সবরীমালা থেকে অযোধ্যা: ঈশ্বরের নামে রাজনীতি
আশা করা যায় যে ভোটাররা বুঝতে পারবেন কত সহজে রাজনীতিকরা তাঁদের বোকা বানান
- Total Shares
উনি আমার দিকে তাকিয়ে মালয়লামে কিছু একটা বললেন, সেটা আমি বুঝতে পারিনি। হাতে আঁটির মতো কিছু একটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন লম্বা এক যুবক। তিনি তাঁর লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে গুটিয়ে খুঁট দুটো বাঁধতে বাঁধতে অঙ্গভঙ্গি করে তাড়াহুড়ো করে কথা গুলো বললেন। আমার সহকর্মী শালিনীকে তিনি যে কথাগুলি বললেন তার থেকে একটিমাত্র শব্দ আমি বুঝতে পারলাম, তিনি আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললেন ‘মুসলিম’। তিনি শব্দটা বারে বারে বললেন, তার পরেই বেশ কয়েকজন বাইকআরোহী আমাদের ক্যামেরার আশপাশে জড়ো হয়ে গেলেন।
এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শবরীমালা যাওয়ার পথে আমরা একদল লোকের হাতে আক্রান্ত হলাম। শেষকালে আমরা দেখছিলাম একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ওই জায়গা থেকে পরের ৬০ কিলোমিটার পথে আমরা একই রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কেরলের মতো প্রগতিশীল রাজ্যেও কী ভাবে ধর্মের নামে ঝড়ের গতিতে আক্রোশ ও ঘৃণা ছড়ানো হয় পুরো রাস্তায় সে কথা ভেবে আমি শিউরে উঠছিলাম। আমি অবশ্য বুঝতে পারছিলাম যে হামলার খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে, কারণ স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে তার ছবিও দেখানো শুরু হয়ে যায়।
ধর্মীয় ভাবাবেগের নামে ঐতিহাসিক বিচারকে অসম্মান করার আদর্শ উদাহরণ হল শবরীমালা (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
স্থানীয় নেতারা যখন সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত আক্রোশ ছড়িয়ে পড়ছে।
একটি পেট্রোলপাম্পে কোনও একজন আমার দিকে কটাক্ষ করছিলেন, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই সেখান থেকে আমরা চলে গেলাম।
ধর্মীয় ভাবাবেগের নামে ঐতিহাসির রায় অগ্রাহ্য করার আদর্শ উদাহরণ হল শবরীমালা এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থে এই পরিস্থিতির ফায়দা লুঠছে। ‘ঐতিহ্য রক্ষা ধর্মীর স্বাধীনতা’র নামে হিংসাত্মক বিরোধিতা হয়ে চলেছে।
স্ক্রিনশট
বিজেপি এখন কেরলে প্রভাব বিস্তার করতে তৎপর, তাদের কাছে শবরীমালা উপযুক্ত একটা ছুঁতো – তারা নিজেদের বিশ্বাসের ধারকবাহক বলে তুলে ধরে শাসকদল সিমিপএমের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে।
বিজেপির নীরবতা থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শবরীমালায় স্বামী আয়য়াপ্পা মন্দিরে ১০ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছিল তা নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি, তবে পরে তারা আইনের তোয়াক্কা না করা ওইসব প্রতিবাদীদের মদত দিতে থাকে।
কেরালা সরকারকে আবার আইন বলবৎ করার বদলে সেখান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় যাতে ওই দুর্বৃত্তরা অবাধে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারে।
লাভের অঙ্ক ভালোভাবে কষেই বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এর কয়েক সপ্তাহ পরে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন করলেন প্রতিবাদীদের এবং একই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন ভাবে মহিলাদের হুমকিও দিয়ে রাখলেন যে মহিলা ভক্ত ও একই সঙ্গে বামপন্থী সরকার যেন ‘আগুন নিয়ে খেলা’ না করেন।
শবরীমালা রায়ের কয়েক সপ্তাহ পরেই সুপ্রিম কোর্ট আরও একটি রায় জানানোর কথা ছিল যেটা আসলে অনুপুঙ্খ এটি বিবেচনার বিষয়।
ভারতে ধর্ম ছাড়া কোনও রাজনীতি হয়নি (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
পরিতাপের বিষয় হল, অযোধ্যা জমি নিয়ে বিতর্কের বিষয়টি ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালত পিছিয়ে দেওয়ায় আসন্ন নির্বাচনের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা স্থির হয়ে গিয়েছে।
ঢিলেঢালা গেরুয়া বসন পরিহিত শান্ত দর্শন মহন্ত ধরম দাসও সোমবার সুপ্রিম কোর্টের তিন মিনিটের শুনানি শেষে কঠোর সমালোচনা করলেন। কোনও আইনি তাৎপর্য থাক বা না থাক বোমাটি তিনি ফাটিয়ে ফেললেন। তিনি বললেন, “তাঁরা নিজেদের সরকারের প্রভু বলে মনে করেন, দাস বলে নয়। তাঁরা ভুল ধারনা পোষণ করেন। তাঁরা কেন আমাদের সকলের কথা শুনলেন না?”
