লন্ডনে বিক্ষোভের সামনে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী

ভারতীয়রা নিজেদের ঘরের কথা বাইরের লোককে খুব একটা বলতে চান না

 |  4-minute read |   20-04-2018
  • Total Shares

চারদিনের সফরে ১৮ই এপ্রিল লন্ডনে পা দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রী ইংল্যান্ডে পৌঁছান ইস্তক মোদী বন্দনায় মুখরিত হয়ে পড়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। 'লন্ডনেও মোদীর জন্য বাড়ির খাওয়ারের আয়োজন' বা 'লন্ডনে রাজকীয় সংবর্ধনার মাধ্যমে স্বাগত জানানো হল মোদীকে' এই ধরণের খবর দেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যম ফলাও করে প্রকাশ করেছে। কিন্তু বিলেতের রাজধানীতে মোদীকে আসলে কী ভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে, তা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে দেশের প্রচারমাধ্যম। সত্যি কথা বলতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে লন্ডনে নেমে বেশ কয়েকটি রূঢ় বাস্তবের সম্মুখীন হতে হয়েছে।

ব্রিটেনের বেশির ভাগ ওয়েবসাইট ও টিভি চ্যানেলগুলোও যখন মোদীর সাদর অভ্যর্থনা বা ভারত-যুক্তরাজ্য মৈত্রী নিয়ে খবর প্রকাশে ব্যস্ত, তখন সংবাদসংস্থা রয়টার্স একটি খবরে জানিয়েছে, "মোদী লন্ডনে পৌঁছাতেই কয়েকশো আন্দোলনকারী মোদী বিরোধী স্লোগান তুলে তাঁকে সে দেশে স্বাগত জানিয়েছেন।" খবরের প্রকাশ, এই আন্দোলনকারীরা "কাঠুয়া ও উন্নাওতে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ কাণ্ড ও ভারতে ক্রমাগত বাড়তে থাকা যৌন নির্যাতন নিয়ে মোদীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।"

এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে বিজেপির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে যে, দলের পক্ষ থেকে নাকি এই দুই ধর্ষণ কাণ্ডের অভিযুক্তদের আড়াল করবার চেষ্টা চলছে। উন্নাও কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত খোদ উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেনগর। উল্টোদিকে, জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়া কাণ্ডে অভিযোগের তির আটজন হিন্দুর দিকে, তাঁরা নাকি এক আট বছরের মেয়েকে গণধর্ষণ করেছেন যাতে যাযাবর বাকওয়ারবল মুসলমান সম্প্রদায়কে জম্মু থেকে উৎখাত করা যায়।

body_042018023222.jpgলন্ডনে টেরেসা মে ও নরেন্দ্র মোদী [ছবি: রয়টার্স]

রয়টার্সের খবর অনুযায়ী ডাউনিং স্ট্রিট ও সংসদ ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভকারীরা মোদীর উদ্দেশ্যে "প্ল্যাকার্ড দেখিয়েছেন যেগুলোতে লেখা ছিল মোদী ফিরে যান' বা 'মোদীর বিদ্বেষমূলক অবস্থান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে আমাদের এই প্রতিবাদ'। এই বিক্ষোভের মধ্য দিয়েই টেরেসা মের সঙ্গে বৈঠক করতে গেলেন মোদী।

ভারতের সংবাদমাধ্যম যে খবরগুলো প্রকাশ করতে অপছন্দ করে, সেগুলোই ফলাও করে প্রকাশ করল বিলেতের বিখ্যাত সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান সংবাদপত্রে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে যার শিরোনাম, 'ভারতীয় প্রজাতন্ত্র এখন শঙ্কিত'। সম্পাদকীয়তে দাবি তোলা হয়েছে যে, যুক্তরাজ্যর উচিৎ মোদীকে চাপে রাখা।

প্ৰধানমন্ত্ৰী আর তাঁর দল যে খবরগুলো দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচার করতে দিতে চান না সেই খবরগুলোতেই বিলেতে মুখ পুড়ল মোদীর। যদিও তিনি কিন্তু ঠান্ডা মাথায় বারত-যুক্তরাজ্য মৈত্রী নিয়ে উচ্চাশা পোষণ করেছেন এবং টুইট করেছেন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির প্রধানদের বৈঠকে মোদী জানিয়েছেন, ব্রিটেন এখন ভারতের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ব্রেক্সিটের পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করলেও ব্রিটেন ভারতের কাছে ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ রয়ে যাবে।

