কৃষকদের সঙ্কটকে কী ভাবে কেন্দ্রীয় ইস্যু করে তুললেন রাহুল গান্ধী

কৃষকদের লড়াইয়ে রাহুলকে পেয়েছে কংগ্রেস, তিনি তিন রাজ্যে জয় নিশ্চিত করেছেন

 |  5-minute read |   29-12-2018
  • Total Shares

২০১১ সালের ঘটনা, বিকেল ৪টে নাগাদ একটি বাইকের পিছনের সিটে বসে উত্তর প্রদে.শের গ্রেটার নয়ডার ভাট্টা পরসৌলে পৌঁছালেন রাহুল গান্ধী – এটাই ছিল জমি অধিগ্রহণ বিলের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের মূল কেন্দ্র।

তখনও রাহুল গান্ধী ছিলেন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক (ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশনের দায়িত্বে)। তিনি কৃষকদের মাঝে বসে তাঁদের দুঃখ-দুর্দশরা কথা শুনলেন, তাঁদের সান্ত্বনা দিলেন, সঙ্গে থাকার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন, তাঁদের সঙ্গে চা খেলেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রামগুলিতে গেলেন এবং সব শেষে ভাট্টা পেরুসালে ধর্নায় বসলেন।

তিনি গ্রামে কৃষকদের সঙ্গে রাত কাটানোর আগেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে আগাম ব্যবস্থা হিসাবে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরে উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির সীমানায় এনে তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হয়।

তবে সেই আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁর মধ্যে ‘কৃষক নেতা’ হওয়ার বীজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

rahul-new_1_122918010934.jpgজমি অধিগ্রহণ বিলের প্রেক্ষিতে ভাট্টাল পারসৌলে আন্দোলন শুরু করেন রাহুল গান্ধী, উঠে আসে কৃষকদের দুর্দশার কথা (ছবি: পিটিআই)

কৃষকদের অধিকারের দাবিতে ভাট্টাল পরসৌলে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন আমেঠির সাংসদ, সেই আন্দোলন এখনও চলছে।

তাই যখন ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর তিনি টুইটে বললেন যে "কৃষকদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সব রকম ভাবে চেষ্টা করব", তিনি সেই কথাটাই মনে দিতে চেয়েছেন।

"কৃষকদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত" করা শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই ছিল না, তাঁর যে দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ছিল এবং যাকে তিনি বাস্তবায়িত করার জন্য চেষ্টা করে গেছেন, রাহুল গান্ধীকে তাঁর সেই অতিপ্রয়োজনীয় কাজের মঞ্চ দিয়েছে হিন্দি বলয়ের প্রাণকেন্দ্রের তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়।

তবে এই যাত্রাপথ অত্যন্ত দীর্ঘ।

রাহুল গান্ধী যে বারে বারে কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বারে বারে তুলে ধরছেন সেই কাজ তিনি শুরু করেছিলেন ভাট্টল পরসৌলে এবং জমি জমি অধিগ্রহণ বিল দিয়ে।

ওই খসড়া আইনে সম্মতি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি (কনসেন্ট ক্লজ) বাদ দিয়ে দেওয়ার জন্য মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে রাহুল গান্ধী সেই প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

modi-suit_1_122918011028.jpg'স্যুট বুট কি সরকার' বলে মোদীর শাসনকে আক্রমণ শানিয়েছেন রাহুল গান্ধী, একই সঙ্গে স্লোগান দিয়েছেন 'কংগ্রেস কি হাথ, কি সাথ' অর্থাৎ কংগ্রেসর হাত কৃষকদের সঙ্গে আছে (ছবি: রয়টার্স)

শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে সংসদীয় প্যানেল রাজি হয়ে যায় কনসেন্ট ক্লজ-সহ ছ’টি বিষয় প্রত্যাহার করে নিতে। সেটাই ছিল সব আছে ও সবহারাদের অধিকারের জন্য লড়াই আর সেই লড়াইকে জোরদার করেছিলেন রাহুল গান্ধী।

তার পরে মোদীর সময়কে ‘স্যুট বুট কি সরকার’ বলে বিদ্ধ করেন এবং একই সঙ্গে স্লোগান দেন ‘কংগ্রেস কা হাথ, কিষাণ কে সাথ’ অর্থাৎ কংগ্রেসের হাত কৃষকদের সঙ্গে রয়েছে।

উত্তরপ্রদেশে তাঁর কিষাণযাত্রায় কৃষকদের মধ্যে ক্রোধের আগুন বাড়ার আঁচ উপলব্ধি করেছিলেন রাহুল গান্ধী। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের জোট বিজেপির কাছে পরাজিত হলেও রাহুল গান্ধী তাঁর অতিপ্রিয় এই কর্মসূচি – কৃষকদের দুর্দশা – আঁকড়ে পড়েছিলেন এবং ২০১৭ সালে সেই কর্মসূচিরই উন্নততর একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে।

rahul-mandsaur_12261_122918011103.jpgমধ্যপ্রদেশে যখন পুলিশের গুলিতে পাঁচজন কৃষকের মৃত্যু হয়েছিল তখন জাতীয় নেতৃত্বের মধ্যে প্রথম রাহুল গান্ধীই মন্দসৌরে গিয়েছিলেন (ছবি: পিটিআই)

নবসর্জন যাত্রার সময় তাঁর কৃষকদের ছোট ছোট গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা, ছোট ছোট সভা এবং সরেজমিন পরিস্থিতি দেখা গুজরাট নির্বাচনের সময় গ্রামীণ জনতাকে কংগ্রেসের পক্ষে এনে দিয়েছিল।

