বাজেটের পরের দিনই রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জনসভা
রাজ্যে দুই সভাতেই আক্রমণাত্মক মোদী, নিরাশ করেননি রাজনাথও
- Total Shares
ঢেঁকির দোলায় দুলছে ভারতের রাজনীতি। কখনও বাঁদিক উপরে ডানদিক নীচে, কখনও ডানদিক উপরে বাঁদিক নীচে। গত ছ’মাস পাঞ্জাবির হাতা গুটোচ্ছিলেন রাহুল গান্ধী, মাঝে কলকাতার ব্রিগেড মঞ্চে উদ্বাহু হয়েছেন একগুচ্ছ নেতানেত্রী। এবারে তাল ঠুকছেন নরেন্দ্র মোদী।
এই প্রথম বাজেটের পরদিনই (সে অন্তর্বর্তী হোক বা পূর্ণাঙ্গ হোক), কোনও প্রধানমন্ত্রী সরাসরি উড়ে এলেন পশ্চিমবঙ্গে।
ঠাকুরনগরের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। (ছবি: সুবীর হালদার)
কোনও জনসভায মানুষের উপস্থিতি কোনও দিনই নির্বাচনের দিক নির্দেশ করে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। অন্তত সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস তাই বলে। তাই যদি হত তা হলে ২০০১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হতেন অথবা ২০১১ সালে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হতেন না।
কিন্তু এটাও ঠিক যে, ভিড়ের মনঃস্তত্ত্ব যদি একটু খুঁটিয়ে দেখা যায় তা হলে ২০০১ সালেই পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। ভোটবাক্সে যার প্রতিফলন ঘটেছিল ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে।
২০০৯ থেকে ২০১১ – পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার বাস্তবে ছিল কেয়ারটেকার সরকার। ঠাকুরনগর ও দুর্গাপুরে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় ভিড় এবং ভিড়ের মনঃস্তকে যদি আতসকাচের তলায় ফেলা যায় তা হলে তৃণমূলের কপালে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখতে পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
একদিকে যে কোনও এক অজানা কারণে রাফাল নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন রাহুল গান্ধী। অন্য দিকে ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশের মঞ্চের ছবিটা ঠিক কতটা ইতিবাচক প্রভাব মানুষের উপর ফেলেছে এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। সবার শেষে বাজেটের পরদিন প্রধানমন্ত্রীর রণংদেহী শরীরী ভাষা ঢেঁকির ভারসাম্য বেসামাল করে দিয়েছে – এটা বলাই যেতে পারে।
রাজ্য বিজেপিকে কিছুটা স্বস্তি দিয়ে এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রাজনাথ সিংও বেশ আক্রমণাত্মক থেকেছেন উত্তরবঙ্গে। শনিবারের সারাটা দিন বুঝিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পাখির চোখ।
যদিও এটা বাস্তব যে, যে উৎসাহ প্রধানমন্ত্রীর সভায় লক্ষ্য করা গেছে তার কত শতাংশ ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হবে সেটি ওই দলের রাজ্যনেতৃত্বের উপর উপর নির্ভর করছে এবং সেখানে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন মানুষের মনে রয়ে গেছে।
দুর্গাপুরে আক্রমণাত্মক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। (ছবি সৌজন্য: টুইটার)
একদিকে ব্রিগেড থেকে মমতা যেমন চেষ্টা করেছেন লড়াইয়ের অভিমুখটা রাজ্য থেকে কেন্দ্রের দিকে ঘুরিয়ে দিতে, অর্থাৎ তিনি তাঁর অনুগামীদের বোঝাতে চেয়েছেন ২০১৯-এর নির্বাচন কেন্দ্রের সরকার পরিবর্তনের, রাজ্যের নয়। উল্টোদিকে মোদী চেষ্টা করেছেন তাঁর অনুগামীদের এই বার্তা দিতে যে, ২০১৯-এর নির্বাচন ২০২১-এর পরিবর্তনের প্রাথমিক ধাপ। ঠিক যেমনটি ২০০৯ ও ২০১১-র ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
