'বিজ্ঞানসম্মত' ভাবে বিরোধীদের মনোনয়ন আটকাবার যোগ্য লোকের অভাব রয়েছে তৃণমূলে

মনোনয়ন রোকো স্ট্র্যাটেজি তৃণমূল আমলে বৃদ্ধি পেলেও রাজ্যে এই স্ট্র্যাটেজির জনক তৃণমূল নয়

 |  5-minute read |   27-04-2018
  • Total Shares

নির্বাচনে জিততে হলে ভোটের দিন অবধি অপেক্ষা নয়, বরঞ্চ মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় কখনও বিভিন্ন ছল চাতুরি অবলম্বন করে আবার কখনও স্রেফ গায়ের জোরে বিরোধীদের রুখে দিতে হবে। তাহলেই কেল্লা ফতে। বিরোধী প্রার্থীই যদি না থাকে তাহলে আর নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দল আবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে।

নিন্দুকেরা যতই বলুক দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে বা দেশের সংবিধানের উপর আঘাত করা হচ্ছে - নির্বাচন যুদ্ধ জয়ের এই ব্লু-প্রিন্ট কিন্তু দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছেই ভীষণ প্রিয়। যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী সেই রাজ্যে সেই দলের নেতানেত্রীরা কম বেশি এই স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করে নির্বাচনে লড়াই করেন। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। তাই রাজ্য জুড়ে একছত্র আধিপত্য শাসক দল তৃণমূলের। সেই দলের নেতৃবৃন্দ এই স্ট্র্যাটেজি একশো শতাংশ প্রয়োগ করবেন, এটাই স্বাভাবিক।

তৃণমূল আমলে হয়ত এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগের পরিধি ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু এ রাজ্যে এই স্ট্র্যাটেজির জনক তৃণমূল কোনও ভাবেই নয়। বামফ্রন্ট আমলেও এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা হত, এবং এতটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা প্রয়োগ করা হত, যে ধরার উপায় থাকত না। কেউ অভিযোগ জানালেও তা ধোপে টিকত না, অভিযোগের পক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যে বড় দুষ্কর ছিল।

শুধু এই স্ট্রাটেজি কেন, বামফ্রন্ট আমলে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য আলাদা আলাদা স্ট্রাটেজি থাকত। আর, তা খুব বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রয়োগ করা হত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সমস্যা এখানেই। তৃণমূলও সেই পথে হাঁটছেন কিন্তু পথটাকে বিজ্ঞানসম্মত করে দেওয়ার লোকের অভাব। মুকুল রায় কিছুটা হয়ত পারতেন। কিন্তু তিনি তো এখন বিরোধী শিবির বিজেপিতে।

বামফ্রন্ট আমলে শুধুমাত্র সংসদীয় নির্বাচনে নয় অফিস সংগঠন থেকে শুরু করে শ্রমিক সংগঠন কিংবা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন নির্বাচন সর্বত্রই এই 'মনোনয়ন রোকো' স্ট্র্যাটেজি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হত।

আসুন একটি এই ধরণের একটি অদ্ভুতুড়ে নির্বাচনের গল্প শুনি।

body1_042718022803.jpgসংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল

দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তখন আর পাঁচ দিন বাদে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ২২টি আসন বিশিষ্ট কলেজটির নির্বাচনে মাত্র একদিনই মনোনয়ন পত্র জমা নেওয়া হয়। কলেজের এ বছরের সেশন শুরু হয়েছে মাস চারেক আগে। অথচ কী আশ্চর্য, সে দিনই পড়ুয়াদের নতুন (সেই বছরের জন্য) পরিচয়পত্র কলেজে এসে পৌঁছাল এবং তা বিতরণ করবার দায়িত্ব পড়ল বর্তমান ছাত্র সংগঠনের উপর।

এর পর থেকেই শুরু হলো 'মনোনয়ন রোকো' স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগের। বর্তমান ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অঙ্ক কষে সেই পরিচয়পত্র বিতরণ শুরু করলেন। অঙ্কটা ঠিক কী? প্রতিটি আসনের ভোটদাতাদের মধ্যে সম্ভাব্য কারা কারা বিরোধী ছাত্র সংগঠনের হয়ে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন বা সেই সংগঠনের হয়ে ভোট দিতে পারেন? এই তালিকায় যাঁদের নাম থাকবে তাঁদের অধিকাংশের পরিচয়পত্র যেন বণ্টন না করা হয় তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হলেন বর্তমান ছাত্র সংসদের নেতানেত্রীরা।

মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার দিনে কলেজের দরজায় পুলিশ বসল। আর সেদিন থেকেই নতুন পরিচয়পত্র দেখিয়ে কলেজে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হল। এর ফলে বিরোধী সংগঠনের হয়ে যাঁদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার কথা তাঁরা আটকে গেলেন। বিরোধী সংগঠনের নেতারাও পড়লেন ফাঁপরে, একই সঙ্গে উভয় সঙ্কটে। তাঁদের সংগঠনের সব সম্ভাব্য প্রার্থীর পরিচয়পত্র আটকে রাখা হয়নি। সুকৌশলে কয়েকটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছিল।

