মালদ্বীপের সাধারণ নির্বাচন: ভারত কী কী করতে পারে?
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের প্রথমেই উচিত মালদ্বীপকে সাধুবাদ দেওয়া
- Total Shares
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রপ্রেমীরা এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করতে পারতেন না। মালদ্বীপের সাধারণ নির্বাচন ফলাফল যে ভাবে অপ্রত্যাশিত ভাবে শাসক দলের বিরুদ্ধে গেল তা অবশ্যই গণতন্ত্রের পূজারীদের নতুন করে স্বস্তি দেবে।
গত রবিবার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল দ্বীপরাষ্ট্রে যখন দেশের জনগণ আব্দুল্লা গায়ুম ইয়ামিনের পাঁচ বছরের বিতর্কিত জমানার অবসান ঘটাল। নির্বাচনে জয়ী হলেন বিরোধী জোটের প্রার্থী ইব্রাহিম মহম্মদ সোলি।
এই নির্বাচনের দিকে অধীর আগ্রহে চোখ রেখেছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মালদ্বীপের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো। আন্তর্জাতিক মহলে এই নির্বাচনকে খুব ছোট করে 'গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এই পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে জানিয়েছেন যে আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেবেন। এর ফলে, মালদ্বীপের গণতন্ত্র নতুন জীবন পেতে পারে।
বেশ কয়েকটি কারণে রবিবারের নির্বাচনটি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত ইয়ামিন [সৌজন্যে: ইয়েমিনের দপ্তর]
নির্বাচন কমিশন বা বিচারব্যবস্থার মতো দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কে দমন করে রেখে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে, দেশের সমাজকর্মী ও বিদ্বজনদের উপর আক্রমণ করে, বিরোধীদের সদর দপ্তরে নিয়মিত পুলিশ পঠিয়ে বর্তমানে পরাজিত রাষ্ট্রপতি এই নির্বাচন জিততে সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। এই নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটও রয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর দুই বিচারপতিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া, ইয়ামিন তাঁর সৎভাই মাউমুন গায়ুমকেও গ্রেফতার করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, এই নির্বচনের সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক অদ্ভুত মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছিল। বস্তুত, ইয়েমিনের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক নেতাই একজোট হয়ে ছিলেন।
দেশের নির্বাচন কমিশন সে দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাশিদের প্রার্থীপদ খারিজ করে দেওয়ার পর ইয়েমেনের চির-প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামত আধালথ পার্টি সহ সমস্ত বিরোধী দল একজোট হয়ে মালদিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী সোলিকে সমর্থন করেছিল।
তৃতীয়ত, এই নির্বাচনে বিপুল অর্থ ও শক্তির ব্যবহার করা হয়েছে যার সিংহভাগ চিন জুগিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, ইয়েমেনের শাসনকালে এই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ভারতকে সরিয়ে চিনের সমর্থক হয়ে উঠেছিল। চিন শুধুমাত্র এ দেশের পর্যটন শিল্পে বিপুল বিনিয়োগ করেছে তা নয়, চিন ও এই দ্বীপরাষ্ট্রের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে।
মালদ্বীপের মোট ঋণের পরিমাণের ৭০ শতাংশই চিনের। সব মিলিয়ে চিন নিয়ে বেশ ফাঁপরেই রয়েছে মালদ্বীপ।
নতুন রাষ্ট্রপতি কি মালদ্বীপে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন? [ছবি: রয়টার্স]
পরিশেষে এই নির্বাচনের আগে দেশের বিদ্বজনের একপ্রকার নবজন্ম ঘটেছিল বলে বলা যেতেই পারে। সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকরা ইয়েমেনের মুখোশ খুলে দিতে সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। সব চেয়ে বড় কথা নির্বাচনের দিন যে ভাবে ভোটাররা সাড়া দিয়েছিলেন তা অভূতপূর্ব। একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটাতে প্রায় ৯০ শতাংশ ভোটদান হয়েছিল।
সামনে রাস্তা অনেকটাই সর্পিল
মালদ্বীপের নতুন রাষ্ট্রপতি নভেম্বরে ক্ষমতাসীন হবেন। তাঁর সামনে এখন বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আনতে গেলে তাঁকে এখন কঠিন লড়াইয়ে সামিল হতে হবে। নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের বেশ কয়েকজন আধিকারিক খোলাখুলি ইয়েমেনের হয়ে গলা ফাটিয়েছেন। তাই সোলিকে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার ঢেলে সাজতে হবে যা ইয়েমেন জমানায় রবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছিল।
এবারের নির্বাচনে না থেকেও ছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাহিদ [ছবি: রয়টার্স]
সোলির দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জ জোট শরিকদের একত্রিত করে রাখা। কারণ এই জোটের জীবনায়ু নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। দেশের দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গায়ুম ও মহম্মদ নাশিদ ছাড়াও এই দুই বিপরীত মেরুর দুটি দল এই জোটে রয়েছে। এই দলগুলোর একটি হল মুসলমান মৌলবাদী আধালথ পার্টি আর অন্যটি দেশের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী কাসিম ইব্রাহিমের জুমহুরি পার্টি।
সবচেয়ে কঠিন কাজটি হল এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা - এক ভারত দুই চিন।
ছুটি উপভোগের ফুরসৎ নেই নতুন প্রেসিডেন্টের [ছবি: টুইটার]
চিনের প্রচুর প্রকল্প এখন মালদ্বীপে রূপায়িত হচ্ছে, তার উপর দেশের ঋণের পরিমাণের ৭০ শতাংশ চিনের। তাই সোলির পক্ষে সে দেশে চিনের প্রভাব কমানো খুব সহজ হবে না।
ভারত কী করতে পারে
মালদ্বীপের নির্বাচনের ফলাফল সে দেশের দ্বিতীয়বারের জন্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে। প্রথমবার গণতন্ত্র এসেছিল ২০০৮ সালে যখন রাজনৈতিক কর্মী মহম্মদ নাশিদ স্বৈরাচারী আব্দুল গায়ুমকে পরাজিত করেছিলেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ও মালদ্বীপের এককালের কাছের বন্ধু ভারত এখন আবার এই দ্বীপরাষ্ট্রের গণতন্ত্রে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পাবে। এই মুহূর্তে দেশের বিরোধী নেতাদের সঙ্গে ভারতের অসাধারণ সম্পর্ক। সে দেশে যখন ৪৫ দিনের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল তখন ভারত ওই বিষয়ের ভিতর নাক না গলিয়ে উচিত কাজই করে ছিল। তা করলেও এই নির্বাচনে ভারত বিরোধী হয়ে ওঠার ইস্যু তৈরি করতেন ইয়ামিন।
নেপাল পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ভারতের [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
দিল্লি অবশ্য নেপাল থেকে শিক্ষা নিয়ে মালদ্বীপের ইস্যুতে ধীরে চল রীতি নিয়েছে।
ভারত এও বুঝতে পারছে যে এই নির্বাচনের ফলাফলে মালদ্বীপ যে চিনের হাতছাড়া হয়ে গেল এমনটাও ভাবার কোনও কারণ নেই।
সহজ-সরল ভাষায় এক বিখ্যাত বিশ্লেষক জানিয়েছেন, “আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে হিংসা না করে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত ভারতের।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

