বিজেপিকে সভা করতে না দেওয়ার চিঠিটি প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক

বেশিরভাগ রাজ্যে যে দল শাসক বা প্রধান বিরোধী, তাদের সভা করতে দিচ্ছে না এই রাজ্য

 |  5-minute read |   17-12-2018
  • Total Shares

পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূ্র্তে দল ও প্রশাসন বলে আলাদা কিছু নেই। এখানে প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ঘটেছে। এখানে প্রশাসন কোনও একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছে তা নয়, একবারে সরাসরি রাজনৈতিক দল হিসাবেই কাজ করছে। তাদের আর কোনও নিজস্বতা নেই, তারা কোনও নিয়ম-কানুনও মানছে না।

২৮ অক্টোবর আমরা প্রথম প্রশাসনকে জানাই আমাদের কর্মসূচি সম্পর্কে এবং তাদের সহযোগিতা প্রার্থনা করি। তার কোনও উত্তর আমরা পাইনি। উত্তর না পেয়ে ৫ নভেম্বর আমরা আবার একটি চিঠি দিই আমাদের অবস্থান জানিয়ে। তারও কোনও উত্তর পাইনি। ইতিমধ্যে রটে যায় যে আমরা রথ বার করছি। প্রচারমাধ্যম এবং পুলিশ ‘রথযাত্রা’ কথাটি বানিয়েছে। আমরা যেটির আয়োজন করছি তা হল ‘গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রা’।

আমাদের এই কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা ছিল ৫ ডিসেম্বর, পরে দিনটি পিছিয়ে ৭ ডিসেম্বর করা হয়। যথোপযুক্ত সময়ে সেটিও যথাস্থানে জানিয়ে দেওয়া হয়। জানানো হয়, কোচবিহার থেকে আমাদের এই যাত্রা শুরু হবে এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ এটি উদ্বোধন করবেন। সে দিন সকালে জেলাশাসক জানিয়ে দিলেন যে তাঁরা এই যাত্রা করতে দেবেন না। তার আগের দিন সন্ধ্যায় আমাদের দলের লোকজনের সঙ্গে জেলাশাসকের কথোপকথন হয়েছে এবং আগেও প্রায় প্রতিদিনই কথাবার্তা হয়েছে। তখন এই ইঙ্গিত তিনি দেননি।

ganatantra_pti_121718032129.jpegকোচবিহারে গণতন্ত্রযাত্রার সূচনা করার কথা ছিল বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর (ছবি: পিটিআই)

অসহযোগিতা এমন পর্যায়ে গেছে যে কোনও সরকারি মাঠ তো আমরা পাইইনি, সরকারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে এমন মাঠও পাইনি এমনকি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে থাকা মাঠের জন্য আমরা যখন আবেদন করি কোচবিহার ও বীরভূমে, তখন বলে দেওয়া হল ‘এখানে কৃষিমেলা হবে, এখানে মাঠ দেওয়া যাবে না’।

কোচবিহারে যখন আমরা কোনও মাঠই পেলাম না, তখন বলা হল যে সেখানে রাসমেলা চলছে। রাজবাড়ির পিছনের একটি মাঠের জন্য আমরা ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা এএসআই) অনুমোদন নিই, জমিটি তাদের। তখন মৌখিক ভাবে কোনও প্রকারে জানতে পারি যে সেখানেও আমাদের সভা করতে দেওয়া হবে না।

তখন হাইওয়ের পাশে আমাদেরই দলের এক কর্মীর চাষযোগ্য জমিতে জল দিয়ে, রোলার চালিয়ে সভার উপযুক্ত করতে শুরু করলাম। সাত দিন ধরে আমরা যখন এ কাজ করছি তখন প্রশাসনের লোকজন সেসখান দিয়ে যাতায়াত করছিলেন। আমাদের কেউ আটকায়নি বা এ বিষয়ে কোনও কথা বলেনি। সকালে তারা বলল যে এখানে সভা করা যাবে না – এই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি।

ইতিমধ্যে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি এবং আদালত তার মতামত জানিয়েছে। আমাদের কাছে আদালত জানতে চায় আমরা কী চাই। আমরা জানাই যে এই নির্দিষ্ট তারিখ থেকে আমরা যাত্রা শুরু করতে চাই।

তারপরে শনিবার শেষের দিকে প্রশাসন থেকে আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নিত হতে পারে তাই তারা এ ব্যাপারে কোনও অনুমতি দিতে দেবে না। এখন আমাদের কাছে দু’টি পথ খোলা আছে, আদালতে লড়াই করার পাশাপাশি পথে নেমে লড়াই করা। স্বাভাবিক ভাবেই আজও আমরা আদালতে গিয়েছি যাত্রা শুরু করতে চাই বলে।

bjp1_intoday_121718032304.jpgদেশের অধিকাংশ রাজ্যে এখন হয় ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি, না হয় প্রধান বিরোধী দলের আসনে (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

