অমিত শাহের প্রচারে এনআরসি: ভোট কেন্দ্রের হলেও ইস্যু রাজ্যের

২০১৯ নয়, মোদীর প্রশংসা ছাড়া রাজ্যে ২০২১ সালের ইস্যু তুলে ধরছে বিজেপি

 |  6-minute read |   31-03-2019
  • Total Shares

দেশের ডাকব্যবস্থা সরকারি হবে নাকি বেসরকারি, সেই একটি ইস্যু সামনে রেখে একবার নির্বাচন হয়েছিল জাপানে। ওই সব দেশে দারিদ্র্য, ভর্তুকি, দুর্নীতি এ সব নিয়ে ভাবনা নেই বলে এমন একটা প্রশ্নের উত্তর সরকার চায় দেশের জনতার থেকে। তাই ভোটের ফল দেখে সরকার বুঝে যায় দেশের মানুষ কী চান।

আমাদের দেশেও লোকসভা নির্বাচন হয়, সেখানে দেশের সার্বভৌম সমস্যা নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না, সার্বভৌম বলতে কী বোঝায়, সেই ব্যাখ্যাতেও কেউ যেতে চান না। তাই লোকসভা ভোটের প্রচারে উঠে আসে রাস্তাঘাটের প্রসঙ্গ, সঙ্গে থাকে মনমোহিনী প্রতিশ্রুতি। ঠাকুরদা-বাবা-মায়ের ছবি দেওয়া ফ্লেক্স-ব্যানার। প্রয়াত ব্যক্তিদের উত্তরাধিকারী কে, তা স্থির করতে কথার লড়াই (নীতির লড়াইও হয়তো থাকে)।

নরেন্দ্র মোদী ১৫ লক্ষ টাকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে পারেননি, তবে ক্ষুদ্র কৃষকদের প্রতি ত্রৈমাসিকে ২,০০০ টাকা করে দেবেন বলেছেন। রাহুল গান্ধী এখন পাঁচ বছরে সাড়ে তিন লক্ষ টাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। লোকে স্বপ্ন দেখছেন কিনা তা বোঝা যাবে ২৩ মে।

amit-shah-alipurduar_033119051327.jpg আলিপুরদুয়ারে নির্বাচনী জনসভায় এনআরসি প্রসঙ্গ তোলেন অমিত শাহ। (ছবি: পিটিআই)

ভারতে লোকসভা নির্বাচন মানে সেখানে বিদেশনীতি নিয়ে আলোচনা হয় না, শিল্পনীতির ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা হয় না, আলোচনা হয় স্থানীয় ইস্যু নিয়ে। তাই লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে আসন পেতে গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রার আয়োজন করেছিল বিজেপি – কেউই প্রশ্ন করেননি, এ রাজ্যে যদি ৪২টা আসনের মধ্যে ৪২টি পেয়েও কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গড়তে না পারে, তা হলে কী হবে! রাজ্যের গণতন্ত্র যদি তৃণমূল কংগ্রেস নষ্ট করে থাকে তা হলে সেটি ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ইস্যু হতে পারে, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে কেন ইস্যু হবে? গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রা (যা রথযাত্রা নামে পরিচিত হয়েছিল) আদালতে আটকে গিয়েছিল, সেই প্রসঙ্গ আলাদা।

সামনেই নির্বাচন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে ভাবেই হোক আসন কয়েক গুণ (৪টি পেলেই দ্বিগুণ, ৬টি পেলে তিনগুণ) বাড়াতে চাইছে বিজেপি। তাই এখন তারা ইস্যু করছে এ রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে। কেন লোকসভা ভোটে তা পশ্চিমবঙ্গের জন্য ইস্যু হবে, সেই পাল্টা প্রশ্ন না তুলে তার জবাব দিচ্ছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস।

সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে নির্বাচনী জনসভায় নাগরিকত্ব প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন বিজেপি সভাপতি তথা গুজরাটের গান্ধীনগরের প্রার্থী অমিত শাহ। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি (জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জীকরণ) করবেন। তবে যাঁরা শরণার্থী, তাঁদের আশঙ্কার কিছু নেই। প্রশ্ন হল শরণার্থীদের যদি কোনও সমস্যাই না হয়, তা হলে এই বিল কেন, কার জন্য আনা হবে, আর যদি এনআরসি করাও হয়, তা হলে তৃণমূল কংগ্রেসের সমস্যা কোথায়।

গত পাঁচ বছরে এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। প্রবল মোদী হাওয়ায় এ রাজ্য থেকে একটি মাত্র আসনে (আসানসোল) জয়ী হতে পেরেছিল বিজেপি, আরেকটি আসন তারা পেয়েছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বদান্যতায়। কিন্তু তার পর থেকে এ রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অশান্তি এবং সেখানে রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে ওঠা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ক্রমেই রাজ্যে ভোটের মেরুকরণ ঘটাতে থাকে।

পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য, যেখানে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না বললেই চলে—অন্তত প্রকাশ্যে (ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল, যেমন তসলিমা নাসরিনের বই নিয়ে পার্ক সার্কাসের ঘটনা), সেখানে অন্য ধর্মের উৎসবের জন্য দুর্গাপুজোয় বিসর্জন বন্ধ করে দেওয়ার মতো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং রাজ্যের স্কুলগুলির সাধারণ প্রথা মেনে চলতে থাকা সরস্বতী পুজো বিভিন্ন স্কুলে বন্ধ করে দেওয়ার পরেও প্রশাসনিক গা ছাড়া ভাব অনেকেই ভালো ভাবে নেননি। রাজ্যে সেই অবস্থাই কাজে লাগিয়ে, সংগঠনের যতটা জোর রয়েছে বিজেপির, তার চেয়ে অনেক গুণ ভালো ফল করেছে নির্বাচনে। সেই ফল নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়াও হয়েছে। সহজ কথায়, যে সংখ্যাগুরু ভোটের ব্যাপারে এতদিন কোনও রাজনৈতিক দল গুরুত্ব দেয়নি অন্তত পশ্চিমবঙ্গে, এখন সেটাই বিজেপির কাছে সম্পদ।

২০১৬ সালের নির্বাচনে এ রাজ্যের ২৯৪টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩টি আসন পেয়েছিল বিজেপি, গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে দেখা যায় তারাই রাজ্যের মূল বিরোধীদল। তা হয়েছে ভোটের মেরুকরণের ফলেই।

নাগরিক পঞ্জীকরণের কথা বলে বিজেপির লাভ এখানেই। যে নাগরিকত্ব বিল বিজেপি এনেছে সেই বিল আইন হলে আশপাশের দেশ থেকে এ দেশে আসা মুসলমান জনগোষ্ঠীর কেউ এ দেশের নাগরিক হতে পারবেন না। সরাসরি ‘মুসলমান’ শব্দটি উল্লেখ না করলেও তার অর্থ তাই-ই দাঁড়ায়। কারণ আশপাশের যে সব দেশ থেকে এ দেশে শরনার্থী আসছেন, সেই দেশগুলিতে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু, তাই তাঁদের উদ্বাস্তু না বলে অনুপ্রবেশকারী বলছে বিজেপি (এ ব্যাপারে তারা রাষ্ট্রসঙ্ঘের দেওযা সংজ্ঞার কথাও বলছে। কারণ ধর্মরক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে কোনও মুসলমান অন্তত ভারতে আসবেন না।), অন্য ধর্মের লোকজন হল শরণার্থী।

এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ উঠতে পারে, তাঁরা মিয়ানমারে ধর্মীয় ভাবে সংখ্যালঘু। কিন্তু তাঁদের নিজেদের দেশে পাঠাতে ভারত তৎপর। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের বিষয়টি এই নাগরিকত্ব বিলের বাইরে।

অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী ও বাকিরা শরণার্থী। এনআরসির অতিসরলীকৃত রূপ এটাই, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি প্রসঙ্গ তুলে হিন্দুদের বার্তা দিতে চাইছে বিজেপি।

modi-natua_033119051359.jpgপ্রাকনির্বাচনী জনসভার আগে মতুয়া মহাসঙ্ঘের (প্রয়াত) বীণাপাণি দেবীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। (ছবি: টুইটার)

প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সময়ে অসমে এনআরসি নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল (অসম অ্যাকর্ড) বলে সরাসরি এনআরসি-র বিরোধিতা করা কংগ্রেসের পক্ষে মুশকিল। আর সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে মান্যতা দিচ্ছে বিজেপি। এই ইস্যুতে এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক ভাবে তারা সুবিধাজনক অবস্থায়।

অসমে এনআরসি-র বিরোধিতা প্রথম করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ‘বাঙালি’ প্রসঙ্গ তুলে সেখানকার বাঙালিদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তবে অনেকেই তখন বলছিলেন যে বাংলাদেশি মুসলমানরাও বাঙালি, তাই তিনি আসলে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন। এমনকি তিনি যখন তাঁর দলের একমাত্র সাংসদ ছিলেন, তখন তিনি সংসদে কী বলেছিলেন এ রাজ্যে অনুপ্রবেশ নিয়ে, সেই ভিডিয়োও ভাইরাল হতে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর অবস্থানকে কটাক্ষ করতে থাকে বিজেপি।

