পুলওয়ামার পর: যে কঠিন প্রশ্নগুলো প্রধানমন্ত্রীকে করা উচিত ছিল রাহুল গান্ধীর

পুলওয়ামায় হামলার পরেও আশ্চর্যজনক ভাবে চুপ রাহুল গান্ধী, এখনই তো প্রশ্ন করার সময়

 |  6-minute read |   22-02-2019
  • Total Shares

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সাধারণ মানুষের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য, আমার আগের লেখায়, আমি কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর প্রশংসা করেছিলাম। যে যখন কোনও সমস্যায় পড়েছে, তখন সে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানানো হোক বা পুলিশের লাঠি ও গুলির মুখে দাঁড়ানো হোক, তিনি তখনই সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছেন। বর্তমানে চলতে থাকা সাম্প্রদায়িক আঁধারের মধ্যে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যতের আলো জ্বালিয়েছিলেন, আমি তাঁর মধ্যে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলাম – কিন্তু গত এক সপ্তাহে তিনি আমাকে আশাহত করেছেন।

পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার পরে রাহুল গান্ধী অত্যন্ত নিরীহ শব্দ চয়ন করে একটি প্রেস বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি সরকারের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানিয়ে বলেন যে, সরকার যে কোনও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে পারে, এ জন্য এখন কোনও রকম আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। ভারতের আমজনতার পাশে দল হিসাবে সমবেত ভাবে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেস এবং তিনি যে কঠিন রাজনৈতিক এই চ্যালঞ্জের মোকাবিলায় সরকারের পাশে সর্বতো ভাবে রয়েছেন, সেই বার্তাও স্পষ্ট ভাবে দিয়েছেন।

rahul_gandhi_pti_022219070357.jpegতিনি আবার নীরব হয়েছেন। তবে কঠিন প্রশ্নগুলো করার এটাই সময়। (ছবি: পিটিআই)

তিনি আগে টুইট করা ছাড়া নীরবই থাকতেন, এখনও নীরবই রয়েছেন। পূর্ব উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব প্রাপ্ত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তাঁর প্রথম সাংবাদিক বৈঠক বাতিল করেছেন এবং সেই বৈঠক কবে তিনি করবেন তা এখনও জানানো হয়নি।

পুলওয়ামায় হামলার পরে রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার পোড়খাওয়া রাজনীতিকের মতো সুচারু আচরণ দেখে যখন সকলে ধন্য ধন্য করছেন তখন ওই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলওয়ামার সেই বিয়োগান্ত ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার রাজনীতিকরণ করার জন্য ও  নির্বাচনী বক্তৃতা করার জন্য তীব্র ভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ।

হিন্দি বলয়ের প্রাণকেন্দ্র বলতে যা বোঝায় সেই জায়গায় নির্বাচনী পরাজয়ের পরে নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা অত্যন্ত দ্রুত বদলাচ্ছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই রাফাল বিতর্ক  নিয়ে আলোচনার পরে, নাগরিকত্ব বিল নিয়ে উত্তরপূর্ব ভারত যখন জ্বলছে এবং যখন একের পর এক জোটসঙ্গী তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তখন সুস্পষ্ট ভাবেই মোদীর ভাবমূর্তি প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকছিল। পুলওয়ামায় আচমকা হামলা সবকিছু বদলে দিল।

রাহুল গান্ধীর নীরবতা আমাদের হতাশ করেছে। কংগ্রেস দল যে জাতীয় দুর্দিনে রাজনীতি করেনি তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। যাই হোক, সত্যি কথাটা হল, কঠিন সময়ে আমাদের দেশ উপযুক্ত ক্ষমতা ও সহনশীলতা দেখিয়েছে। কিন্তু রাহুল গান্ধীর এই দীর্ঘ নীরবতা একটা কথা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে কংগ্রেস এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। এখন কৌশলগত নীরবতা ভঙ্গ করার সময় হয়েছে রাহুল গান্ধীর এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের অনুভূতি উপলব্ধি করার সময়ও হয়েছে। আচমকা আঘাতের অভিঘাত থেকে মানুষ এখন বেরিয়ে এসেছে এবং এখন তারা চাইছে কঠোর-কঠিন ভাবে এর প্রতিশোধ নেওয়া হোক এবং একই সঙ্গে তারা কয়েকটা কঠিন প্রশ্ন তুলেছে। এখন যবনিকা উন্মোচন করে বেরিয়ে এসে বিরোধী কণ্ঠকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে রাহুল গান্ধীকে, সেই সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলতে হবে – যে সব প্রশ্ন ইতিমধ্যেই টুইটারে উঠেছে।

এর মধ্যে রয়েছে:

১। পুলওয়ামা হামলার বড়জোর এক সপ্তাহ পরে, তখনও পর্যন্ত যখন পুরো দেশ শোকাচ্ছন্ন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ দেখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে তখন প্রধানমন্ত্রীর কী প্রয়োজন হয়েছিল রীতি ভেঙে বিমানবন্দরে গিয়ে সৌদি আরবের যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমনকে স্বাগত জানানোর এবং অকারণ জড়িয়ে ধরার?