সাধারণ নির্বাচনের আগে গরমাগরম রামমন্দির ইস্যুও একেবারে ভোটারদের পাতে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। অযোধ্যা বিতর্ক মামলা নিয়ে এবার রাজনৈতিক জাল বোনা শুরু হবে, প্রতিপক্ষরাও যা করবে তা সবই চিত্রনাট্য মেনেই। তাই মিডিয়ায় স্বচ্ছন্দ অনর্গল বলে যেতে পারেন এমন একজন নেতা দরকার এই ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য, সুন্দর ভাবে নিজেকে সাজিয়েগুছিয়ে নিয়ে অতিনাটকীয় ভাবে একের পর এক বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে যেতে হবে।
স্বঘোষিত হিন্দু মুখপাত্র বলে দাবি করা বিজেপির গিরিরাজ সিং এবং রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বহীন বিনয় কাটিয়ারের মতো নেতারা টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে ঠিক সময়মতো বলতে শুরু করে করে দেবেন – “হিন্দুয়োঁ কে সবরা কা বান্ধ টুট রাহা হ্যায়” এবং “কব তক সবরা করেঁ রাম-ভক্ত?” গোছের কথাবার্তা।
এই রকম এক সময়েই আরএসএস প্রমুখ তাঁর অধ্যাদেশ ‘ব্রহ্মাস্ত্র’টি প্রয়োগ করলেন। গত দশেরায় নির্বাচনের আগে জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর শেষ বক্তৃতায় দক্ষিণপন্থী সেই প্রতিষ্ঠানটিকে শ্রীরামচন্দ্রের একনিষ্ট হিসাবে তুলে ধরতে তাঁর কোনও বাগাস্ত্রই প্রয়োগ করতে বাকি রাখেননি মোহন ভাগবত এবং তিনি শেষ অস্ত্রটিও প্রয়োগ করে দিয়েছেন।
তার ঠিক পরেই নিজের খেলা শুরু করে দিলেন ওয়াইসি, ঠিক জায়গায় ঠিক টোপটি ফেলে ‘৫৬ ইঞ্চি ছাতির অধিকারী’কে তাঁর হুঙ্কার, একবার তিনি অধ্যাদেশ জারি করেই দেখুন। তার পর থেকে তিনি সেই অধ্যাদেশের সুর ভেঁজেই চলেছেন।
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল সমসলিমিনের প্রধান এখন অযোধ্যা নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করার ব্যাপারে বিজেপির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
এই রাজনৈতিক রঙ্গের মাঝে চিরকালই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা কংগ্রেস ছুটে বেড়াচ্ছে। কংগ্রেস নেতাদের এখন পিচ্ছিল দড়ির উপরে থাকা ট্র্যাপিজ-শিল্পীর দশা, তাঁরা বুঝতেই পারছেন না যে কী ভাবে ‘জনুধারী শিবভক্ত’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয়’ ভাবমূর্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করবেন।
ভারতে যে যে ধর্ম ছাড়া কোনও রাজনীতি হয় না এ কথা সত্য। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও মনে করতেন যে ধর্ম ছাড়া রাজনীতি প্রায় অর্থহীন, তবে গান্ধীর ধর্ম ছিল অহিংসা, ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে এমন কাজ কখনোই তিনি করতেন না।
আশাকরি যে ভোটাররা খুব শীঘ্রই বুঝতে পারবেন কত সহজে রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের ধর্মের নামে বোকা বানাচ্ছেন এবং প্রগতিশীল ও শক্তিশালী ভারত গড়ার জন্য ভোট চাইছেন।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

