গান্ধীর শেষ ইচ্ছা মানেনি তাঁর দল কংগ্রেস
পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণের পরেও ৫৫ কোটি টাকা তাদের দিতে বাধ্য হয় ভারত, গান্ধীর চাপেই
- Total Shares
তিনি নিজ জন্মভূমে এবং বিশ্ব জুড়ে মহাত্মা এবং বাপু নামে সমান ভাবে পরিচিত। তাঁকে জাতির জনক বলে সম্বোধন করেছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর জন্মদিন ভারতে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় এবং জাতীয় ছুটির দিন। ২০০৭ সালের ১৫ই জুন রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় ২ অক্টোবর-কে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমস্ত সদস্য দেশ তা পালন করতে সম্মতি জানায়।
গান্ধী ও তাঁর চরকা
সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে আমেরিকার সর্বোচ্চ সম্মান ‘কংগ্রেসন্যাল গোল্ড মেডেল’- মরণোত্তর সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। যা মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেওয়া 'মেডেল অব ফ্রিডম'-এর মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘স্বচ্ছতা হি সেবা অভিযান’ ঘোষণা করে শৌচালয় গড়ার কর্মসূচিতে সকলকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অন্যদিকে ১৫০তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালেই জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি ভাঙা হয়েছে কেরলে। একবার নয়, দু’বার। দ্বিতীয়বারের ঘটনা তালিপরম্বা এলাকায়, গেরুয়া কাপড়ে মুখ ঢাকা এক ব্যক্তি মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি ভেঙেছিল বলে জানান স্থানীয়রা।
বছরখানেক আগে গুজরাটে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত অ্যালফ্রেড হাই স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওই স্কুলের ১৫০জন ছাত্রের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে লিভ সার্টিফিকেট। তাদের স্থানান্তরিত করা হয়েছে করণ সিংজি হাই স্কুলে। ২০১৬ সালে গুজরাট সরকার স্কুলের জায়গায় জাদুঘর নির্মাণের ঘোষণা করেছিল। কিন্তু জায়গা কম হওয়ায় সংগ্রহালয় তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ১৮৫৩ সালের ১৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল স্কুলটি। নাম ছিল রাজকোট ইংলিশ স্কুল। পরে সেটি হাইস্কুলে উন্নীত হয়। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পরে স্কুলের নাম হয় মহাত্মা গান্ধী হাই স্কুল। স্কুলটি অ্যালফ্রেড হাই স্কুল নামেও পরিচিত। ১৮৮৭ পর্যন্ত এই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন মহাত্মা গান্ধী।
তাঁকে কেউ বলেন সত্যের পূজারী, কেউ বলেন দরিদ্রজনের বান্ধব, ভিসকাউন্ট লুই মাউন্টব্যাটন তাঁকে গৌতম বুদ্ধ ও যিশু খ্রিস্টের সমতুল্য বলেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী বলেন, “আগামী দিনের মানুষ বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে গান্ধীর মতো একজন রক্ত মাংসের মানুষ এই পৃথিবীতে হেঁটে চলে বেড়াতেন।”
রাজঘাটে গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (রয়টার্স)
সততার প্রতীক বলা হয় তাঁকে। শৈশবেই ধরা পড়েছিল তাঁর সেই গুণ; স্কুলে যেদিন মিষ্টার জাইলাস পরিদর্শনে এসে ছাত্রদের বানান লিখতে দিয়েছিল। মোহনদাস ‘কেটল’ বানানটি ভুল লিখেছিলেন, শিক্ষকের ইশারা স্বত্তেও তিনি পাশের ছাত্রটির দেখে ভুল বানান সংশোধন করেননি। জানতেন পরে শিক্ষকের বকুনি খেতে হবে, কিন্তু নিজের কাছে সৎ থাকাটা তাঁর অনেক বেশি জরুরি মনে হয়েছিল। তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের কথা বিশ্ববাসী প্রথম জেনেছিল ট্রান্সভালে যখন ‘এশিয়াটিক এক্সক্লুশন অ্যাক্ট’-এর প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন করে গান্ধী কারাবরণ করলেন।
পরবর্তীতে জাতীয় জাগরণে তাঁর অসহযোগ, সত্যাগ্রহ-সহ প্রতিটি প্রতিবাদ আন্দোলনে তিনি অহিংসা ও সততার পথেই অবিচল থেকেছেন। সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে হিংসা ও কূটনৈতিক পথের বিপরীতে শেষপর্যন্ত একনিষ্ঠ থাকার কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছেন বহুবার, ভিন্ন মত থেকে তৈরি হয়েছে ভিন্ন পথ। কিন্তু আন্দোলন যখনই অহিংসা বা সত্যের পথ থেকে সামান্য সরে এসেছে গান্ধী প্রতিবাদ স্বরূপ সেই আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। থামিয়ে দিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলন, তবে সত্যনিষ্ঠ থেকেছেন মহান আত্মাধারী গান্ধী স্বদেশী সরকারের অন্যায় মনোভাবের বিরুদ্ধে। এমনকি সদ্য সবাধীনতা পাওয়া দেশবাসী যখন তাঁর জন্মদিনে তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে চায় তখন দাঙ্গা বিদ্ধস্ত সদ্যোজাত স্বাধীন রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু মিছিল উপলক্ষ্য করে গান্ধী বলেছিলেন, এই সময় তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার চেয়ে শোকজ্ঞাপন করাই শ্রেয়। কারণ এই মুহূর্তে তাঁর মৃত্যু ইচ্ছাই প্রবল।
গান্ধী মনেপ্রাণে স্বাধীন রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু, দাঙ্গার মতো অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি মেনে নিতে পারেননি। ওই বছরই ২৩ অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদাররা মহারাজা হরি সিংয়ের কাশ্মীরের ভারতভুক্তির আবেদন এবং শেখ আবদুল্লার ওই আবেদনে সমর্থন জানানোর কারণে কাশ্মীর আক্রমণ করে। পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে নতুন দেশের সরকার পালটা ব্যবস্থা নেয় এবং তাদের প্রতিহত করতেও সমর্থ হয়।
গান্ধী হয়তো হানাদারদের এহেন আচরণ একেবারেই বরদাস্ত করতে পারেননি কিন্তু ভারত সরকার যখন উচিত শিক্ষা দিতে পূর্বশর্ত অনুযায়ী পঞ্চান্ন কোটি টাকা পাকিস্তানকে ফেরত না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, গান্ধী তখন তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিছুতেই সরকারের এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের আচরণ তিনি মেনে নিতে পারেন না। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েই গান্ধী বলেন, এই সিদ্ধান্ত কেবল অসৎ নয় প্রতিহিংসাপরায়ন মনোভাব।
এ কথাও গান্ধী বলেন, এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ জেনে বুঝে কথার খেলাপ করলে যেমন প্রতিহিংসাপ্রবণ মনোভাব সামনে আসে তেমনি তা দু’টি রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিঘ্ন ঘটায়। কিন্তু গান্ধীর মৌখিক আপত্তিতেও ভারত সরকার তার নিজের সিদ্ধান্তেই অচল থাকল। এতে যথেষ্টই বিরক্ত হন গান্ধী, বাধ্য হয়েই সত্যের পূজারীকে অসত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হয়।
এতদিন তাঁর প্রতিবাদ-আন্দোলন ছিল বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে এবার তাঁর প্রতিবাদ স্বদেশের সরকারের বিরুদ্ধে। নিজের দেশের সরকার হলেও ওই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি নীতিহীন এবং নিয়মহীন, তাই ১৩ জানুয়ারি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে গান্ধীকে ফের আমরণ অনশনে বসতে হয়। প্রশ্ন ছিল বয়সের কারণে তিনি কি আগের মতোই ধকল সহ্য করতে পারবেন? স্বাভাবিক প্রশ্ন, কিন্তু সততা আর ন্যায়ের জন্য যে সত্যাগ্রহীর প্রাণ নিবেদিত, তার উদ্যম আর নিষ্ঠাকে সেদিনও চিনতে পারেনি তাঁর নিজের দেশের মানুষ এবং সরকার। গান্ধী কিন্তু তাঁর নিজের বয়স আর শরীরের অবস্থা সেদিন ভালই জানতেন, তাই সেই বয়স আর শারীরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখেই তিনি নিজের জীবনকে বাজি ধরেছিলেন।
