ব্রিগেডে পরিবর্তনের ডাক, এ বার কেন্দ্রে অরাজক সরকারের বিরুদ্ধে

বিদায়বেলার ঘণ্টা যখন বেজেছে তখন কেন্দ্রীয় সরকার তার ভুল বুঝতে পেরেছে

 |  6-minute read |   12-01-2019
  • Total Shares

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা স্লোগান দিয়েছিলেন যে ‘উনিশে ফিনিশ’।

কেন্দ্রীয় সরকার একের পর জনবিরোধী নীতি নিয়ে চলেছে, এর ফলে দেশের জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিপর্যয় মানে শুধুমাত্র আর্থিক বিপর্যয় নয়, সামাজিক বিপর্যয়ের বাতাবরণও তৈরি হয়েছে। দু’-একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন নোটবন্দি, জিএসটি, এবং প্রায় দেউলিয়া আর্থিক অবস্থা। কারণ, একটি হিসাব অনুযায়ী নোটবন্দির ফলে দেশের বৃদ্ধির হার ২ শতাংশ মতো কমে যাওয়ায় আর্থিক বিচারে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লক্ষ কোটি টাকার মতো। অর্থনীতিবিদদের মতে অন্তত পক্ষে আড়াই কোটি মানুষ রোজগার হারিয়েছেন। এবং যে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে বছরে ২ কোটি মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা করা হবে, সেখানে সরকারি পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে যে বছরে মোটামুটি ভাবে দু’লক্ষের বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না।

mamata_banerjee_itb_011219045022.jpegব্রিগেড থেকে কেন্দ্রে পরিবর্তনের ডাক দিতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি/ফাইল: ইন্ডিয়া টুডে)

দেশের আমদানি বেড়েছে রফতানি কমেছে, ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণও বিপুল। ব্যালান্স অফ পেমেন্টের গভীর ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকারি ভাঁড়ার শূন্য। কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের পরিমাণ ২৭০২৯.৭৩৮ কোটি মার্কিন ডলার! তা ছাড়া কৃষিঋণ মকুব করলে (যে সরকারই তা করুক) তাতে প্রান্তিক কৃষকদের কোনও উপকার হয় না। বাস্তবে এটি সম্পূর্ণ ভাবে করদাতাদের অর্থের অপচয়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই পথে না হেঁটে এমন পদক্ষেপ করেছে যাতে কৃষকদের উপকার হয়। রাজ্য সরকার কৃষকদের জন্য কার্ড করে দিয়েছে যার মাধ্যমে তাঁরা সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে প্রয়োজন মতো ঋণ নিতে পারেন। আমাদের রাজ্যের মডেল যদি কেন্দ্রীয় সরকার অনুসরণ করত তা হলে প্রান্তিক চাষিদের উপকার হত।

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে পণ্য ও পরিষেবা করের নিম্নমাত্রা ২০ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ বিদায়বেলার ঘণ্টা যখন বেজেছে তখন সরকার তার ভুল বুঝতে পেরেছে। প্রথম থেকে আমাদের যে দাবি ছিল, এখন সেই দাবি সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে বিশ্বের তাবড় অর্থনীতিবিদ – সকলেই বলেছেন যে ভারতে যে হারে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) নেওয়া হয়, বিশ্বের অন্য কোনও দেশে সেই হারে নেওয়া হয় না (সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ পর্যন্ত হারে ভারতে জিএসটি নেওয়া হয়)। এখন যখন সেই হার কমানো হল তা হলে সরকার বিবৃতি দিয়ে বলুক যে তারা ভুল করেছে। সরকার যদি ভুল স্বীকারও করে, তা হলেও সমস্যা মিটবে না। কারণ জিএসটি ও নোটবন্দির ফলে দেশের হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে, ছোট ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে... তাঁদের কী হবে? তাঁদের পুনরুজ্জীবন তো আর সম্ভব নয়!