ডিভিশন বেঞ্চের যে দৃষ্টিভঙ্গি বা অবজার্ভেশন ছিল তাতে কয়েকটি নির্দেশিকাও ছিল। সেখানে বলা হয়েছে যাত্রাপথ ছোট করার কথা বলা যেতে পারে, যাত্রাপথ বদল করার কথাও প্রশাসন বলতে পারে, কিন্তু এই ধরনের যাত্রা ‘করতে পারবে না’ এ কথা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বলা যায় না। আগে কোনও দিন কোথাও এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

আমরা যে সব রাজ্যের নির্বাচনে জয়ী হয়েছি বা পরাজিত হয়েছি সেখানে কোথাও এই ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান দেখা যায়নি, এমনকি সিপিএম আমলেও ওই চরম রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও যখন আমাদের দলের নেতারা এসেছেন তখনও এরকম পরিস্থিতি দেখা যায়নি।

এই ধরনের পরিস্থিতি যে এ বারেই প্রথম হচ্ছে এমন অবশ্য নয়, যখন নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে এ রাজ্যে যখন প্রচারে আসেন তখন তাঁর সভার জন্য আমরা শহিদ মিনার চত্বরে সভা করার অনুমতি চেয়েছিলাম। তখন শহিদ মিনার সংস্কারের কথা বলে সভার অনুমতি দেওয়া হল না।

রাজ্যে স্বতন্ত্র প্রশাসন বলে কিছু নেই। এ কথা কি কোনও প্রশাসন লিখিত ভাবে জানাতে পারে আরএসএস, বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এখানে থাকতে পারে। প্রথমত এর সঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক কর্মসূচির কী সম্পর্ক? তারা যে এই যাত্রায় সামিল হয়েছিল সে তথ্য প্রশাসন কোথা থেকে পেল? এটা তো রাজনৈতিক বক্তব্য, এটা কখনও প্রশাসনিক ভাষা হতে পারে না।

এই মূহূর্তে ভারতের প্রায় সব রাজ্যে যে রাজনৈতিক দল হয় শাসক ক্ষমতার রয়েছে বা শাসক জোটে রয়েছে বা প্রধান বিরোধী দল হিসাবে রয়েছে (এখন দেশের ১৬টি রাজ্যে শাসনক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি) সেই দল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনও সভা-মিছিল করলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে যাবে এ কথা প্রশাসন কী ভাবে বলতে পারে?

প্রশাসন যদি আরএসএস, বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কথাও বলে, তা হলে এ কথা তারা নিশ্চয়ই জানে যে এগুলি কোনও জঙ্গি সংগঠন বা নিষিদ্ধ সংগঠন নয়, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপেও তাদের নাম জড়িত নয়। সংগঠনগুলি দেশের সংবিধান মেনেই গঠিত। তা হলে এই সব সংগঠনের নাম কী ভাবে প্রশাসন চিঠিতে উল্লেখ করতে পারে? রাজনৈতিক সংগঠন বা তাদের নেতানেত্রীরা যে ভাষায় জনসভায় বক্তৃতা করেন, সেই ভাষা কী ভাবে প্রশাসন ব্যবহার করতে পারে? এটা কখনও প্রশাসনের ভাষা হতে পারে না। রাজ্যের সাংবিধানিক কাঠামোই তো এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে! বলা যেতে পারে এটি সাংবিধানিক কাঠামো কার্যত ভেঙে পড়ার পরিস্থিতি। ভারতের অন্য কোথাও এর থেকে বেশি মাত্রায় কোনও প্রশাসনের রাজনীতিকরণ হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

মাঠে ময়দানে বক্তৃতায় কিছু বলা, হিন্দিতে যাকে ‘জুমলা’ বলে, সেটা এক জিনিস। সেখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে অনেক কিছু বলা হয়ে থাকে। সেই বক্তৃতা কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করতে পারেন, আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীও করতে পারেন। কিন্তু সেই ভাষা প্রশাসন বা সরকার কখনও লিখিত ভাবে ব্যবহার করতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় বলা জরুরি, তা হল কোনও দিন কোনও সভার অনুমতি প্রয়োজন হয় না। কোনও সভা করতে হলে কেবলমাত্র তা জানাতে হয়। আমাদের সভা করা, মিছিল করা ও জমায়েত করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। অনুমতি দেওয়া পুলিশের কাজ নয় (শুধুমাত্র মাইকের অনুমতি নিতে হয় মহকুমা শাসকের থেকে, এটি আবশ্যিক), কিন্তু এক্ষেত্রে কী হয়েছে? প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা অনুমতির জন্য যাব প্রতিটি থানায়, বাস্তবে থানা সেটি পাঠিয়ে দেবে ডিএসপির কাছে, ডিএসপির কাছ থেকে সেটি যাবে পুলিশ সুপারের কাছে, তিনি সেটি পাঠিয়ে দেবেন স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে... এই প্রক্রিয়া তো চলতেই থাকবে, এটি তো সভা না করতে দেওয়ার একটি বাহানা!

একজন আমলা তাঁর সই করা চিঠিতে রাজনৈতিক ভাষা ব্যবহার করছেন সরকারি ভাবে, এর থেকে বড় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর কী হতে পারে!

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SAMIK BHATTACHARYA SAMIK BHATTACHARYA @samikbjp

Sr. BJP Leader and former MLA

Comment