকর। রাজনীতিবিদরা প্রচণ্ড চাপে রয়েছেন। সামনেই, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, তেলাঙ্গানা ও মিজোরামে বিধানসভা নির্বাচন। এর পর আবার আসছে বছর এপ্রিলে লোকসভা নির্বাচন।
কেমন হবে এই নির্বাচনগুলো?
নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা সর্বদাই কঠিন। তাও, একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।
লোকসভা ও রাজ্যের বিধানসভাগুলোর নির্বাচনী চিত্র ভিন্ন বলেই আমার মনে হচ্ছে।
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিসগড় বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস যে বিজেপির সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দেবে তা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তেলাঙ্গানাতে সহজেই ক্ষমতা দখল করবে টিআরএস। অন্যদিকে, মিজোরামের পরিস্থিতি এখন বেশ জটিল।
কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতবে বলেই আমার ধারণা। জয়ের ব্যবধানটা অবশ্য বিরোধীদের জোটের উপরে নির্ভর করছে।
এক দশক বাদে ২০০৯ সালের মনমোহনকে মনে করাচ্ছেন ২০১৮ সালের মোদী
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে লোকের মনে যে ছবি ফুটে উঠেছে তার জন্যেই লোকসভা ও বিধাসভাগুলোর নির্বাচনী চিত্রটা এতটা ভিন্ন ঠেকছে।
আমজনতার ধারণা, মোদী একজন পরিশ্রমী ও সৎ রাজনীতিবিদ যিনি প্রশাসন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে সদা আন্তরিক। তাই লোকে তাঁকে একটি দ্বিতীয় সুযোগ দিয়ে দেখতে চায়। মোদীর অনেক গুণগ্রাহীও স্বীকার করে নিয়েছেন যে যতটা উন্নয়নের প্রয়োজন ছিল ততটা উন্নয়ন কিন্তু গত চার বছরে হয়নি। কিন্তু, এর পরেও, তাঁরা অপেক্ষা করতে প্রস্তুত কারণ মোদী আন্তরিক ও কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান।
২০০৯ সালে মনমোহন সিং সম্পর্কেও আমজনতার এই ধারণাটা তৈরি হয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি সহ বেশি কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিরোধীরা তাঁকে তীব্র আক্রমণ করলেও, সেই সময় মানুষের মনে হয়েছিল যে তিনি একজন সৎ লোক এবং তাঁকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে।
আজকের ছবিটাও কতকটা এক।
রাজস্থানে কংগ্রেস বিজেপির মধ্যে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হবে [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
নোটবন্দির সিদ্ধান্তের জেরে বিরোধীদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁর সমর্থকরাও মেনে নিয়েছেন যে এই সিদ্ধান্ত ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু, একই সঙ্গে, তাঁরা মনে করছেন যে মোদী অন্তত দেশের কালো টাকা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন এবং তাই তাঁকে সমর্থন করা যেতেই পারে।
মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের নবতম আক্রমণ ২০১৬ সালে রাফাল চুক্তি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই চুক্তির প্রক্রিয়াকে বেশ অপরিণতভাবে সম্পন্ন করেছে সরকার।
'দ্য প্রিন্ট'-এর শেখর গুপ্ত জানাচ্ছেন, রাফাল পরিস্থিতি কোনও কেলেঙ্কারির জন্যে সৃষ্টি হয়নি। সৃষ্টি হয়েছে বোকামোর জন্য। এবার দেখার বিষয় এই সমস্যা থেকে সরকার কী ভাবে মুক্তি পায়। তবে আমার সন্দেহ রয়েছে, এই বিতর্ক আদৌ সরকারের ভাবমূর্তিকে কতটা নষ্ট করতে পারবে।
তাই সব দিক বিচার করে আমার মনে হচ্ছে যে কেন্দ্রে বিজেপি বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।