২০১৭ সালের জুন মাসে যখন কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে আন্দোলন করার সময় মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে পুলিশের গুলিতে পাঁচজন কৃষকের মৃত্যু হয় তখন জাতীয়স্তরের নেতাদের মধ্যে প্রথম রাহুল গান্ধীই মন্দসৌরে উপস্থিত হন।

আবার সেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে ওই নিহত কৃষকদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ তিনি ওই জায়গা ছেড়ে যাবেন না বলে জানিয়ে দেন রাহুল গান্ধী।

২০১৭ সালে আরও একবার গুজরাট নির্বাচনে পরাজিত হয় কংগ্রেস তবে সামান্যর জন্য তবে রাহুল গান্ধী ততক্ষণে গ্রামীণ ভারতের, বিশেষ করে কৃষকদের ‘হৃদয়ের কথা’ শুনে ফেলেছেন।

কৃষিঋণ মকুব সাময়িক পদক্ষেপ হলেও কৃষকদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হিন্দি বলয়ের হৃদয়স্থলে নির্বাচনী প্রচারের সময়ে আরও কয়েকটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাহুল গান্ধী।

যে মুহূর্তে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে কংগ্রেস ক্ষমতায় এল সেই মুহূর্তে তারা কৃষিঋণ মকুব করে দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল।

ক্ষমতায় আসার দশ দিনের মধ্যে হিন্দিবলয়ের কেন্দ্রস্থলে কৃষিঋণ মকুব করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার পর এ বার তিনি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছেন দেশের কৃষিক্ষেত্র সঙ্কট মেটানোর জন্য।

rahul-polls_12261808_122918011135.jpgহিন্দি বলয়ের কেন্দ্রস্থলে তিন রাজ্যে নির্বাচনে জয়ের পরে নতুন মঞ্চ পেয়েছেন রাহুল গান্ধী (ছবি: পিটিআই)

তাঁর সমোলোচকরা অবশ্য ঋণ মকুব এবং দেশের অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে কথা বলছেন, তবে রাহুল গান্ধী খুব ভালো করেই জানেন যে কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটানোর জন্য যে কাঠামো প্রয়োজন তা গড়ার জন্য যথেষ্ট সময় দরকার। আমেঠির সাংসদ ইতিমধ্যেই তাঁর সেনাপ্রধানদের নির্দেশ দিয়েছেন, দীর্ঘ মেয়াদে এই সমস্যা কী ভাবে দূর করা যায় তা ভাবতে।

কৃষকদের চরম সঙ্কট থেকে কী ভাবে নিস্তার দেওয়া যায় সেই পরিকল্পনার কথা  কংগ্রেসের ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনী ইস্তাহারে থাকবে।

ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক পিএল পুনিয়া বলেছেন, “মোদী সরকার যখন সব কিছু সুন্দর ভাবে চলছে বলে প্রচারে ব্যস্ত ছিল তখন কৃষিক্ষেত্রে সঙ্কট দানা বাঁধছিল। কৃষকদের দুর্দশার কথা জাতীয় স্তরে তুলে আনার জন্য এবং জাতীয় রাজনীতিতে এটিকে স্থান করে দেওয়ার সমস্ত কৃতিত্বই রাহুল গান্ধীর প্রাপ্য।”

ইত্যবসরে কিষাণ কংগ্রেসকে নতুন ভাবে গড়েছেন রাহুল গান্ধী, এই সংগঠনটি বহু বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়েছিল, তিনি দেশের সমস্ত কৃষক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে চলেছেন। এক বরিষ্ঠ কংগ্রেস নেতার কথায়, “২০১৯ সালের নির্বাচন হতে চলেছে শ্রেণী ও জাতপাত-ভিত্তিক। আমরা ইস্যুভিত্তিক লড়াই করছি – কৃষকদের অধিকার ও বেকারত্ব নিয়ে – আমরা বিজেপির মতো নই যারা শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার লাইনে কথা বলে। রাহুল গান্ধী সেই সব বিষয় নিয়েই কথা বলছেন যে বিষয় নিয়ে বিজেপি কোনও কথা বলে না।” এখন কংগ্রেস পরিকল্পনা করছে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন করার কথা।

কৃষকদের অধিকারের লড়াইকে তিনি পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবেন বলে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি প্রায়ই বলে থাকেন “হম পিএম কো চয়ন সে নহি সোনে দেঙ্গায়ে (আমরা প্রধানমন্ত্রীকে শান্তিতে ঘুমাতে দেব না) যতক্ষণ পর্যন্ত কৃষিঋণ মকুব করা না হচ্ছে। তিনি যদি এ কাজ না করেন তা হলে ২০১৯ সালে যখন আমরা ক্ষমতায় আসব তখন আমরা ১০০ শাতংশ এই কাজ করব।”

সংসদের বাইরে তিনি যখন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তিনি বলেন, “আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে ১০ দিনের মধ্যে আমরা ঋণ মকুব করব, আমরা ছ’ঘণ্টার মধ্যে সেই কাজ করে দেখিয়েছি,” এই কতার মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দলের প্রধান নেতা এই ইস্যু তুলতেই থাকবেন।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিশ্রী ভাবে পরাজয়ের পরে কংগ্রেস নিজেকে বাঁচানোর জন্য চাইছিল অলৌকিক কোনও কিছু ঘটে যাক। শেষ পর্যন্ত তারা কৃষক-দরদী নেতা পেয়েছে – রাহুল গান্ধী – যিনি হিন্দি বলয়ের কেন্দ্রে তিনটি রাজ্যে জয় নিশ্চিত করতে পেরেছেন। ২০১৯ সালে ভারতীয় রাজনীতিতে একজন কৃষকদরদী নেতার উত্থান দেখা এখন প্রায় নিশ্চিত।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUPRIYA BHARDWAJ SUPRIYA BHARDWAJ

Journalist. Life is a journey, Live it, Love it.

Comment