ছবিতে দেখা গেছে, যে বিমানে চড়ে সৌদি আরবের যুবরাজ এসেছেন সেই বিমানের সিঁড়ির নীচে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং তিনি নামতেই তাঁকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন, আমার কাছে এই দৃশ্য অত্যন্ত কদর্য বলে মনে হয়েছে বিশেষ করে যখন পাকিস্তান বিরোধী আবেগ একেবারে চরমে। যে ব্যক্তি নিজেকে পাকিস্তানের দূত বলে আত্মপ্রচার করেন, একজন সাংবাদিককে হত্যার নেপথ্যে যিনি রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে, যিনি পাকিস্তানকে ২০০০ কোটি মার্কিন ডলার সাহায্য করেছেন তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে, এই ঘটনায় দেশবাসী কি আহত হবেন না – এবং বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের মদত দেওয়ার ব্যাপারে যখন যথোপযুক্ত কোনও কথাই হয়নি?

এটাই মোদীর কঠিন পদক্ষেপের নমুনা?

bin-salman-copy_0220_022219070440.jpg ‘পাকিস্তানের দূত’কে এমন বিপুল সংবর্ধনার কি কোনও প্রয়োজন ছিল? (ছবি: পিটিআই)

২। কেন প্রধানমন্ত্রী নিশ্চুপ রইলেন, বিশেষ করে যখন সারা দেশ জুড়ে কাশ্মীরি পড়ুয়া, ব্যবসায়ী ও শিক্ষাসমাজের উপরে হামলার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে? যখনই কোনও দেশ কোনও জাতীয় সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়, তখন রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম ও আবশ্যিক কাজ হল দেশের মানুষকে শান্ত থাকার জন্য আবেদন করা এবং একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আবেদন করা।

এখনও কেন সেই কাজ করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী?

জনসমক্ষে এসে বা টুইট করে এখনও পর্যন্ত শান্তি ও সৌভাতৃত্ব বজায় রাখার আবেদন তিনি করেননি।

তিনি কি ইচ্ছাকৃত ভাবে এ কাজ করছেন – নাকি এই কাজটি করতে তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন?  টুইটারের একটি ভোটে মোট ৬৬১ জন যোগ দেন এবং তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই মনে করেন যে মোদীর এই নীরবতা ইচ্ছাকৃত, কারণ তিনি যে ধরনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেশ খাপ খায়।

২০০২ সালে গুজরাটের গোধরায় ট্রেন পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার পরে, নরেন্দ্র মোদী নিয়ম ভেঙে করসেবকদের শবদেহগুলো আমেদাবাদে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে শোনা যায়। সেই শবদেহগুলো না ঢেকে মিছিল করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, এ থেকেই লোকের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। পরে সেই দেহগুলি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল সদস্যদের হাতে দেওয়া হয়।

আমেদাবাদের তৎকাললীন পুলিশ কমিশনার পিসি পাণ্ডে সরকারকে স্পষ্ট ভাবে লিখিত আকারে জানিয়েছিলেন যে দেহগুলিকে যেন স্থানান্তরিত না করা হয়, তবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। গুজরাট প্রদেশ কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি অর্জুন মোধওয়াড়িয়া টুইটারে বলেছিলেন যে, গুজরাটে দাঙ্গায়  সময়েও মোদী কোনও দিন শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কোনও সুস্পষ্ট আবেদন করেননি।

৩। পুলওয়ামায় জঙ্গিহামলায় ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত এই চূড়ান্ত গোয়েন্দা-ব্যর্থতার জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী কে, এর যথাযথ উত্তর ও ব্যাখ্যা আমরা কবে জানতে পারব? এই ভয়াবহ হামলার জন্য আমরা যতই পাকিস্তানকে দোষ দিতে থাকি না কেন, এটা কি ঘটনা নয় যে জম্মু-কাশ্মীরে এখন রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে – তাই সীমান্তে নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এখন সম্পূর্ণ ভাবেই দায়বদ্ধ? তা হলে এ ক্ষেত্রে এই ঘটনার জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী কে?

২০১৮ সালে কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি ঠিক সেই প্রশ্নগুলিই করেছিলেন যেগুলি ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে। মোদী প্রশ্ন করেছিলেন, “যখন দেশের সীমান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের নিযন্ত্রণাধীন, তা হলে জঙ্গিরা কী ভাবে দেশের মধ্যে ঢুকতে পারে? তারা কী ভাবে অস্ত্র ও গোলাগুলি হাতে পায়? এগুলো নিশ্চয়ই বিদেশ থেকে আসছে, তাই কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়া আর কে দায়ী হবে।”

এখন রাহুল গান্ধীকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সেই একই প্রশ্ন করতে হবে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SANJUKTA BASU SANJUKTA BASU @sanjukta

Freelance writer, photographer and women studies scholar, and a part of the Karwan E Mohabbat group. She writes on social marginalisation, minority rights and women issues.

Comment