রাজ্যের শহর সত্যিই নোংরা, নাকি রাজ্যকে পিছিয়ে দেখানোর কৌশল কেন্দ্রের
রাস্তাঘাট পরিষ্কার হলেও অনেক জায়গাতেই রয়েছে খাটাল, খোলা ভ্যাট
- Total Shares
দেশের সবচেয়ে নোংরা ২৫টি শহরের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের ১৯টি শহরের নাম রয়েছে। স্বচ্ছতার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে পিছিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে রাজ্যের পুরসভাগুলির ভূমিকা নিয়ে। আর একে বিজেপির রাজনৈতিক অভিসন্ধি বলছে তৃণমূল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শনিবার ইন্দোরে যে তালিকাটি প্রকাশ করেছেন, সেখানে বর্জ্য সংগ্রহ, খোলা জায়গায় বর্জ্য নিক্ষেপ, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয়ের নিরিখে দেশের ছোট শহরগুলির বিচার করা হয়েছে। তা ছাড়া ছোট শহরগুলি নতুন কোনও পদ্ধতি উদ্ভাবন করছে কিনা তাও বিচার করা হয়েছে।
পরিস্থিতি সরেজমিন যাক।
ভদ্রেশ্বরে প্রচুর খাটাল রয়েছে, শহরটিকে নোংরা বলে ঘোষণার এটি একটি কারণ হতে পারে
তালিকায় থাকা ভদ্রেশ্বর দিয়েই শুরু করা যাক। উন্নয়ন, মানে সৌন্দর্যায়ন হয়েছে, নীল-সাদা রং হয়েছে, রাস্তাঘাট অনেক ঝাঁ-চকচকে হয়েছে। কিন্তু মনে পড়ে মনোজ উপাধ্যায়কে? এই পুরসভার চেয়ারম্যান, যাঁকে খুন হতে হয়েছিল? কেন খুন হয়েছিলেন? এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, খাটাল উচ্ছেদ নিয়ে গণ্ডগোলের জেরেই নাকি খুন হতে হয়েছিল তাঁকে।
রোজ সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে স্টেশনে গেলেই দেখতে পাবেন দুধ নিয়ে গোয়ালারা ট্রেনে চাপছেন, সেই দুধ হাওড়া হয়ে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যাবে। বিকেল তিনটে নাগাদও একই দৃশ্য। এই ছোট শহরটিতে এক সময় শ’চারেক খাটাল ছিল, এখন তার সংখ্যা দেড়শো থেকে দু’শো। এই খাটাল থেকে শুধু দুধই পাওয়া যায় না, ভোটও পাওয়া যায়, টাকাও পাওয়া যায়। তাই খাটাল রয়েছে, দুর্গন্ধ রয়েছে, নোংরাও রয়েছে।
চাঁপদানি স্টেশন থেকে ভদ্রেশ্বর – জিটি রোড ধরে গেলে চোখে পড়বে অসংখ্য খাটাল, সার দিয়ে। এক একটি খাটাল মানে নিদেনপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি মোষ। তাদের বর্জ্য কম নয়।তাই শহরের মাঝের অংশ ধরে পুরো শহরের বিচার করে ফেললে ঠিক হবে না।
আরেকটি শহরের কথা ধরা যাক, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর। অপরিচ্ছন্ন শহরের তালিকায় রয়েছে উত্তর ব্যারাকপুর শহরও। ট্রেনে করে গেলে অনেক সময় নাকে রুমাল চাপা দিতে হয়, দুর্গন্ধের জন্য। রেললাইনের ধারেই ভাগাড়, দুর্গন্ধ। ঘিঞ্জি এই শহরে নতুন করে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপায় নেই বললেই চলে। পুরসভা উদ্যোগী হয়েছে। তবে এ সব কাজ রাতারাতি হয় না।
খোলা জায়গায় বর্জ্য, লোকের মাথাব্যথার কারণ