এখন তা হলে বিরোধী নেতারা কী করবেন? তাঁরা কী আন্দোলন করবেন, নাকি আগে তাঁদের যে ক'জন প্রার্থী কলেজে প্রবেশ করবার অনুমতি পেয়েছেন তাঁদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করবেন। দ্বিতীয় রাস্তাতেই হাঁটলেন তাঁরা। যাঁরা দিতে পাচ্ছেন তাঁদের মনোনয়ন জমা করিয়ে নিয়ে তারপর প্রতিবাদ জানাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা।

সংসদীয় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন নির্বাচন কমিশন আছে সে রকম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করেন অধ্যক্ষের নেতৃত্বে একদল শিক্ষক। বলতে গেলে অধ্যক্ষই সেই নির্বাচনের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক বা রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। সমস্যাটা হল, বর্তমান যে ছাত্রসংসদ ক্ষমতায় রয়েছে সেই ছাত্রসংসদ আদতে রাজ্যের শাসক দলের শাখা। আবার অধ্যক্ষ যে অধ্যাপক সংগঠনের সদস্য সেই সংগঠনটিও রাজ্যের শাসক দলের শাখা। তাই বিরোধীদের অভিযোগ অনুযোগ আর্জি কোনওটাই ধোপে টিকলো না। মনোনয়নের মাত্র দু'দিনের মধ্যেই নির্বাচন। 'সময়ের অভাব' - এই বাহানায় অধ্যক্ষ মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ার সময় বাড়াতে রাজি হলেন না। অর্থাৎ ২২টি আসনের মধ্যে এবার মাত্র ছ'টি আসনে নির্বাচন হবে। বর্তমান ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আগেই ফের ক্ষমতা দখল নিশ্চত করে নিল।

এ বার প্রতিবাদের পথে নামলেন বিরোধী সংগঠন। পরের দিন নির্বাচন বয়কট করে নির্বাচনের দিন মৌন মিছিল বের করবার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। ততক্ষণে মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে ছ'টি আসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।

বিরোধীরা ভোট বয়কট করেছেন তাঁর মানে নির্বাচন হলে তাঁদের অনুকূলে একটিও ভোট পড়বার কথা নয়। অথচ ফল ঘোষণার সময় দেখা গেল এই ছ'টি আসনের প্রত্যেকটিতে বিরোধীরা বেশ কিছু ভোট পেয়েছেন। কী ভাবে সম্ভব? ক্ষমতায় থাকা ছাত্র সংসদের নেতারা তাঁদের ভোটারদের দিয়েই বেশ কিছু বিরোধী দলের অনুকূলে ভোট দিয়ে দিয়েছেন।

body2_042718022931.jpgহরিমোহন ঘোষ কলেজ নির্বাচনের মনোনয়ন জমার দিনে নিহত হন পুলিশকর্মী

লাভের লাভ কী হল? বিরোধীরা এ বার যদি আদালতের দ্বারস্থ হন তা হলে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না। কারণ সরকারি ভাবে তাঁরাই ১৬টি আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি, মাত্র ছ'টিতে পেরেছেন। এই ছ'টি আসনে নির্বাচন হয়েছে এবং এই ছ'টি আসনের একটিতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তাঁরা বেশ কিছু ভোট পেয়েছেন। এর পরে আদালতে গিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে হওয়া প্রহসন প্রমাণ করা কিন্তু বেশ চাপের হবে।

এ বার নাটকের কলাকুশলীদের পরিচয় দেওয়া যাক। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময় রাজ্যের মসনদে বামফ্রন্ট সরকার। কলেজটির ছাত্র সংসদের ক্ষমতা ছিল সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই। আর বিরোধী সংগঠন তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন।

তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূল ছাত্র সংগঠন একই পন্থা অবলম্বন করে বেশ কয়েকটি কলেজের ছাত্র সংসদ দখল করে নেয়। কিন্তু বেশ কয়েকটি কলেজে এই পন্থা অবলম্বন করতে গিয়ে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। যেমন খিদিরপুরের হরিমোহন ঘোষ কলেজ। সেখানে মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিনে সংঘর্ষে এক পুলিশ কর্মী গুলিতে নিহত হন।

যে কাজটি এসএফআই সুষ্ঠভাবে করে দেখাল তা করতে গিয়ে তৃণমূল ছাত্র সংগঠন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেন কেন? কারণ, বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগের লোকের অভাব।

সংসদীয় রাজনীতিতে এই স্ট্র্যাটেজি এবার প্রয়োগ করছে তৃণমূল। তাই তো সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। সংঘর্ষে প্রাণ হারালেন অনেকেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও কালির দাগ লাগল।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARPIT BASU ARPIT BASU @virusfound007

Arpit Basu is the Special Correspondent with the India Today Group’s fact check team. With more than one-and-a-half decade's experience in print and digital media, he has reported on aviation, transport, crime, civic and human interests issues. His sting operation on how precious Aviation Turbine Fuel, meant for Kolkata airport, was pilfered and sold in local market as ‘white kerosene’ received widespread acclaim. Arpit has worked with reputed media houses like The Times of India and Hindustan Times and had received letter of appreciation for reporting during the Phalin cyclone in Odisha in 2013.

Comment