রাফাল বিতর্ক: মিথ্যা বেশি রটছে আর সেই ছায়ায় চাপা পড়ছে প্রকৃত তথ্য

রাহুল জেনেবুঝেই অসত্য বলছেন, কারণ ভোটের মুখে রাফাল বড় ইস্যু হতে চলেছে

 |   Long-form |   14-02-2019
  • Total Shares

সংসদ ভবনে চলতি বাজেট অধিবেশন চলাকালীন রাফাল চুক্তি নিয়ে কম্পট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার (ক্যাগ) বহু প্রতীক্ষিত রিপোর্টটি জমা পড়েছে। এর ফলে এই বিষয় নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হবে।

এরই মধ্যে সম্প্রতি (৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) দ্য হিন্দু পত্রিকায় রাফাল চুক্তি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে একটি হাতে লেখা চিরকুটে (পত্রিকার তরফ থেকে ওই চিরকুটের মাত্র কয়েকটি পংক্তি ব্যবহার করে লেখাটির সারমর্ম বদলে দেওয়া হয়েছিল) প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে জানানো হয়েছিল যেন তারা ড্যাসল্টের সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ না করে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আধিকারিকরা এক শ্রেণীর আর্মস লবির সহযোগে প্রতিরক্ষা বিষয়ক চুক্তিগুলোতে এই ধরণের কৌশল বহু যুগ ধরেই ব্যবহার করে আসছে। এর ফলে বছরের পর বছর ধরে দেশের প্রতিরক্ষা শক্তিরও ক্ষয় হয়েছে। এর পরেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এই চুক্তিকে আরও ত্বরান্বিত করা হয়েছে। কারণ দুই সরকারের মধ্যে এই ধরণের চুক্তি যখন হয় তখন অস্ত্র ব্যবসায়ী ও দালালদের বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।

বর্তমান কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী এই রাফাল চুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি হইচই করেছিলেন।

তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্কে একটি বিশেষণ ব্যবহার করে চলেছেন - 'চৌকিদার চোর হ্যায়' (রক্ষকই ভক্ষক)। এর কারণ, একটা মিথ্যাকে যদি বারংবার প্রচার করা হতে থাকে তা হলে লোকে সেই মিথ্যেকেই সত্যি বলে ভাবতে শুরু করে।

রাফাল চুক্তির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রাহুল গান্ধী প্রতারণার গন্ধ পাচ্ছেন - দাম, হিন্দুস্তান এরোনটিক লিমিটেড (হ্যাল) ও অনিল আম্বানি।

একবার এই রাফাল চুক্তির তথ্যগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

body_021419043559.jpgরাফাল বিতর্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক রাহুল গান্ধী করেছিলেন [ছবি: পিটিআই]

দাম

ভারতীয় বায়ুসেনার জন্য মোট ৩৬টি রাফাল ফাইটার বিমান ফ্রান্সে উৎপাদন করার কথা। রাহুলের দাবি, এই ৩৬টি বিমানের দাম যা হওয়া উচিত তার চেয়ে বেশি দাম ধার্য করেছে ভারত।

চুক্তি অনুযায়ী এই ৩৬টি বিমানের দাম ৫৯,০০০ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ এক একটি বিমানের দাম পড়ছে ১,৬৪০ কোটি টাকা।

কংগ্রেস ২০০৭ সালে ১২৬টি রাফাল জেট ক্রয়ের জন্য ড্যাসল্টের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। এর মধ্যে আটটি ফ্রান্সে তৈরি হওয়া কথা ছিল আর বাকি ১০৮টি হ্যালের সঙ্গে যৌথ ভাবে ভারতে তৈরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে কংগ্রেস হঠাৎই এই চুক্তি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। সেই সময় তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর একটি উক্তি তো রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, "টাকা কোথায়?"

দাম নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই ইউপিএ সরকার রাফাল চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে, অস্ত্রে সজ্জিত একটি রাফাল ফাইটার জেট সমকালীন দাম তুলনা করার কি কোনও মানদণ্ড রয়েছে?

এই বিষয়ে দু'দুটি সমসাময়িক মানদণ্ড রয়েছে, যেগুলো প্রাসঙ্গিকও বটে। এর মধ্যে প্রথমটি ২০১৫ সালে কাতারি বায়ুসেনা যে দামে অস্ত্র সজ্জিত রাফাল ফাইটার জেট কিনেছিল। ৪ মে, ২০১৫ সালে আলজাজিরা এই চুক্তি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল: "ড্যাসল্ট এভিয়েশনের তৈরি ২৪টি রাফাল ফাইটার জেটের জন্য প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া অঁলাদের সঙ্গে কাতারি আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির ৬.৩ বিলিয়ন পাউন্ডের (৭.০২ বিলিয়ন ডলার) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।"

২০১৫ সালের মে মাসে ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় মার্কিন ডলারের বাজার দর ছিল ৬৪ টাকা। তার মানে, ভারতীয় মুদ্রায় হিসেবে করলে কাতার সরকারের ২৪টি রাফাল জেটের খরচ (৭.০২ ডলার) পড়েছিল ৪৫,০০০ কোটি টাকা।

হিসেবে করলে দেখা যাচ্ছে, এই ২৪টি রাফাল জেটের এক একটির খরচ পড়েছিল ১,৮৭৫ কোটি টাকা যা ভারতীয় সরকার যে দামে রাফাল ফাইটার জেট কিনতে রাজি হয়েছে তার চেয়ে ২৩৫ কোটি টাকা বেশি।

body1_021419043721.jpgকংগ্রেসের অভিযোগ বেশি দাম দিয়ে ৩৬টি রাফাল কিনছে ভারত, এই অভিযোগ কি ধোপে টিকবে? [ছবি: পিটিআই]

তার মানে কি কাতারি চুক্তিটা অদ্ভুতুড়ে ছিল?

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মিশর সরকার ২৪টি অস্ত্রে সজ্জিত রাফাল বিমানের চুক্তি সম্পন্ন করে। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫য় ফ্রান্স ২৪-এর খবর অনুযায়ী: "৫.২ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের ২৪টি রাফাল ফাইটার জেট মিশরকে বিক্রয় করতে ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জ্যাঁ-ইভস ল্য ড্রিয়ান সোমবার কায়রোতে উপস্থিত হয়েছেন। ফ্রান্সে নির্মিত যুদ্ধবিমান এই প্রথম বিদেশে রপ্তানি হতে চলেছে।"

তার মানে মিশর সরকার যে ২৪টি রাফাল ক্রয় করেছিল (৫.২ বিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে) তা ভারতীয় মুদ্রায় দাম পড়েছিল ৩৭,০০০ কোটি টাকা (২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক ইউরোর দাম ছিল ৭১ টাকা) - বা প্রতি বিমানের জন্য খরচ পড়েছিল ১,৫৪২ কোটি টাকা।

তার মানে কাতারি ও আইএএফের অর্ডারের মূল্য যথাক্রমে ১,৮৭৫ কোটি টাকা এবং ১,৬৪০ কোটি টাকা। তার চেয়ে ৯৮ কোটি টাকা কম দিয়ে মিশরীয়রা এক একটি ফাইটার জেট পেয়েছিল কারণ সেই বিমানগুলোর স্পেসিফিকেশন অনেকটাই কম ছিল।

তাহলে রাহুল গান্ধী কেন অভিযোগ তুলছেন যে ভারত ৩৬টি রাফাল জেটের জন্য বাজারের মূল্য থেকে বেশি টাকা খরচ করছে? একে কিন্তু অজ্ঞতা বলা যাবে না।

আসলে যাঁরা সত্যকে ধামাচাপা দিতে চান তাঁরা কখনোই সত্যিটা দেখতে পান না।

দুর্ঘটনাপ্রবণ হ্যাল

এবার হ্যাল প্রসঙ্গে আসা যাক।

ইউপিএ সরকার যখন ২০০৭ সাল থেকে ১২৬টি রাফাল ক্রয়ের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল (২০১২ সালে হঠাৎ যে আলোচনার ইতি টেনে দেওয়া হয়), তখন ড্যাসল্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল যে হ্যালের সঙ্গে যৌথ ভাবে ফাইটার জেট উৎপাদন করা সম্ভব নয় কারণ যে ১০৮টি রাফাল হ্যাল তৈরি করবে তার মান সম্পর্কে তারা একেবারেই নিশ্চিত নয়।

বায়ুসেনা বহুদিন ধরেই ফাইটার জেট তৈরির ব্যাপারে হ্যালের কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছিল।

২০১৯ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি মিরাজ ২০০০ ট্রেনার জেটের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছিল যে রাফাল তৈরির দায়িত্ব হ্যালকে দেওয়া একেবারেই ঠিক হবে না। দুর্ঘটনার আগে ওই ট্রেনার জেটটি আপগ্রেড করেছিল হ্যাল।

রাহুল সংসদ ভবনে প্রশ্ন তুলেছে কেন ১২৬টি রাফালের প্রারম্ভিক অর্ডারকে কমিয়ে ৩৬টি করে দেওয়া হয়েছে। তা কিন্তু আদৌ হয়নি। বাকি ৯০টি রাফাল জেটের অনুমতি প্রস্তাবও তৈরি রয়েছে। সেগুলো ড্যাসল্টের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারতেই তৈরি হবে।

২০১২ সালে ইউপিএ সরকার রাফাল সংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ করে দেওয়ার পরে ২০১৫ সালে এনডিএ সরকার আবার এই সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করেছিল।

body2_021419043823.jpgফাইটার জেট উৎপাদনের ক্ষেত্রে হ্যালের কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বায়ুসেনা [ছবি: পিটিআই]