এখন একটু রাজ্যের নির্বাচনগুলোর উপর চোখ রাখা যাক। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি জোট বাঁধলে বিজেপির জন্যে লড়াইটা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। একই ভাবে, কর্নাটক, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী জোট হলে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে বিরোধীরা।
রাজ্যের নির্বাচনগুলোর প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে যে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হতে চলেছে রা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে রাজস্থানের ভোটাররা কংগ্রেসের দিকে ভীষণভাবে ঢলে পড়েছে। সম্প্রতি আমি মাউন্ট আবুতে ছিলাম এবং স্থানীয়দের সঙ্গে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলাম। তারা চায় রাজ্য ও কেন্দ্রে সরকার ভিন্ন দলের হাতে থাকুক। মানুষের মনে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ভাবমূর্তি অনেকটাই উজ্জ্বল কিন্তু রাজ্যগুলোতে বিজেপি সরকারের ভাবমূর্তি অনেকটাই ফিকে হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া, সে রাজ্যে অশোক গেহলটের জনপ্রিয়তা এখনও যথেষ্ট।
চন্দ্রশেখর রাও: তেলাঙ্গানায় টিআরএসের জয় সহজে আসবে [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
মধ্যপ্রদেশে গত ১৫ বছর ধরে একজন জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী শাসন করে চলেছেন। কিন্তু সে রাজ্য থেকে যে খবর আসতে শুরু করেছে তাতে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোটের প্রভূত আশঙ্কা দানা বেঁধেছে। ছত্তীশগড়ে বরাবরই কংগ্রেস বিজেপির মধ্যে তীব্র লড়াই লক্ষ করা গিয়েছে। তাই এ রাজ্যের ফলাফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা সহজ নয়।
বরঞ্চ, তেলাঙ্গানায় তেলাঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস) যে জিততে চলেছেন তা খুব সহজেই বলা চলে কারণ সে রাজ্যে বিরোধী কংগ্রেস অত্যন্ত দুর্বল। মিজোরামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি খুব একটা ওয়াকিবহাল নই। কিন্তু আমার মনে হয় এ বারে ক্ষমতা পুনর্দখল কংগ্রেসের পক্ষে খুব কঠিন হবে।
২০১৩ ও ২০১৪ সালের মতো এবার কিন্তু মোদী প্রভাব রাজ্যে রাজ্যে কাজ করবে না।
মানুষ এবার রাজ্য সরকারগুলোর কাজের খতিয়ান বিচার করে ভোটদান করবে, মোদীর মুখ চেয়ে নয়। এক্ষেত্রে কর্নাটকের নির্বাচন সেরা নিদর্শন হতে পারে।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কড়া ভাবে প্রচার করে এসেছিলেন সেই রাজ্যে, এর পর মনে হয়েছিল যে বিজেপি হয়তো সহজেই কর্নাটকে বাজিমাত করতে পারবে। কিন্তু ২০০৮ সালে রাজনাথ সিং দলীয় সভাপতি থাকার সময় যে আসন পেয়েছিল তার চেয়ে এবার ১০৪ টি আসন কম পেল বিজেপি।
সুতারং, বলা যেতে পারে যে বিরোধীদের কাছে বিধানসভা নির্বাচনগুলোতে খুব ভালো সুযোগ রয়েছে। এখানেই বিরোধীরা সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করতে পারে।
উল্টোদিকে, কেন্দ্রে বিজেপির সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকেই সহায় করে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করতে পারে। কংগ্রেসকে বুঝতে হবে যে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক। কারণ মানুষ এখনও তাঁকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরঞ্চ, রাজ্যে রাজ্যে অশোক গেহলট, অমরিন্দর সিং বা সিদ্দারামাইহার মতো গুরত্বপূর্ণ নেতা কংগ্রেসে রয়েছে যাঁএরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য। তাঁদেরকে জাতীয় স্তরের নেতা হিসাবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু তা করতে গেলে সর্বপ্রথম কংগ্রেসকে পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্ত হতে হবে।