জিএসটি কাউন্সিলের চেয়্যারম্যান ছিলেন এ রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তিনি বারে বারে করের এই হার কমানোর সুপারিশ করেছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও তিনি বলেছিলেন। তাঁর কথা শোনা হয়নি। কোনও রকম সমীক্ষা ও পর্যালোচনা না করে তড়িঘড়ি নোটবন্দি এবং পণ্য ও পরিষেবা কর আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং অত্যধিক হারে নতুন কর ব্যবস্থা চালু করে দেওয়া হল শুধুমাত্র সংখ্যাধিক্যের জোরে।

modi_body_011219045159.jpgনরেন্দ্র মোদী: নোটবন্দি ও জিএসটির ফলে নিম্নমুখী হয়েছে বৃদ্ধির হার (ছবি/ফাইল)

অবৈজ্ঞানিক ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তা বুঝতে পারছে তিন রাজ্যে শাসকদলের পরাজয়ের পরে। এখন কাঠামোর পরিবর্তন করা মানে কার্যত নিজের ভুল স্বীকার করে নিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। তবে সেটি ভোটের মুখে।

জিএসটি চালু করার পরে রাজস্ব সংগ্রহও কমেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় বছর বছর কমেছে। গত তিন বছরের জিএসটি বাবদ প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ দেখলেই বোঝা যাবে কী হারে ব্যবসা কমেছে, কারণ ব্যবসা নেই। সরকার যখন ভুল বুঝতে পারছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। নোটবন্দির সিদ্ধান্ত ফেরানো সম্ভব নয়, তাই পণ্য ও পরিষেবা করে পরিবর্তন করে জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ জন্যই লোকসভার বেশিরভাগ উপনির্বাচনে পরাজিত হয়েছে কেন্দ্রের শাসকদল, তাদের আসন সংখ্যা ২৮২ থেকে কমে ২৭২ হয়েছে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি সামাজিক বিপর্যয়েরও সম্মুখীন হয়েছে দেশ। লাভ জেহাদ-এর বিরোধিতার নামে উত্তরপ্রদেশে যা খুশি হচ্ছে, বিজেপি-শাসিত অন্য রাজ্যগুলোতেও কোনও পার্থক্য নেই। যারা হিংসা ও প্রতিহিংসাকে সমর্থন করছে তারা কেন ফৌজদারি আইনের আওতায় পড়বে না? আমাদের সমাজে মধ্যযুগীয় বীভৎসতা দেখা দিচ্ছে। যে ভাবে গোরক্ষক তৈরি হয়েছে, মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে তাতে আগামী দিনে সতীদাহ প্রথা ফিরিয়ে আনার দাবিও করতে পারে এরা।

মুখে আদালত মেনে চলার কথা বললেও বাস্তবে কী করা হচ্ছে? মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে বলে সুপ্রিম কোর্টের উপরে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। শবরীমালা মন্দির নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত যখন রায় দিচ্ছে যে ঋতুমতী মহিলাদের সেই মন্দিরে ঢুকতে কোনও বাধা নেই, তখন সেই মন্দিরে মহিলাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ঢুকতে দিচ্ছে না বিজেপি-আরএসএস-বজরং দল-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।

ধর্মনিরপেক্ষতার কথা দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই রয়েছে, তাকে সরকার বাস্তবায়িত হতে দিচ্ছে না। দেশে এমন অসামাজিক প্রবণতা ভয়ঙ্কর দিকে যাচ্ছে রাজনৈতিক মদতে, কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকদলের মদতে। এর ভয়াবহ পরিণাম দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

mamata-smallpt_011219044302.jpgমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সরব  (ছবি/ফাইল: পিটিআই)

দেশ যখন এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে তখন ব্রিগেডে সমাবেশের ডাক দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগেই তিনি সমাবেশের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ঘোষণা করার সময়ই বলেছিলেন যে বিজেপি ব্যতীত সমস্ত দলকেই সেই সমাবেশে ডাকা হবে। এটি তৃণমূল কংগ্রেসের ডাকে রাজনৈতিক সভা। সভা ঘোষণার পরেই অনেকেই জানিয়ে দেন যে ডাকলেও তাঁরা আসবেন না, তাই তাঁদের ডাকার কোনও প্রশ্ন নেই।

