রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে নয়, মানবিকতার কারণেই 'ঘুস পেটিয়াদের' পাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
৪০ লক্ষ না হয়ে যদি ৪০ জন বাদ যেত তাহলেও তৃণমূল নেত্রী প্রতিবাদ করতেন
- Total Shares
অনেকেই বলছেন অসমের এনআরসি তালিকায় ৪০ লক্ষ মানুষ বাদ যাওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেস যে 'আদিখ্যেতা' করছেন তা নাকি আদতে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের কথা ভেবে এই এনআরসি ড্রাফটকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় যাঁরা এই সমস্ত কথাগুলো বলছেন তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির ইতিহাসটা এক হয় জানেন না, বা সব জেনেশুনেও নির্বাক থাকতে চাইছেন। রাজ্যের বিরোধী নেত্রী হিসেবে বামফ্রন্টের 'সোনার সময়ে'ও তৃণমূলনেত্রী তথা রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বরাবরই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এর জন্যে তাঁর জীবনের উপরেও বহুবার আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু তিনি তাঁর জীবনেরও পরোয়া করেননি।
১৯৮৫ সালে উদ্বাস্তু উচ্ছেদ আটকে ছিলেন মমতা [সৌজন্য: তৃণমূল কংগ্রেসের ওয়েবসাইট]
এই প্রসঙ্গে বেহালার একটি কথা মনে পড়ে গেল। বেহালায় বিষতেল খেয়ে বহু মানুষ পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। খবর পেয়েই বেহালায় ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। ক্ষতিপূরণ ও সঠিক তদন্তের দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেন তিনি। কিন্তু ঘোর বামফ্রন্ট জমানায় পশ্চিমবঙ্গে কোনও দিনও গণতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধায়কে সেদিন বেহালায় থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে বেদম প্রহার করা হয়। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি, তবে সেদিন তাঁর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে।
১৯৮৫ সালের কথায় আসি। সেদিন বামফ্রন্ট সরকার পুলিশ দিয়ে উদ্বাস্তু হটাও আন্দোলনে নেমেছিল। বাঁধা দিয়েছিলেন তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন সরকারের পাঠানো বুলডোজারের সামনে শুয়ে পড়েন মমতা। বলেছিলেন, একজন লোককেও উচ্ছেদ করতে হলে তাঁর শরীরের উপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে করতে হবে। মমতার সেই অনড় জেদ সেদিন বামফ্রন্ট সরকারকে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য করেছিল। বহু মানুষের ভিটেমাটি রক্ষা পেয়েছিল।
একটানা ২৬ দিন অনশন আর কোন নেতা করেছেন?
ভারতে তো 'বড়' নেতার সংখ্যা নেহাতই কম নয়। তাঁদের ত্যাগের গল্প আমরা বহু শুনেছি। কিন্তু এমনও একজন নেতাকে খুঁজে বের করুন যিনি ২৬ দিন ধরে অনশন করেছিলে, নির্জলা উপবাসে থেকে। তিনি চেয়েছিলেন সিঙ্গুরের জমি ফেরত পান কৃষকেরা। বহু তথাকথিত শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতারা সেদিন বলেছিলেন যে তৃণমূল নেত্রী নাকি দিবাস্বপ্ন দেখছেন। আইন কোনও মতেই জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দিতে পারে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলন যে ঠিক পথেই ছিল তার প্রমাণ দিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিঙ্গুরের সিংহভাগ জমি এখন কৃষকদের ফেরত দিতে হবে।
আজ সকলে জাতীয় রাজনৈতিক পঞ্জীকরণ নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন। কিন্তু দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছতা করে তোলার অন্যতম পথিকৃৎ তো এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মমতার দাবিতে পথে নেমেছিল যুব কংগ্রেস। দাবি একটাই - রেশন কার্ড নয় বৈধ এপিক কার্ড ছাড়া কেউ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। সে দিনও বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ চেয়েছিল মমতাকে হত্যা করতে। তিনি বেঁচে গেলেন কিন্তু প্রাণ গেল আমাদের ১৩ জন তরুণ নেতার।
২১ জুলাইতেও মমতাকে হত্যা করবার চেষ্টা হয়েছিল
যাঁর রাজনীতির ইতিহাস শুধুমাত্র ত্যাগের রাজনীতির কথা বলে আজ তাঁকেও শুনতে হচ্ছে যে তিনি নাকি ৪০ লক্ষ লোকের পাশে দাঁড়াচ্ছেন রাজনৈতিক ফায়দা তুলবেন বলে। আমার স্থির বিশ্বাস, অসমে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়ার সংখ্যাটা যদি ৪০ লক্ষ না হয়ে মাত্র ৪০-ও হত তাহলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রতিবাদ করতেন। এই প্রতিবাদে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কোনও প্রশ্নই আসে না। তলিয়ে দেখলে দেখবেন কোনও অবকাশই নেই।
পরিশেষে আরও একটা কথা বলি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও দিনও পদের জন্যে লালায়িত ছিলেন না, আজও নেই। ২০০৯ নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ভারতের সরকারের গঠনে রেলমন্ত্রী খুব সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর পর সবচেয়ে আলোচিত পদ। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করে সেই পদ হেলায় ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। ইউপিএ সরকার থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন তিনি। আর এ সবই তো মানুষের স্বার্থে, মানুষের জন্য।
আমরা ভাগ্যবান যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেত্রী পশ্চিমবঙ্গে জন্ম গ্রহণ করেছেন। গোটা দেশ জুড়ে এখন যা অরাজকতা চলেছে তাতে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার একমাত্র যোগ্য নেতা বা নেত্রী এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।

