কলকাতা হাইকোর্টের কর্মবিরতিতে ক্ষতি বিচারব্যবস্থার, সমস্যায় বিচারপ্রার্থীরা
এই ধরনের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ভাবে অসাংবিধানিক ও 'কাউন্টারপ্রোডাক্টিভ'
- Total Shares
বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশন যে কর্মবিরতি চালাচ্ছে আমি তাকে সমর্থন করি না। তার অনেকগুলো কারণ আছে। আমার মতে যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশেই একটা স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা থাকা উচিৎ, এবং তা সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য অত্যন্ত দরকারি। তাই সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেই আদালত চালু রাখা উচিৎ।
আইনজীবীদের দাবি যতই যুক্তিযুক্ত হোক না কেন, বিচারপ্রার্থীদের অধিকারকে দাবিয়ে দিয়ে কোনও দাবিকে কখনও তুলে ধরা যায় না। আজকে সাধারণ মানুষ উচ্চ আদালতে যেতে না পেরে বিভিন্ন ভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন। এই ব্যাপারটা আইনজীবীরা কী করে এড়িয়ে যেতে পারেন?
আজ থেকে নয়, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সময় থেকেই বলা হয়ে আসছে যে আইনজীবীদের কর্মবিরতি কোনও ভাবেই আইনসম্মত হতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ হরীশ উপ্পল মামলায় পরিষ্কার জানিয়েছিল যে আইনজীবীদের কর্মবিরতি আদালত অবমাননার সমতুল্য। তা সত্বেও আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে অমান্য করে, এক কথায় আইনের শাসনকে অবজ্ঞা করে দিনের পর দিন এই কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই ধরণের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ভাবে অসাংবিধানিক ও 'কাউন্টার প্রোডাক্টিভ'। আর ফলে আদালতের পাহাড়প্রমাণ কাজের উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। এ ধরণের আন্দোলন কোনও মতেই সমর্থনযোগ্য নয়।
যদিও তাঁরা জনমত গঠনের মতো উপায়ে আন্দোলন করতে পারেন। তাঁরা ধর্নায় বসতে পারেন, সত্যাগ্রহের পথ বেছে নিতে পারেন কিংবা অনশন করতে পারেন। তবে গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের অন্যতম সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে বিচারপতির পদ পূরণ করা। যদি সেই কাজে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর আন্দোলন করে চাপ সৃষ্টি করা যেতে পারে। কিন্তু কোনও ভাবেই আদালতকে বন্ধ করে সেটা হয় না, এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
আদালত বন্ধ রাখা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত
যদিও একদল আইনজীবীর মতে, যেহেতু কম সংখ্যক বিচারপতিদের উপর প্রচুর মামলার চাপ থাকে, তাই অনেক সময় মামলার দ্রুত নিস্পত্তির জন্য তড়িঘড়ি রায় দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না – জাস্টিস হারিড ইস জাস্টিস বারিড। কিন্তু আমি মনে করি, বিচারপতিদের চাপ নিয়েই কাজ করতে হয়। আমাদেরও চাপ নিয়েই কাজ করতে হত। আমাদের দেশে যতজন বিচারপতি থাকা উচিৎ ততজন বিচারপতি কোনও জায়গাতেই নেই। এই অভিযোগটি অনেকদিনের। তা হলে সমাধান কী?
আমি মনে করি, মূলত জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং নির্দিষ্ট সংস্থার উপর চাপ তৈরি করতে হবে। কোনও ভাবেই সাধারণ মানুষকে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে চলবে না।
আমার বিশ্বাস এই কর্মবিরতি যদি আরও কিছু দিন চলে তা হলে পুরো বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে, তাই যাতে আরও বড় কোনও ক্ষতি না হয়ে সে দিকে নজর দিতে হবে এবং আন্দোলন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। বিচারপতিদের কাজের চাপ কী ভাবে কমান যেতে পারে?
এই কর্মবিরতি আরও কিছু দিন চললে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে
আমি যখন মাদ্রাজ হাইকোর্টে বিচারপতি ছিলাম, বিচারব্যবস্থার উন্নতির জন্য কয়েকটা পরামর্শ দিয়েছিলাম। ল কমিশনারের নির্দেশিকায় সেই পরামর্শগুলো স্থান পেলেও তাতে পরে কোনও রকম আমল দেওয়া হয়েনি। আদালতের কাজের পদ্ধতি একটু পাল্টানো দরকার। যেমন, ছুটি কমান কমানো উচিৎ। বছরে ২১০ দিন হাইকোর্ট বসে। আমার মতে এটা কমকরে ২৫০ দিন করা উচিৎ। আদালতের কাজের সময় একটু বাড়ান দরকার। সাড়ে দশটা থেকে শুরু না করে ১০ টা থেকে কাজ শুরু করে দু’টো পর্যন্ত আবার আড়াইটে থেকে ৫টা পর্যন্ত আদালত চলা উচিৎ। প্রয়োজনে মাসে অন্তত দুটো শনিবার আদালত বসতে হবে। কোনও মামলার শুনানির দু'মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা করতে হবে। আমাদের দেশে মামলা দিনের পর দিন মুলতুবি হয়ে যায়, এই পদ্ধতি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিৎ। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন আমি বলেছিলাম যে সুপ্রিম কোর্টের ছুটি এক সপ্তাহ কমানো উচিৎ, কিন্তু তখন কেউ তাতে রাজি হননি।
আমার আশা, আইনজীবীদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থে ও বিচার ব্যবস্থার স্বার্থে তাঁরা তাদের এই কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন। ‘ভুল হয়েছে’ বলে কর্মবিরতি তুলে নেওয়া উচিৎ। এই নিয়ে কোনও রকম জেদাজেদির জায়গা নেই।

