কেন নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক
নেপালের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে ভারতের নিরাপত্তা জড়িত, তারা এখন ঝুঁকছে চিনের দিকে
- Total Shares
নেপালের সঙ্গে ভারতের মিথোজীবী সম্পর্ক। তবে এখন তাদের কমিউনিস্ট সরকার খোলাখুলি ভাবেই চিনের দিকে ঝুঁকেছে এবং ভারতের প্রতি বৈরী মনোভাব দেখাচ্ছে। এ বছর সেখানে কমিউনিস্টরা সরকার গড়ায় বিশ্বে এখন কমিউস্ট-শাসিত দেশের সংখ্যা আরও এক বেড়ে ছয় হয়েছে -- স্থলঘেরা নেপাল এখন বসেছে চিন, কিউবা, লাওস, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে এক সারিতে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও নেপালের প্রধানমন্ত্রী খড়্গপ্রসাদ ওলি এখনও চিনের দিকেই ঝুঁকে থাকার গোঁ ধরে রয়েছেন।
ভারত তাদের সঙ্গে সুসম্পর্কে আগ্রহী, এখন ওলির পালা (ছবি: পিটিআই)
ওলির শেষ দু’টি পদক্ষেপ দেখলেই তাঁই ঝোঁক কোন দিতে তা বোঝা যাবে: ১০ সেপ্টেম্বর পুনেতে এই প্রথম বার দুই দেশের মধ্যে হতে চলা জঙ্গি-দমন মহড়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে নেপাল, এই মহড়াটি বিমস্টেক বা বে অফ বেঙ্গল ইনিসিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় হতে চলেছিল। তাতে যোগ দেওয়ার বদলে তারা ভারতের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে চিনের সঙ্গে তাদের দেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহণ সংক্রান্ত চুক্তি (টিটিএ) করে ফেলল।
নেপাল এখন ঝুঁকছে বেজিংয়ের দিকে (ছবি: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস)
ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে নেপালও বিমস্টেকের সদস্য এবং কাঠমান্ডুতে বিমস্টেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে ‘মিলেক্স ২০১৮’-তে যোগদানের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেখানেই প্ল্যাটুন-মাপের সেনা পাঠানোর ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে সায় দিয়েছিল নেপাল। মিলেক্স ২০১৮-র সমাপ্তি অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল পূর্ণ চন্দ্র থাপাকে পাঠানোর ব্যাপারেও মত দিয়েছিল নেপাল।
তার বদলে ওলি সরকার ভারতকে কূটনৈতিক ভাবে ধাক্কা দিল। তা ছাড়া তারা আরও একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দিল যে, তারা মিলেক্স ২০১৮ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে চিনের তত্ত্বাবধানে জঙ্গি মোকাবিলা সংক্রান্ত মহড়াতেই যোগ দিল। চেংডুতে (সিচুয়ান প্রদেশের রাজধানী) চিনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মহড়া চলবে ১৭-২৮ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ পুনেতে মহড়া শেষ হওয়ার ঠিক পরের দিন শুরু।
বিমস্টেক সম্মেলনে যোগ দেওয়া নিয়ে চার বছরে চারবার নেপালে গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অন্য কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেপালকে এতটা গুরুত্ব দেননি। ঘটনা হল ১৭ বছর পরে মোদীই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নেপালে গেলেন।
কিন্তু মোদী ভারতে ফিরতে না ফিরতেই নেপাল-চিন ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট এগ্রিমেন্ট (টিটিএ) সই করে ফেলল ওলি সরকার। এই চুক্তি অনুযায়ী চিনের শেনঝেন, লিয়ান্যুনগ্যাং, ঝ্যানজিয়াং এবং তিয়ানজিংয়ের মাধ্যমে তৃতীয় কোনও দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে নেপাল। এ ছাড়াও শিগাৎসে, লাসা ও লানঝৌ স্থলবন্দরও তারা ব্যবহার করতে পারবে।
শেনঝেন ছাড়াও তাদের তিনটি বন্দর নেপালকে ব্যবহার করতে দেবে চিন (ছবি: ভেসেল ফাইন্ডার)
কাগজে-কলমে টিটিএ ভালোই লাগছে তবে ভারতের বন্দরগুলির উপরে নেপালের নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে ভৌগোলিক কারণে।
কলকাতা থেকে দূরত্ব যেখানে ৯৩৩ কিলোমিটার সেখানে নেপাল থেকে চিনের নিকটতম সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ৩,৩০০ কিলোমিটার।
