মোদীও কি চাইছেন বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকুন শেখ হাসিনাই?
বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে, তা অনেকেরই প্রত্যাশার বাইরে ছিল।
- Total Shares
বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বিগত নির্বাচনে বিএনপি অংশ গ্রহণ না করায় বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কারণ জাতীয় সংসদের যারা বিরোধী দলের চেয়ারে আছে তারাই আবার সরকারের মন্ত্রী সভায়ও। স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের কাগজে কলমে থাকা বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বলেই জানে দেশ-বিদেশের মানুষ। অনেকেই মজা করে বলেন-বাংলাদেশের রাজনীতিতে একসাথে সরকার ও বিরোধী দল পরিচালনা করে নজির গড়েছেন এখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমান সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মেয়াদ চলছে দ্বিতীয় বারের মত। ৯ বছরের অধিক সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় আরেক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে একেবারেই। বিশেষ করে গত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সংসদেও প্রতিনিধিত্ব নেই তাদের। এর মধ্যে দলীয় প্রধান বেগম জিয়া দুর্নীতির দায়ে কারাবাসের কারণে দলটিতে এখন বিরাজ করছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
এদিকে এবছরের শেষে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। বিগত নির্বাচনে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ গ্রহণ না করায় ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। যদিও বহি:বিশ্বে এ নির্বাচনের গ্রহণ যোগত্য নিয়ে প্রশ্ন ছিল প্রথম থেকেই। তাই এই মূহুর্তে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রধান আলোচনার বিষয় হচ্ছে আগামি জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের যোগ দেওয়া, না দেওয়া। বিশ্বে বাংলাদেশের সকল মিত্রদের দাবি সকল রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণে আগামি জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু বিএনপির দাবি আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে জাতীয় নির্বাচনে যাবে না তারা। নতুন ইস্যু দাড়িয়েছে দলীয় প্রধান বেগম জিয়া। দুর্নীতির দায়ে জেলে থাকা বেগম জিয়াকে বন্দী রেখে তার দল নির্বাচনে যাবে না এটা এখন পরিষ্কার ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপ না থাকলেও প্রভাব দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের গত জাতীয় নির্বাচনে যা প্রকাশ্য রুপ পেয়েছে। ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের, বিশেষ করে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণববাবুর কারনেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনটা করতে পেরেছিল বলেই ধারনা সর্বমহলে। বাংলাদেশের নির্বাচনের কিছুদিন পর ভারতের জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস হারলে তাই সবাই মনে করেছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের বিএনপি নেতারা সরাসরি দাবি করেছিলেন মোদীর সরকার হাসিনাকে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করবে। কিন্তু কংগ্রেসের ধারাবাহিকতায় বিজেপিও হাসিনা সরকারের পাশে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বে বাংলাদেশের সকল মিত্রদের দাবি সকল রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণে আগামি জাতীয় নির্বাচন
আগেই বলেছি, আগামি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে এখন যে অনিশ্চতার আভাস চলছে সেখানে প্রধান বিষয় বিএনপি ও তাদের মিত্রদের যোগ দেওয়া, না দেওয়া। বাংলাদেশের মিত্র ও উন্নয়ন সহযোগিদের দাবি সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় অভ্যন্তরীণ উদ্যোগে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির সমঝোতার সূযোগ নাই। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে হলে চাই দেশের বাইরের উদ্যোগ। এ অবস্থায় কান্ডারী সেই পরীক্ষিত বন্ধু ভারতই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু তারা এখন ক্ষমতার বাইরে। এখন প্রশ্ন-ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগের নয়া মিত্র বিজেপির সরকার কি বাংলাদেশের অভ্যান্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে কংগ্রেস এর মত?
কেন বিজেপির প্রেমে আওয়ামী লীগ?
ভারতের রাজনৈতিক ইস্যুতে নতুন স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। কংগ্রেস-প্রেমী আওয়ামী লীগ হঠাৎ করেই বিজেপির প্রেমে পড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য- ভারতের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় তারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশটির প্রধান দুই দলের আমন্ত্রণে সম্প্রতি ভারত সফর করেছে আওয়ামী লীগ নেতারা। সম্প্রতি অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে।
এছাড়া ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আমন্ত্রণে ২২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি সফর করেছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেক নেতাই জানিয়েছেন, দেশটির প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের ভারত সফর প্রমাণ করে দেশটির সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা। সম্প্রতি প্রতিনিধি দলের ভারত সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে- দলটির পক্ষ থেকে এমন দাবিও করা হয়েছে। দলটির বেশ কয়েকজন নেতার দাবি, বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতি করে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতির বাহক ন্যাশনাল কংগ্রেস।
সে সুবাদে ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মিত্রতা বরাবরই ছিল। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সহযোগিতা চায় আওয়ামী লীগ। তাই বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দলটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতা গাঢ় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ যে শুধু কংগ্রেসমুখী নয় বরং সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, সেটাই দৃশ্যমান করা হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টিরসম্পর্ক বাড়িয়ে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বিজেপি সম্পর্ক…
বিজেপি পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বিজেপি-আওয়ামী লীগ সম্পর্ক নিয়ে বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উন্নতির প্রভাব পড়েছে দুই দেশের শাসক দলের সম্পর্কে। তার কথায়, "বিজেপি সব সময় চায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক- গণতন্ত্রের ধারা বহমান থাকুক, আর তার মধ্যে দিয়ে সে দেশের পলিটি এগিয়ে যাক। আর পাশাপাশি সেখানে 'ডিসরাপ্টিভ ফোর্স' বা গণতন্ত্র ধ্বংসকারী শক্তিগুলো যেন পর্যুদস্ত হয়।" ড: গাঙ্গুলি বলেছিলেন, "আর এই যে একটা ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ ভারতে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ, ব্যাপারটা আদৌ সেরকম কিছু নয়। ভারতে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকুক, আমরা সব সময় চেয়েছি পররাষ্ট্রনীতিতে একটা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। বিজেপিও বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগকে সেই দৃষ্টিতেই দেখে এসেছে"। এদিকে বিজেপির সঙ্গে বিএনপির খোলামেলা সম্পর্ক এখনও গড়ে ওঠেনি বলে দাবি করেছেন ড. গাঙ্গুলি। তার মতে, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, খালেদা জিয়া তখন দেখাও করেননি। এছাড়া দীর্ঘদিনের আলোচনা, বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানপন্থী জামায়াতের সম্পর্কটা কী- তা পরিষ্কার জানতে চায় ভারত। এই জিনিসটা যতক্ষণ না স্পষ্ট হচ্ছে, ততক্ষণ অনেক কিছুই অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে। ভারতের কাছে জামায়াত দলটি বিরোধী শিবির বলেই পরিচিত। জামাতকে নিয়ে বিএনপির কী পরিকল্পনা, সেগুলো পরিষ্কার না হলে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বা কৌশল করা যায় না। ফলে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কটা কেমন হবে, তা নির্ধারণ করা যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপ না থাকলেও প্রভাব দীর্ঘদিনের
ড. অনির্বাণ গাঙ্গুলির কথায় স্পষ্ট যে বিএনপির সঙ্গে এখন ভারতের বা বিজেপির সম্পর্ক শুণ্য রেখায়। তাই তাদের নিয়ে ভারতের বা বিজেপির এখন কোনো পরিকল্পনাও নেই।
ভারত ও ভারতীয়দের বন্ধু হাসিনাই কি তবে মোদীরও পছন্দ?
ঢাকায় আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে বিদেশি অতিথি হিসেবে সামিল হতে বিজেপির যে প্রতিনিধিদলটি গিয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন দলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও এমপি বিনয় সহস্রবুদ্ধে। ড: সহস্রবুদ্ধে তখন বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ বা তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ভারতে শুধু কংগ্রেস এবং নেহরু-গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ,এটাকেও নেহাতই একটা ভ্রান্ত ধারণা বলে মনে করেন তিনি। বিজেপি ভাইস-প্রেসিডেন্টের কথায়, "একজন ব্যক্তি, দলনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা যে ভারত ও ভারতীয়দের কাছের মানুষ তাতে কোনও ভুল নেই। জীবনের একটা খুব কঠিন সময়ে তিনিও ভারতের সাহায্য পেয়েছেন। কিন্তু সেটাকে যদি শুধু একটা দল বা পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে সেটা মারাত্মক ভুল হবে!"
বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানপন্থী জামায়াতের সম্পর্কটা কী- তা পরিষ্কার জানতে চায় ভারত
সহস্রবুদ্ধের কথায় প্রকাশ পায় যে, কংগ্রেসের পরীক্ষিত বন্ধু শেখ হাসিনাকেও বন্ধু হিসেবেই বেছে নিয়েছে বিজেপি ও মোদী সরকার। বস্তুত নরেন্দ্র মোদির গত চার বছরের শাসনে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে, তা এই দু্ই দলে অনেকেরই প্রত্যাশার বাইরে ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিজেপির এই নিবিড় সম্পর্কের পটভূমিতেই এই প্রশ্নটাও ওঠা স্বাভাবিক যে বাংলাদেশে নির্বাচনের বছরে ভারতের শাসক দল কি সেখানে প্রভাব খাটাতে উদগ্রীব? বিজেপি কি পারবে বিএনপি-আওয়ামী লীগকে সমঝোতায় বসিয়ে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করতে? বিএনপি-আওয়ামী লীগ যদি সমঝোতায় না আসে সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে কংগ্রেসের মত এবারও কি হাসিনা সরকারকে সাপোর্ট দিবে বিজেপি সরকার?