আগামী বছর মার্চে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার কথা ব্রিটেনের। মোদীর কথা শুনে ব্রিটেন হয়ত উৎফুল্ল হতে পারে, তা বলে ভারতীয় ভোটাররা আশ্বস্ত হতে পারছেন না, বিজেপির ভেদাভেদ রাজনীতি যাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

দেশের আমজনতা এখনও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। যদিও একটা বিষয় তাঁরা নিশ্চিত যে, মোদী কোনও দিনও সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলবেন না বা অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন না। তিনি যে খুন, ধর্ষণ বা গণহত্যার সম্পর্কিত স্পর্শকাতর আইনশৃঙ্খলার বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যান, অথচ অক্ষয় তৃতীয়ার মতো তিথিতে দেশের জনসাধারণকে শুভেচ্ছা পাঠাতে তৎপর তাকেন, তা এখন কারও অজানা নয়।

উৎসব-প্রিয় ভারতীয়দের জীবনে নিঃসন্দেহে উৎসবের অপরিসীম গুরুত্ব। কিন্তু তা বলে ধর্ষণ কাণ্ড বা অন্য স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী চুপ থাকবেন কেন? মোদীকে দেখলে মনে হয় তাঁর 'ধর্ষণ' শব্দটি উচ্চারণ করতেও প্রবল অনীহা রয়েছে। একটা সময় চুপ থাকার জন্য মনমোহন সিং দেশজুড়ে নিন্দার পাত্র হয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতে, সেই মনমোহন সিংও মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। তিনিও মোদীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে মোদীর মুখ খোলা উচিৎ।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া একটি সাখ্যাৎকারে মনমোহন জানিয়েছেন, "আমার মনে হয়, প্রয়োজন পড়লে নেতা নেত্রীদের কিছু বলা উচিৎ। না হলে অনুগামীরাও তো শব্দ হারিয়ে ফেলবেন।" তিনি বলেছেন, "মোদী চুপ থাকলে অপরাধীরাও পার পেয়ে যাবেন। অপরাধীরা বুঝতে পারবেন যে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও দিনও কোনও কড়া পদক্ষেপ করা হবে না।"

শুধু মনমোহন সিং নন, প্রত্যেক ভারতীয়ই এখন এক প্রশ্ন তুলছেন। মোদী কেন 'ধর্ষণ' শব্দ উচ্চারণ করতে ভয় পান? তাও এমন একটা সময় যখন তাঁর দলীয় কর্মীরাই ধর্ষণে অভিযুক্ত। 

বিজেপি অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এই নীরবতাকে সমর্থন করতে আসরে নেমে পড়েছে। তাঁদের তরফে দাবি করা হয়েছে যে বিরোধীরা বিশেষ কিছু অপরাধকে সংবাদের শিরোনামে নিয়ে এসে বিজেপিকে টার্গেট করতে চাইছেন। তাই তাঁরা শুধুমাত্র দুটি ধর্ষণ কাণ্ড নিয়েই বেশি হৈচৈ করছেন।

কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ভারতীয় মহিলাদের শুভেচ্ছা জানান। অথচ তাঁর মন্ত্রিসভার একজন মহিলা মন্ত্রী ধর্ষণের খবর অস্বীকার করেন। এই দ্বিচারিতার ব্যাখ্যা কী ভাবে করা হবে?

আগামী কয়েকদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে আমরা মোদীর বিদেশ নীতি নিয়ে বেশ কয়েকটি খবর দেখতে পাব। চোখ রাখতে হবে টুইটারেও যেখানে মোদী 'দিল্লি-লন্ডন ভাই ভাই' মার্কা বেশ কয়েকটি টুইট করতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, ভারতীয়রা তো ঘরের কথা বাইরের লোককে বলতে খুব একটা পছন্দ করেন না!

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SANGHAMITRA BARUAH SANGHAMITRA BARUAH

Works at DailyO.

Comment