টিটিএ বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে ভারতের বদলে চিনের পরিবহণগত সহায়তা চাইছে না নেপাল। উল্টে ভারতের স্বাভাবিক ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা এবং পরিবহণগত সুবিধা না নিতে চেয়ে সমস্যাই ডেকে আনছে ওলি সরকার। এ ভাবে আগে থেকেই ভারতের সমর্থনপুষ্ট মধেসিদের (সমতলের বাসিন্দা) ভারত-নেপাল সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া প্রতিহত করে ফেলতে চাইছে ওলি সরকার।
অপমানজনক ভাবে সীমান্ত বন্ধ বন্ধ করে দেওয়ার ভোগান্তি থেকে নিস্তার চায় নেপাল (ছবি: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস)
এ বছর মে মাসে নেপালের কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় বসে, মোদী হিমালয়ের কোলের এই দেশটিতে সরকারি সফরে যান। নেপালকে তখন ক্ষমতার আস্ফালন করছে উল্টো দিকে তখন মোদী তাঁর সফরে জোর দেন সংস্কৃ্তিগত, ধর্মীয় ও মানুষে-মানুষে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুই দেশের যোগের উপরে, মোদী বিপুল ভাবে সংবর্ধিতও হন।
দুই দেশের হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যের উপরে জোর দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (ছবি: পিটিআই)
তিনি জনকপুর থেকে তাঁর সফর শুরু করেন, সেই জনকপুর – রামায়ণ অনুসারে যেখানে রাম ও সীতার বিয়ে হয়েছিল – তিনি পুজো দেন পশুপতিনাথ মন্দির (নেপালের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে জাগ্রত শিবমন্দির) ও মুক্তিনাথ মন্দিরে (যা হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়ের কাছেই অতি পবিত্র), ভারতের শুভ শক্তি দিয়ে চিনের সামরিক শক্তি মোকাবিলার পক্ষে সওয়ালও করেন নরেন্দ্র মোদী। দু-দেশের ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বন্ধনকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে জনকপুর (সীতার বাপের বাড়ি) ও অযোধ্যার (সীতার শ্বশুরবাড়ি) মধ্যে বাস পরিষেবা চালু করা হয়।
কিন্তু মোদী দেশে ফেরার ঠিক পাঁচ দিনের মধ্যে চিনের মদতে ওলির মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টি ও মাওবাদী গোষ্ঠী যুক্ত হয়ে নেপালে এক নতুন কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়, তার নাম হয় নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি)। ক্ষমতায় আসার তিন মাসের মধ্যেই নেপালের দুটি প্রধান কমিউনিস্ট গোষ্ঠী মিশে যায়। বেজিংই এই নতুন দলের জন্মের নেপথ্যে ছিল এবং এই দল তৈরি হওয়ার পরে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করে তারা। তারা বলে, “যা স্বাভাবিক বাস্তব ও তাদের পক্ষে উপযুক্ত, দেশটির সেই সামাজিক পদ্ধতি পদ্ধতি বেছে নেওয়াকে চিন সমর্থন করে।”
ঘটনা হল শান্তিপূ্র্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসায় নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির সহিংস আন্দোলনের অতীত অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। কমিউনিস্ট গেরিলা হিসাবে দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করায় ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন ওলি। ১৯৯০ সালে রাজতন্ত্রের অধীন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুযোগ তৈরি হওয়ায় মাওবাদী ও ওলির দল রাজনৈতিক জায়গা পায়। ‘গণবিপ্লব’-এর মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটাতে ১৯৯৬ সালে মাওবাদীরা রক্তক্ষয়ী বিপ্লব শুরু করে।
নেপালের কমিউনিস্টদের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস আছে (ছবি: লিবকম.ওআরজি)
এক দশক পরে ভারতের মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মাওবাদী ও দেশের সেনার মধ্যে হয়ে চলা দীর্ঘ যুদ্ধের অববসান ঘটে। কিন্তু মাওবাদীদের প্রধান যে দাবি ছিল -- নেপালি কমিউনিস্টদের সমর্থনপুষ্ট মাওবাদীদের দাবি – সেই সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অবসানকে ত্বরাণ্বিত করে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সরকার।