নাগরিক পঞ্জীকরণ কার্যকর করার পরে অসমে যে নির্বাচন হয়েছে সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস বিন্দুমাত্র সুবিধা করতে পারেনি, অর্থাৎ এটি যে তাদের কাছে বুমেরাং হবে না, সে ব্যাপারে বিজেপি মোটামুটি আভাস পেয়েই গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে মেরেকেটে সাড়ে তিনশো থেকে পাঁচশো জন মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোক আছেন, যাঁরা সরসরি মিয়ানমার থেকে সরাসরি এ রাজ্যে বা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে সরসরি এ রাজ্যে প্রবেশ করেননি, যাঁদের আনা হয়েছে দিল্লি থেকে এবং অনেকেরই পরিচয়পত্র নেই, তার বৈধতা নেই বা মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে অভিযোগ। রোহিঙ্গাদের কেন দেশছাড়া হতে হয়েছে সেই প্রশ্নও উঠেছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জঙ্গিরাও এ দেশে ঢুকে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা। দার্জিলিং জেলাতেও অনুপ্রবেশ ঘটেছে অহিন্দুদের। তাঁরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বলে মনে করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গারা এ রাজ্যের ভোটার নন, তবে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে এ রাজ্যের মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে চায় তৃণমূল কংগ্রেস। তাই লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু/ অনুপ্রবেশকারীরা কেন ইস্যু হবে, সেই প্রশ্ন তুলছে না তৃণমূল কংগ্রেসও। উল্টে তারা তাদের ভোট ব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইছে।

যদি সারা দেশের সব অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করতে হয়, তা হলে এ নিয়ে নির্দিষ্ট নীতির উপরে জোর দিতেই পারে বিজেপি, কেন উত্তরবঙ্গেই এ নিয়ে প্রচার করবে!

জাতপাতের ভিত্তিতে রাজ্যের তথাকথিত অতি নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের (নমঃশূদ্র, মতুয়া) পাশে পেতে চায় বিজেপি, তাদের কথা মাথায় রেখেও তাদের এই ঘোষণা হতেই পারে। যদিও পাল্টা হিসাবে আগেই তাঁদের উন্নয়নে বোর্ড গড়ে দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

mamata-matua_033119051428.jpg মতুয়া মহাসঙ্ঘের (প্রয়াত) বীণাপাণি দেবীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। (ছবি: টুইটার)

রায়গঞ্জের দাঁড়িভিটে গুলিতে ছাত্রের মৃত্যু ও অশান্তির কারণ শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে বাংলা বনাম উর্দুতে। বাংলার মতো উর্দুও হল ভারতীয় ভাষা, তবে তার নিজস্ব লিপি নেই, উর্দু লেখার জন্য মূলত পারসি হরফ ব্যবহার করা হয় (যেমন হিন্দি, মরাঠী, সংস্কৃত প্রভৃতি লেখার জন্য দেবনাগরী হরফ ব্যবহার করা হয়)। তবে উর্দু ভাষাকে মুসলমানদের ভাষা বলে অনেকে মনে করেন, যদিও ইসলাম ধর্মের কোনও মূল রচনা উর্দুতে নেই এবং উর্দু কবিতায় ইসলামের অনুশাসন অনেক সমযই লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়। উর্দু নিয়ে রাজ্য সরকারের কটাক্ষ করে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ করতে চেয়েছেন অমিত শাহ, আর জবাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদারমনস্ক প্রমাণ করতে চেয়েছন তৃণমূল নেতারা।

ভোটের তরজা চলছে। ক্ষমতায় এলে বাংলায় এনআরসি চালু করবেন বলে অনেক আগেই ঘোষণা করে রেখেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। যদিও তার কোনও রূপরেখা নেই, অন্তত এখনও পর্যন্ত।

ভোট মানেই ধর্মযুদ্ধ, সেখানে সকলে সকলের থেকে হিসাব চায়, লোকে জনতাকে হিসাব দেয়। কিন্তু সেই হিসাবের ভিত্তি কী? সংসদে নয়, নেতানেত্রীরা হিসাব চান জনসভায়, নেতানেত্রীরা হিসাব দেন জনসভায়। সংসদে সমস্বরে হইচই করেন। কেন করেন, সেই জবাব তাঁরা জনসভায় দেন না, কেউ চানওনা সেই জবাব।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। সেই দেশের গণতন্ত্র এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যেখানে দেশের গণ স্থির করে দেন তাঁরা কোন পক্ষে – ডাকবিভাগ রাষ্ট্রায়ত্ব থাকবে নাকি বেসরকারিকরণ ঘটবে। দেশের লোকই যদি এত গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ করে ফেলবেন তা হলে দেশের নেতা-মন্ত্রীরা কী করেন? তাঁরা দেশের লোককে শিক্ষিত করেন।

আমাদের দেশের নেতাদের নীতিগত অবস্থান হীরক রাজ্যের রাজার মতো।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment