কেমন ছিল জওহরলাল নেহরু ও এডুইনা মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক
নেহরু যুগের সৌজন্য ও পারস্পরিক আস্থা আজ আর অবশিষ্ট নেই
- Total Shares
১৯৪৮ থেকে শুরু করে প্রায় ১২ বছর ধরে নিজেদের মধ্যে চিঠিপত্র আদানপ্রদান করেন জওহরলাল নেহরু ও এডুইনা মাউন্টব্যাটেন। দু'জনের কেউই এই চিঠিগুলো নিয়ে খুব একটা গোপনীয়তা চাননি।
নেহরুর বয়স তখন ৬৮, এডুইনা তাঁর থেকে ১০ বছরের ছোট। কিন্তু দুজনের কেউই সে সময় বুঝতে চেষ্টা করেননি যে ৫০ বছর পরে কী ভাবে তাদের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা হবে। ১৯৬০ সালে বোর্নিওর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবার সময় ঘুমের মধ্যেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এডুইনা। তার মৃতদেহের পাশেই নীল সাটিনে মোড়া নেহরুর লেখা চিঠির তাড়াটি পাওয়া যায়।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও মাউন্টব্যাটেন দম্পতি বহুবার এদেশ এসেছেন। পরিবারের ইতিহাস রচয়িতা তথা মাউন্টব্যাটেনর ছোট মেয়ে পামেলা হিকস জানিয়েছেন, সেই সময়ই নেহরুর সঙ্গে তাঁর মায়ের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, "আমার মায়ের তখন একাধিক প্রেমিক ছিল। বাবা সবকিছুই জানতেন। কিন্তু নেহরুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই অন্যরকম ছিল।“ সেই সময় মাউন্টব্যাটেন নিজেই একবার তার জ্যেষ্ঠ কন্যা প্যাট্রিকাকে বলেছিলেন, "এডুইনা ও জওহরলালকে এক সঙ্গে খুব ভালো মানায়। এরা দুজনেই দুজনকে খুব পছন্দ করেন।"

কিন্তু, মাউন্টব্যাটেনদের খোলাখুলি এই ভারতপ্রীতি ইংল্যান্ড ভালো চোখে দেখেনি। ১৯৪৮-এ গান্ধীজির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলাকালীন রাজঘাটে বাবু হয়ে বসেছিলেন মাউন্টব্যাটেন দম্পতি। এই ছবি ব্রিটিশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতেই যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। তাঁর মনে হয়েছিল, 'নেটিভ'দের মাঝে 'নেটিভ'দের মতো বসে মাউন্টব্যাটেনরা নিজেদের মর্যাদা খুইয়েছেন। তাই ইংল্যান্ডে ফেরার পর মাউন্টব্যাটেনদের সঙ্গে হাত পর্যন্ত তিনি মেলাতে চাননি।
কিন্তু এ জন্য এডুইনা ও নেহরুর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। সেই সময় ব্রিটেনে ভারতীয় উপরাষ্ট্রদূত ছিলেন নেহরুর বোন বিজয়ালক্ষ্মী পণ্ডিত, তিনি নিয়মিত এডুইনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যুর কিছুদিন আগে সাংবাদিক তথা লেখক ডোম মোরেস নেহরুর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। মোরেস জানিয়েছিলেন যে রাষ্ট্রনেতা নয়, নেহরুকে দেখে তাঁর কবি বলে মনে হয়েছিল। ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেহরু। কিন্তু আমৃত্যু তার নেতৃত্ব কোনও দিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। যদিও নেহরুর আমলে দেশের প্রথম তিনটে সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট নিয়মিত কমেছে । তবে কংগ্রেসও হারেনি, নেহরুও গদিচ্যুত হননি। আসলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনি খুব সহজেই একাত্ম হয়ে যেতে পারতেন।
জওহরলাল নেহরু আধুনিক ভারতের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থাকবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি বা যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতোই নেহেরুর সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও কম নয়। এ সব কিছু সত্বেও একটা কথা স্বীকার করে নিতেই হবে, ভারত এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে নেহরু-আমলেই।

কাশ্মীর সমস্যা বা ১৯৬২র ভারত-চিন যুদ্ধ কিংবা আমলাতন্ত্রের বাবুগিরির প্রতিষ্ঠা সব কিছুই নেহরুর আমলেই হয়েছে। কিন্তু এই নেহরুই আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার আড়াই বছরের মধ্যে সংবিধান চালু করে দিয়েছিলেন, প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায় প্রচুর বরাদ্দ করেছেন, দেশে পরমাণুশক্তি কমিশন গঠন করেছেন সর্বোপরি স্বাধীন ভারতে সফল ভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসেব দাঁড়িপাল্লায় ফেলে দেখুন, প্রায় সমান।
দেশে সাধারণ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। তাই নেহরু-প্যাটেল সম্পর্ক নিয়ে অপ্রীতিকর কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কিন্তু ১৯৪৯- এর অক্টোবরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের লেখা একটি প্রবন্ধ দুজনের সম্পর্কটা স্পষ্ট করে দেয়।
প্রবন্ধের নির্বাচিত অংশ
"...খুবই উচ্চ আদর্শের অধিকারী ছিলেন তিনি, সৌন্দর্য্য ও শিল্পকলার পূজারী ছিলেন। নিজের দিকে অন্যদের টানার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। এই গুনগুলোর জন্যই রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জওহরলালের শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।"
"....তাই স্বাভাবিক ভাবে স্বাধীন ভারতে প্রথম সূর্যোদয়ের মুহূর্ত থেকে তিনিই দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্বাধীনতার পর যখনই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সমাধানের জন্য আমরা প্রত্যেকবারই জওহরলালের উপর আস্থা রেখেছি। শেষ দু'বছরে দেশের এই খারাপ সময়ে জওহরলাল কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না।দায়িত্বের চাপে দুবছরের মধ্যেই ওঁকে বুড়িয়ে যেতে দেখেছি।"
"...আমরা দু'জনে অভিন্নহৃদয় বন্ধু ও সহকর্মী হিসেবে বহুবছর একসঙ্গে কাজ করেছি। দু’জনেরই দু'জনের উপর অগাধ আস্থা রয়েছে এবং দু'জনেই দু'জনের পরামর্শ মেনে চলেছি।"
নেহরু-যুগের লোকেদের মধ্যে যে সৌজন্য, সাহসিকতা ও পারস্পরিক আস্থা ছিল তা আজ আর অবশিষ্ট নেই। ১৯৬৭ সালে সৈয়দ আখতার হুসেন রিজভি (কাইফ-ই-আজমি নামে যিনি বেশি পরিচিত) নৌনিহাল সিনেমার জন্য একটি গান রচনা করেন। সিনেমায় এই গানটি নেহরুর শেষযাত্রার আবহ সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। গানের প্রথম কয়েকটি কলি এই রকম:
মেরি আওয়াজ শুনো প্যায়ার ক্যা রাজ শুনো/ উসকে পরদে মে দিল সে লাগা রাখা থা/ থা জুদা সবসে মেরে ইশক কা আন্দাজ শুনো।...