নেপালের শেষ রাজা জনপ্রিয়ও ছিলেন না, তাঁর শাসনকালও স্থায়ী হয়নি। (ছবি: ইন্ডিয়াটুডে.ইন)
সেই যে ভয়ানক ভুল, যা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের পথ করে দেয়, আর এর জন্যই যত সময় যাবে ভারতকেও তত মূল্য চুকিয়ে যেতে হবে। 'বিপ্লব'-এর পথে নয়, নেপালি মাওবাদীরা রাজতন্ত্রকে ছুড়ে ফেলা নিশ্চিত করে ফেলল আদর্শগত ভাবে তাদের বিরোধী ভারতের মাধ্যমে, আপাত ভাবে দেখলে ভারত নিজেও এখন মাওবাদী সমস্যায় ভুক্তভোগী।
ভয়াবহ ভাবে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তির সুবিধার কথা না ভেবে হিন্দু রাজ্য থেকে নেপালকে কমিউনিস্ট শাসিত, চিনের দিকে ঝুঁকে পড়া রাষ্ট্র হতে নেপালকে সাহায্য করেছে ভারত।
এখন সংযুক্ত হয়ে যাওয়া কমিউনিস্ট দলটি রাষ্ট্রায়ত্ত সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উপর কর্তৃত্ব করছে, বেজিংও নেপালকে তাদের পরিধির মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে ভীষণ ভাবে চেষ্টা করছে। শোনা যায়, নির্বাচনের আগে নেপালের দুই কমিউনিস্ট পার্টিকে এক করার জন্য চেষ্টা করেছে চিন, এমনকি ভোটের প্রচারের জন্য যে খরচ হয়, তাতেও তারা সাহায্য করেছে।
চিনা কমিউনিস্ট পার্টি-সহ বেশিরভাগ কমিউনিস্ট পার্টিই ক্ষমতায় এসেছে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে বিশ্বে যে ছ-টি কমিউনিস্ট দেশ রয়েছে তার মধ্যে একমাত্র নেপালেই গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল নেপালের কমিউনিস্ট সরকার গণতন্ত্রের পথেই থাকবে নাকি ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেবে। এরা কি চেকোস্লোভাকিয়ার পথে হাঁটবে, যারা ১৯৪৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী হয়েছিল? ১৯৪৮ সালের মধ্যেই চেকোস্লোভাক কমিউনিস্ট পার্টি পুরো সরকারকেই কব্জা করে নেয় এবং গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করে ফেলে।
নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি এখন সব প্রতিষ্ঠানকেই করায়ত্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে (ছবি: রয়টার্স)
নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে ইতিমধ্যেই তাঁর সমালোচকরা ‘অয়েলি ওলি’ বলা শুরু করে দিয়েছেন, তিনি ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতা খর্ব করতে শুরু করে দিয়েছেন, সেই সব প্রতিষ্ঠানে নিজের বিশ্বস্তদের বসাচ্ছেন। নেপালের সংসদে এখন কমিউনিস্টদের মোটামুটি দুই-তৃতীয়াংশ আসন রয়েছে, দেশের সাতটি রাজ্যের মধ্যে ছটি রাজ্যেই এখন কমিউনিস্ট সরকার রয়েছে। কমিউনিস্ট প্রতিনিধিরা এখন দেশের সাংবিধানিক ও অন্য প্রধান পদগুলিতে রয়েছে – তা সে বিচারবিভাগ হোক বা নির্বাচন কমিশন।
যদি এ ভাবেই চলতে থাকে তা হলে যে ভাবে চেকোস্লোভাকিয়ায় যে ভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল, নেপালও সেই ভাবেই নিজেকে তৈরি করে নেবে। বাস্তব হল, দুর্বল বিরোধী দল, দুর্বল বিচারব্যবস্থা এবং উদ্ধত পদাধিকারীরা ইতিমধ্যেই নেপালে স্বৈততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছে।
নেপালের অভ্যন্তরীণ রদবদল ভারতের নিরাপত্তাকে সরাসরি বিঘ্নিত করছে।
বিশ্বের সবেচেয়ে খোলামেলা সীমান্ত যে সব জায়গায় রয়েছে ভারত ও নেপাল সীমান্ত তাদের অন্যতম, এই সীমান্তে কোনও পাসপোর্ট লাগে না। কিন্তু চিন যে ভাবে নেপালের মধ্যে ঢুকে পড়ছে তাতে ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
নেপালে ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্টদের হালকা ভাবে না নিয়ে ভারতের উচিৎ দেশের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর হিসাবে তাদের দেখা। নতুন দিল্লির উচিত ভারত সম্বন্ধে তাদের যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা থেকে নেপালি কমিউনিস্টদের মুক্ত করা যাতে তারা কোনও ভাবেই ভারতকে তাদের শত্রু ভাবাপন্ন বলে মনে না করে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে