মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয়পাত্রী ভারতী ঘোষের এই পরিণতি হল কেন?

এক জন পুলিশ সুপার একটি জেলায় দু'বছর থাকেন, ভারতী সেখানে ছ'বছর রাজত্ব চালিয়ে গেলেন

 |  3-minute read |   21-03-2018
  • Total Shares

ক্ষমতা দখলের জন্য তৃণমূলের দুটি পন্থা রয়েছে। এক হয় টাকা, নয়তো সরকারি মেশিনারি প্রয়োগ করে সরকারি মদতে রাজ্য জুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। আর এই দ্বিতীয় কাজটি করতে গেলে পুলিশ প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় রাখতে হবে। তাই তৃণমূল সরকারের আমলে সৎ, নিষ্ঠাবান ও দোর্দণ্ডপ্রতাপ আইপিএস অফিসাদের সাইডলাইনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যাঁরা কর্মস্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না, শুধুমাত্র তৃণমূল নেতানেত্রীদের অঙ্গুলিহেলনে চলেন তাঁদেরই পোয়া বারো।

সারদা মামলা দেখুন। সে সময় বিধাননগর কমিশনারেটের মাথায় ছিলেন রাজীব কুমার নামক এক আইপিএস অফিসার। কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন অর্ণব ঘোষ। মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ সফল ভাবে লোপাট করে দিয়েছেন রাজীব-অর্ণব জুটি। তৃণমূল সরকার কিন্তু এদের পুরস্কার দিতে কোনও দ্বিধা করেনি। অর্ণব ঘোষ এর পরে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল হয়েছেন। আর, রাজীব কুমার তো কলকাতার পুলিশ কমিশনার।

পুলিশ মেশিনারি দিয়ে রাজ্য শাসনের পন্থা প্রয়োগ করতেই পশ্চিম মেদিনীপুরে ভারতী ঘোষকে ব্যবহার করা হয়। মুখ্যমন্ত্রীর সান্নিধ্য পেয়ে ওই জেলার বেতাজ বেগম হয়ে ওঠেন ভারতী। বলতে গেলে জেলায় নিজের মৌরসিপাট্টা কায়েম করে সমান্তরাল 'তৃণমূল' চালাতে শুরু করে দেন তিনি। নিয়মানুযায়ী, এক জন পুলিশ সুপার একটি জেলায় মাত্র দু'বছরের জন্য দায়িত্বে থাকেন। ভারতী সেখানে ছ'বছর ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরে রাজত্ব চালিয়ে গেলেন। সম্পর্ক চিড় ধরল বলে, নয়তো আরও কয়েক বছর ওই জেলার মসনদে ভারতীকে দেখা যেত।

body_032118112816.jpgপুলিশ মেশিনারি দিয়ে রাজ্য শাসন করতেই পশ্চিম মেদিনীপুরে ভারতী ঘোষকে ব্যবহার করা হয়

পশ্চিম মেদিনীপুরে থাকার সময় কী না করেছেন তিনি? তিনিই ঠিক করে দিতেন সেই জেলার তৃণমূলের বিভিন্ন পদে কাকে কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। নকশাল নেতা যাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যার অভিযোগ রয়েছে তাদের তৃণমূলে অন্তর্ভুক্ত করলেন। যেমন জাগরী বাস্কে, সুচরিতা মাহাত ও কাঞ্চনের মতো মাওবাদীরা। এদের মধ্যে কয়েকজন তো সিভিক পুলিশে নিয়োগও করে দিয়েছেন ভারতী, কাঞ্চনের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।

এত কিছুর পরেও অবশ্য শেষরক্ষা হলো না। মূলত দুটি কারণে। নিজের আস্ফালন দেখতে গিয়ে জেলার তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের বিরাগভজন হয়ে পড়েন তিনি। এই তালিকায় জেলার বিখ্যাত অধিকারী পরিবারও রয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে নিজের ভাইপোর মুকুট পাকা করতে শুভেন্দু অধিকারী ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগসাজস করতে বাধ্য হন মমতা। নিঃসন্দেহে, তামাম মেদিনীপুরে শিশির, শুভেন্দু ও শুভেন্দুর ভাইদের যথেষ্ট ভালো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। জেলায় কে শেষ কথা বলবেন -এর আগে এই নিয়ে শুভেন্দুর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

মানস ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করে কংগ্রেস বিধায়কের শত্রু হয়ে ওঠেন ভারতী। এই মানস যখন তৃণমূলে যোগ দিলেন তখন তাঁর নাম সেই মামলার চার্জশিট থেকে বাদ পড়ে। মানসের সঙ্গে শুভেন্দুর সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। কিন্তু ভারতী উভয়েরই শত্রু। তাই নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে ভারতীর বিরুদ্ধে একজোট হন মানস-শুভেন্দু।

body1_032118113013.jpgমানসের সঙ্গে শুভেন্দুর সম্পর্ক ভালো না হলেও ভারতীর বিরুদ্ধে একজোট হন দু'জনে

এর পর মানসের স্ত্রী যখন বিধানসভা উপনির্বাচনের তৃণমূল প্রার্থী হলেন তখন ভারতীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল তিনি নাকি শত্রু শিবিরের লোকের মতো আচরণ করেছিলেন। মানস-শুভেন্দু এক থাকায় ভারতীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হল মমতাকে। তিনি পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে দিলেন ভারতীকে। এই অপসারণ মেনে নিতে না পেরে রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থর কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিলেন ভারতী। ভারতীর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বদলাবার সব রকম চেষ্টাই করেছিলেন ডিজি। কিন্তু তাতে চিড়ে ভেজেনি। এবং পদত্যাগের পর থেকেই তৃণমূল সরকার সরাসরি ভাবে 'মিশন ভারতী' শুরু করে দিলেন। সিআইডি মামলা রুজু করল ভারতীর বিরুদ্ধে।

মামলাটিতে ভারতীর বিরুদ্ধে কোনও সরাসরি অভিযোগ আনা হয়নি। বলা হয়েছে, এক ব্যবসায়ীর থেকে নিচুতলার পুলিশকর্মীরা তোলা তুলেছিলেন, অভিযোগ জানানো সত্বেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন ভারতী। লম্বা দৌড়ে এই ধরণের মামলায় কোনওদিনও ভারতীকে দোষী স্যাবস্ত করা যাবে না, তবে সাময়িক ভাবে হেনস্থা করা যেতেই পারে। এমনকি, কিছুদিনের জন্য হাজতবাসও করান যেতে পারে। তাই বা কম কী?

পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকদের কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখলের লড়াই এই রাজ্যে নতুন নয়। আর তৃণমূল তো প্রয়োজন ফুরোলে নিকটজনকে ছুড়ে ফেলতে সিদ্ধহস্ত। আগেও হয়েছে, ভারতীর ক্ষেত্রেও হল, ভবিষ্যতেও হবে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARUNAVA GHOSH ARUNAVA GHOSH

The writer is a veteran Congress leader and senior advocate.

Comment