কিন্তু এর মধ্যেই আরও একটি কাহিনি উঠে আসছে। সঞ্জয় ভাণ্ডারী, দীপক তলোয়ার, রাজীব সাক্সেনা ও ক্রিশ্চিয়ান মাইকেলের মতো অস্ত্র ব্যবসায়ীরা নাকি ইউরোফাইটারের হয়ে তদ্বির করছিলেন - যা রাফেলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

ভাণ্ডারী নাকি রবার্ট ওয়াধেরা ও তাঁর সহযোগী মনোজ আরোরার ঘনিষ্ঠ। তিনি ২০১৬ সাল থেকে পলাতক। তাঁর বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টসের ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে এবং ভাণ্ডারীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের জন্য ওয়াধেরাকে ইতিমধ্যেই ইডির পক্ষ থেকে জেরা করা হয়েছে।

মাইকেল এই মুহূর্তে অগস্তা ওয়েস্টল্যান্ড ভিভিআইপি হেলিকপ্টার মামলায় তিহার জেলে।

তলোয়ার ও সাক্সেনাকে প্রতিরক্ষা চুক্তির ক্ষেত্রে ঘুষের মামলায় আরব থেকে প্রত্যার্পণ করা হয়েছে।

পরিশেষে অনিল আম্বানি

রাহুল গান্ধী বেশ ভালোভাবেই জানেন যে ছোট বড় মিলিয়ে ৩০,০০০ কোটি টাকার মূল্যের কন্ট্রাক্ট প্রায় এক ডজন সংস্থাকে দেওয়া হবে।

এর মধ্যে টাটা রয়েছে, মাহিন্দ্রা রয়েছে, ভারত ফোরজি রয়েছে এমনকি ড্যাসল্ট-রিলায়েন্সের একটি যৌথ উদ্যোগও রয়েছে। এই ৩০ হাজার কোটি টাকার কন্ট্রাক্টে অনিল আম্বানির সংস্থা কত কোটি টাকা পাবে? যৎসামান্য। ড্যাসল্ট নিজেই জানাচ্ছে যে ড্যাসল্ট-রিলায়েন্স যৌথ সংস্থাটি মাত্র ৮৫০ কোটি টাকা মূল্যের কাজ পাবে স্পেয়ার পার্টস তৈরির জন্য, রাফাল তৈরির জন্য নয়।

কিন্তু রাহুল বরাবরই দাবি করে আসছেন: "মোদী আম্বানিকে ৩০,০০০ কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছেন।"

এর পর মজা করে যোগ করেন" "২০১৭ সালে অনিল আম্বানির রিলায়েন্সের ব্যালেন্স সিটে কেন ৩০,০০০ কোটি টাকা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যা সেই সংস্থাটির রাফাল চুক্তি থেকে পাওয়ার কথা ছিল?

body3_021419043936.jpgরাফাল চুক্তিতে একমাত্র অনিল আম্বানির সংস্থাই বরাত পাচ্ছে না [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]

যেমন ভাবে নির্বাচনী ইস্তাহার ভোটারদের খুশি করতে তৈরি করা হয় ব্যালান্স সিটও শেয়ার হোল্ডারদের খুশি করতে সাজানো হয়ে থাকে। রাফালের অফসেট কন্ট্রাক্ট ১০০টি ভারতীয় সংস্থা পাবে। সুতরাং রিলায়েন্স যে ৩০,০০০ কোটি টাকা রাফাল চুক্তি থেকে পেয়েছে তা ভাবার কোনও কারণ নেই।

এর পর রাহুল আবার বলেছেন যে অনিলের কোম্পানি নাকি মাত্র দশ দিন বয়সে এই কন্ট্রাক্ট ড্যাসল্টের থেকে পেয়েছে।

তথ্যটি যে ভুল তা বিলক্ষণ জানেন স্বয়ং রাহুলও। এই কোম্পানিটি ২০ বছরের পুরোনো। ২০১৫ সালেই রিলায়েন্স ডিফেন্স গুজরাট পিপাপভ বলে একটি কোম্পানি কিনেছিল যা দু'দশকের বেশি ধরে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সরঞ্জাম উৎপাদন করে আসছে।

নির্বাচন বড় দায়

সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে গণনায় অংশগ্রহণকারী ৫৪ শতাংশ লোক মনে করছে আসন্ন নির্বাচন রাফাল চুক্তি বিতর্ক বড় ভূমিকা নিতে পারে।

রাফাল সংক্রান্ত ক্যাগ রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা ১১ ফেব্রুয়ারি হয়ে গিয়েছে।

আর ১৩ ফেব্রুয়ারি বাজেট অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়ায় এবার রাফাল বিতর্ক জনমানসে ঢুকে পড়বে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MINHAZ MERCHANT MINHAZ MERCHANT @minhazmerchant

Biographer of Rajiv Gandhi and Aditya Birla. Ex-TOI & India Today. Media group chairman and editor. Author: The New Clash of Civilizations

Comment