ঐতিহাসিক শহর শ্রীরামপুরের কথা ধরা যাক। এমনিতে সমস্যা নেই। শহর দ্রুত লম্বা হচ্ছে। ছোট বাড়ি ভেঙে গড়ে উঠছে ফ্ল্যাট-আবাসন। শহরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে বর্জ্য। সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? বছর তিনেক আগের হিসাবে দিনে ৬০ থেকে ৮০ টন বর্জ্য জমা হত। এখন তা বেড়েছে। এখানে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপায় রয়েছে। জৈব ও অজৈব বর্জ্য আলাদা করে তা ব্যবস্থাপনা করা হয়। ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির উপায়ও রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট কিনা, সেই প্রশ্নও রয়েছে। যে তালিকায় রাজ্যের বেশিরভাগ শহর অপরিচ্ছন্ন, সেই তালিকায় রাজ্যটি পরিচ্ছন্ন শহরের নিচের দিকে থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক।
শহরের জনসংখ্যা যে ভাবে বাড়ছে, সেই ভাবে কি নিকাশি নালার সংস্কার হচ্ছে? সেই হারে কি বাড়ানো হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা? এলাকার রাজনৈতিক নেতারা মানছেন কাজ হচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এখনও তা অপ্রতুল রয়ে গিয়েছে। পুরোনো শহরে রাতারাতি কিছু করে ফেলা খুব সহজ নয়, তা ছাড়া এ জন্য অর্থও প্রয়োজন। ছোট পুরসভাগুলোর পক্ষে জোর ধাক্কায় সব কিছু করে ফেলা সম্ভব নয় ইচ্ছা থাকলেও।
কলকাতা শহরেও এ ভাবে নিয়ে যাওয়া হয় ময়লা, জেলা-শহরগুলির অবস্থাও তথৈবচ
এই তালিকায় রয়েছে দার্জিলিংও। দার্জিলিং শহরের নিকাশির হাল কী, তা মোটামুটি সকলেরই জানা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও জিটিএ-র সঙ্গে বৈঠকে নিকাশির প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।
আরেকটি বিষয়ও রয়েছে, রাজনীতি। ২০১৬ সালে নদিয়া ও হুগলি জেলাকে নির্মল জেলা বলে ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ধরনের অনেক ঘোষণাই হয় রিপোর্টের ভিত্তিতে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে তা অনেক ক্ষেত্রে নাও মিলতে পারে। শুধু রেড রোড ধরে কলকাতার পরিচ্ছন্নতা বিচার করলে চলবে কি করে? আদিগঙ্গার তীরে জায়গায় জায়গায় যে বস্তি রয়েছে, সেটিও তো কলকাতা শহরেই! চেতলায় জেলেপাড়া বস্তি বা তপসিয়া-পার্কসার্কাস এলাকায় দূষণের মাত্রা কেমন, তা গন্ধেই বোঝা যায়। তাই নির্মল জেলা ঘোষণার সময় সামগ্রিক ভাবে তা করা হয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
অপরিচ্ছন্ন রাজ্যের তালিকাতেও পশ্চিমবঙ্গ বেশ উপরের দিকেই রয়েছে
রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের মতে, নদিয়া জেলাকে তিন বছর আগে দেশের স্বচ্ছ জেলাগুলির অন্যতম বলে ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সেই কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকায় এখন নদিয়া নেই। এটি ভোটের দিকে তাকিয়ে এই রাজ্যের সরকারকে হেয় করার জন্য করা হয়েছে বলে তিনি মনে করছেন।
এ রাজ্যে যে নির্মল বাংলা প্রকল্প রয়েছে তা কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছ ভারতের বঙ্গীকরণ মাত্র। এ রাজ্যে নতুন কোনও উদ্ভাবনী পদ্ধতি নেই, সেই মাপকাঠিতে কিছুটা তো পিছিয়ে পড়বেই ছোট শহরগুলো। তা ছাড়া যে পদ্ধতিতে বর্জ্য স্থানান্তর করা হয়, সেই পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সেটা খোদ কলকাতা শহরের একটি একটি ছবিতেই প্রমাণিত। তার পরেও অবশ্য এ কথা হলফ করে বলা চলে না, এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই।