এই সমাবেশে ডাকা হয়েছে কংগ্রেস, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, স্ট্যালিনের ডিএমকে, কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের তেলেঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতি, চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগুদেশম পার্টি, ওমর আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স, দেবগৌড়ার জনতা দল-সেকুলার, শরদ পওয়ারের এনসিপি,  শরদ যাদবের লোকতান্ত্রিক জনতা দল, উদ্ধব ঠাকরের শিব সেনা প্রভৃতি দলকে। আমার ধারনা আমন্ত্রিত প্রতিটি দলের প্রতিনিধিই এই জনসভায় উপস্থিত থাকবেন। দলের শীর্ষনেতা কোনও কারণে না আসতে পারলে তিনি তাঁর প্রতিনিধিকে পাঠাবেন।

modi-jaitley-reuters_011219044458.jpgঅর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী  (ছবি/ফাইল: রয়টার্স)

এই প্রথম ভারতের বুকে কলকাতায় ঐতিহাসিক ব্রিগেড ময়দানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে দেশের প্রায় সমস্ত বিরোধী দলের প্রধান নেতানেত্রী আসছেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে, যেখানে আর ১০০ দিন পরে নির্বাচন হতে চলেছে, সেখানে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সমাবেশ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের সেই সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষ, গরিব মানুষ যাঁরা এই সরকারের আমলে কাজ হারিয়েছেন, কৃষক – যাঁদের অনেকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন, কর্মহীন শ্রমিক বা বেকার—যাঁদের ভাঁওতা দেওয়া হয়েছিল বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থানের, নির্যাতিত নারী সম্প্রদায় – তাঁদের কাছেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দেবেন যে এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। কারণ এই সরকার সব অর্থেই জনবিরোধী সরকার, এই সরকার আইন ও সংবিধানের তোয়াক্কা করে না।

এই সমাবেশ প্রায় অভূতপূর্ব। ১৯৮৯ সালে শহিদ মিনারে বিরোধীদের একটি সভা হয়েছিল। সেই সমাবেশে জ্যোতি বসু, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, অটলবিহারী বাজপেয়ীরা সমাবেশ করেছিলেন। তখন প্রধান উদ্যোগ ছিল বামফ্রন্ট বা সিপিএমের। তখন জাতীয় স্তরে বিকল্প খোঁজার উদ্যোগ এসেছিল সিপিএমের কাছ থেকে। আর সেই সিপিএম শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের রাজনীতিতেও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এবার বিরোধীদের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে ভারতের প্রায় সব বিরোধী দলের তাবড় তাবড় নেতানেত্রী আসছেন।

আমাদের বিশ্বাস, এই সমাবেশ থেকে সারা দেশের মানুষের কাছে নির্বাচনের প্রাক্কালে যে বার্তা বা আহ্বান পৌঁছাবে তা নিঃসন্দেহে সমস্ত বিরোধী দলের কর্মীদের উজ্জীবিত করবে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যে হতাশা ও যন্ত্রণা রয়েছে, সেই হতাশা ও যন্ত্রণার জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা নতুন আলোর দিশা দেখাবে। সেই নতুন আলো হল পরিবর্তনের আলো।

যেমন ভাবে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাহুর গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়েছিল, এবার ভারতের মানুষ, বিশেষ করে যুব সম্প্রদায় – যাঁদের বার বার প্রতারিত করা হয়েছে মিথ্যা কথা বলে, কৃষক সম্প্রদায় – যাঁদের প্রতারিত করা হয়েছে মিথ্যা কথা বলে, তাঁরা সকলেই বর্তমান জনবিরোধী সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেতে আগ্রহী, এই সমাবেশ তাঁদের মনে নিঃসন্দেহে আশার সঞ্চার ঘটাবে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUKHENDU SEKHAR RAY SUKHENDU SEKHAR RAY @sukhendusekhar

Deputy Leader and AITC Chief Whip, Rajya Sabha.

Comment