একটু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলে এটা ঠিক যে অন্তর্বর্তী বাজেট রাহুল গান্ধীর বহুল প্রচারিত মাস্টারস্ট্রোক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ওয়াধেরাবাকেও পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছে। এই বাজেটকে হাতিয়ার করে যে ভাবে দুর্গাপুরে দীর্ঘ ভাষণ রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী, তাতে মনে করাই যেতে পারে গত ৬ মাস ধরে খোলসের ভিতরে লুকিয়ে থাকা নরেন্দ্র মোদী যেন আবার স্বমূর্তিতে ফিরে এলেন।
বিরোধী রাজনীতিতে এর ২ রকমের প্রভাব পড়তে পারে। এক, যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে রেখে কংগ্রেস এবং আঞ্চলিক দলগুলি আরও জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করবে, অথবা দুই, চাচা আপ প্রাণ বাঁচা তত্ত্বকে সামনে রেখে সবাই নিজের নিজের ঘর গোছানোর দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।
একটা আলোচনা সংবাদমাধ্যমে লক্ষ করা যাচ্ছিল যে, কোনও ভাবে হয়তো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাজনাথ সিং বা নীতিন গড়কড়ির মতো কাউকে আস্তিনের নীচে লুকিয়ে রাখতে পারে সঙ্ঘ পরিবার, কিন্তু গতকাল আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতও ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছেন যে অন্তত নির্বাচনী প্রচারপর্বে নরেন্দ্র মোদীই সঙ্ঘ পরিবারের তুরুপের তাস।
ফালাকাটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। (ছবি সৌজন্য: টুইটার)
এতে বিরোধী পক্ষের সুবিধা হল নাকি অসুবিধা হল, তা ভবিষ্যৎ বলবে, কিন্তু কোনও না কোনও জায়গায় বোধহয় এই ইঙ্গিতটার অপেক্ষাতেই ছিলেন নরেন্দ্র মোদী যেটি তাঁর দুর্গাপুরের ভাষণ থেকেই যথেষ্ট স্পষ্ট।
ঘটনা যতই অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির নিরিখে মানিক মজুমদার নামক ব্যক্তির বাড়িতে সিবিআইয়ের পৌঁছে যাওয়া একটা বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিষয়টি এখন নগ্ন ভাবে সম্মুখ সমর হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই ঘটনা হয়তো উত্তরপ্রদেশে ঘটতে পারে, বিহারে ঘটতে পারে, কর্নাটকে ঘটতে পারে, অন্ধ্রপ্রদেশে ঘটতে পারে। দিল্লি ও হরিয়ানাতেও ব্যতিক্রম ঘটতে পারে বলে মনে হয় না।
এখন এটি সিবিআই-এর অপব্যবহার নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেটি প্রমাণ করা যুযুধান দুই পক্ষের নিজেরনিজের ক্ষমতার উপর নির্ভর করবে। কিন্তু পাঠকের জেনে রাখা দরকার, গত ১০ বছরে উঠে আসা সাংবাদিকমহল বেশ কিছু সময় ধরে মানিক মজুমদার ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করতেই সক্ষম হয়নি। অন্তরালে থাকা এমন এক ব্যক্তিত্বের বাড়িতে সিবিআই-এর পৌঁছে যাওয়া – প্রবীণ সাংবাদিকরা অন্তত অকিঞ্চিৎকর ঘটনা বলে মনে করছেন না। পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে ১৯ জানুয়ারি ভোটের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাই প্রধানমন্ত্রীর পশ্চিমবঙ্গ সফর, বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশ বা নির্বাচন কমিশনের কলকাতা সফর।
সবকিছু মিলিয়ে রাজ্য এবং দেশ নির্বাচনের অভিমুখে দৌড়ে চলেছে।