কিসের কারণে? কেবলমাত্র শান্তি এবং সম্প্রীতির আশায়, যা সেই সময়ে দুই রাষ্ট্রের জন্য ছিল জরুরি। যথারীতি তাঁর স্বাস্থ্যের অবণতি ঘটতে থাকল আর প্রতিক্রিয়া ঘটল উলটো। ফের স্বাধীন দেশের মানুষ ভীষণভাবেই তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠল। কেবল দেশবাসী বললে ভুল হবে চিন্তিত হয়ে পড়ল পাকিস্তানের মানুষও। গান্ধীর জন্য দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ন ভুলে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল দু’দেশের মানুষ। ভেদাভেদ সাময়িকভাবে হলেও মুছে গেল, সম্প্রীতির এক বাতাবরণ তৈরি হল। শেষ পর্যন্ত কিন্তু গান্ধীই সফল হলেন। তাঁর জেদের কাছে তো নয়, সততা ও অহিংসার কাছে হার মানতে বাধ্য হল ভারত সরকার। পূর্বপ্রতিশ্রুতিও রক্ষা করল তারা, রক্ষা পেল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
পাকিস্তানের একটি জাদুঘরে রক্ষিত গান্ধী ও জিন্নার মূর্তি
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল দুঃখজনক ঘটনা আর অপ্রীতিকর পরিস্থিতি কিছুতেই যেন গান্ধীর পিছু ছাড়ে না। তাঁর একান্ত ইচ্ছা ছিল কিছুদিন সেবাগ্রামে থেকে অস্থায়ী ভাবে পাকিস্তানে বসবাস করবেন। তাঁর ইচ্ছার কথা জানতে পেরে জিন্না খুশি হয়ে তাঁকে স্বাগত বার্তা পাঠিয়েছিলেন। দু’দেশের মধ্যে শান্তি আর মৈত্রীর বাতাবরণ তৈরি হতে এর থেকে অভিনব প্রয়াস আর কি হতে পারে।
কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদীদের আর রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানীদের কাজই হল মৈত্রী, সম্প্রীতি, মানবিক প্রচেষ্টাগুলিকে যত বেশি সম্ভব নস্যাৎ করে দেওয়া। তখনও সে রকমটাই ঘটল, একবার তো নয় একাধিকবার। প্রথমবার পাঞ্জাবি উদ্বাস্তু মদনলাল গান্ধীকে মেরে ফেলতে বোমা ছুড়লেন। কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেন গান্ধী। কিন্তু গান্ধীর শেষ ইচ্ছে আর পূরণ হল না। পাকিস্তানে তাঁর বসবাস স্থগিত হল যদিও তিনি মদনলালকে শাস্তি না দেওয়ার জন্য কড়া নির্দেশ দিলেন এবং তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানালেন।
লক্ষ্য করার ব্যাপার, ঠিক এ রকম সময়েই গান্ধী কংগ্রেস দলের জন্য নতুন পথের দিশাটি তৈরি করেছিলেন। আর সেটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ লেখা ইচ্ছাপত্র বা টেস্টামেন্ট। এখানেই গান্ধী কংগ্রেস দলকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলার কথা লেখেন। ভেঙে ফেলা বা দেওয়ার মানে তিনি যেভাবে ব্যাখা করলেন- দল হিসাবে কংগ্রেসের চরিত্র পুরোপুরি রাজনৈতিক সেই চরিত্রের আপাদমস্তক রদবদল। তাঁর ভাষায়, “ক্ষমতার রাজনীতি থেকে পুরপুরি বেরিয়ে এসে কংগ্রেস দল হয়ে উঠুক লোকসেবক সঙ্ঘ। যে দল ক্ষমতার কেন্দ্রে নয়, জনগনের সেবার জন্য নিয়োজিত হবে সেবামূলক সংগঠন সিসাবে।”
ওয়ার্ধায় যে কুটিরে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়, সেখানেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, সনিয়া গান্ধী ও তাঁর পুর্ত কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী (পিটিআই)
২৯ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত ওই ইচ্ছাপত্রটি বেশ কয়েকবার পড়া, সম্পাদনা, সংযোজনার পরও শেষপর্যন্ত বা কার্যত আর পেশ করা হয়নি। তবে একথা বলা কোনও ভাবেই ভুল হবে না যে গান্ধী তখনই কংগ্রেস দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা সংঘাতকে দেখতে পেয়েছিলেন। এরপর তো খুব বেশি সময় লাগেনি সেই দ্বন্দ্ব কিংবা সংঘাত শিরা ধমনী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়তে।
তিনি অবশ্য একথাও বলেছিলেন কংগ্রেস রাজনৈতিক দল সগঠিত হয়েছিল স্বাধীনতার লক্ষ্যে তা পূরণ হওয়ার পরই দলের রাজনৈতিক চরিত্র দ্রুত প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। অতএব ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার চেয়ে শ্রেয় পথ মানুষের মধ্যে চলে আসা। কিন্তু দলের নেত্রীবৃন্দের কি আর তাঁর শেষ ইচ্ছা মনঃপূত হতে পারে? কখনোই নয়, কিছুতেই নয়। তাই জাতির জনক মহাত্মার ইচ্ছা বা চাওয়াকে তাঁর দেশ, কংগ্রেস দল – কেউই গুরুত্ব দেয়নি।