সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ২.০ কেন নিজেকে উপলব্ধি করার জন্য, ফাঁকা উন্মাদনার জন্য নয়

দেশের নেতাদের এখন ইতিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান প্রয়োজন

 |  7-minute read |   04-03-2019
  • Total Shares

যখন আমি এই প্রবন্ধটি লিখছি, ততক্ষণে বিদেশসচিব সরকারি ভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে জঙ্গিদের ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে ভারতীয় বায়ুসেনা। ভোর হওয়ার আগেই যে অপারেশন করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ এখনও পাওয়া যায়নি।

মন করা হচ্ছে যে সেনাবাহিনীকে এই ধরনের কাজকর্ম করার ব্যাপারে সরকার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরবর্তী জঙ্গি কার্যকলাপের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে সেনা তাদের নিজেদের পছন্দের সময়ে এই ধরনের পদক্ষেপ করেছে। এই আক্রমণ ছিল শাস্তিমূলক ও স্বতঃপ্রণোদিত।

ইমরান খান যখন পদক্ষেপ করার জন্য প্রয়োজনীয় উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ ('actionable evidence')চাইছেন ঠিক সেই সময় সেনা যাই হোক কিছু একটা করে বসল, ব্যাপারটাকে ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গি দিযে বিচার করা ঠিক হবে না। যদি মনে করা হয় যে সেনা এমন একটা মামুলি পদক্ষেপ পদক্ষেপ করেছে, এই ধরনের পরিস্থিতে যেটাকে রুটিন পদক্ষেপ বলা চলে, তা হলে সেটি হবে এক মস্তবড় ভুল। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের কাছে যে একমাত্র প্রমাণ আছে, তা হল ভারতের দিকের নিয়ন্ত্রণরেখার দিক থেকেই অ্যাকশন করা হয়েছে।

1imran-khan-copy_030419091038.jpg সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ২.০ – ইমরান খান যখন পদক্ষেপ করার জন্য উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ চাইছেন তখনই উপযুক্ত জবাব। (ছবি: আইএসপিআর)

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এতটাই তলানিতে ঠেকেছে যে মনে হয় না এই ধরনের তথ্যপ্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে। পাকিস্তান যে ভাবে সবকিছু অস্বীকার করার মেজাজে রয়েছে, মন হয় তাতে কোনও প্রমাণই যথোপযুক্ত হবে না, সেই দেশের কাছে কোনও প্রমাণই উপযুক্ত বলে মনে হয় না, সেই দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে সবই অনুপযুক্ত মনে হয়।

পুলওয়ামায় তাণ্ডবের দায় নিতে দেরি করেনি জৈশ-ই-মহম্মদ – যদি ইমরানের পক্ষে সেটিকে উপযুক্ত প্রমাণ বলে মনে না হয়, তা হলে উপযুক্ত প্রমাণ কী, সেটি ভাবতেই আমার অবাক লাগে। এই ধরনের এড়িয়ে চলার যে মানসিকতা পাকিস্তানের অসামরিক প্রশাসন গ্রহণ করেছে সেই অবস্থায় অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কোনও কিছুই করার থাকে না। এটা হতে পারে না যে ইমরাণ খান ধরেই নেবেন যে বারে বারে হামলার বহর বেড়ে চলবে এবং তার ফলে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে চলবে এবং তিনি অব্যাহতি পেয়ে যেতেই থাকবেন। বর্তমান রাজনীতিতে জপতপ কর কাটিয়ে দেওয়ার কোনও জায়গা নেই, আত্মত্যাগেরও জায়গা নেই।

কোনও দেশ তার আত্মরক্ষার জন্য যে কোনও কিছুই যে করতে পারে, এটা স্বতঃসিদ্ধ। ইমানুয়েল কান্তের কথায়, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সত্যের সঙ্গেই আপোস করা চলে। আমার বিশ্বাস, মহর্ষি দয়াদন্দও এ ব্যাপারে ইমানুয়েল কান্তের সঙ্গে একমত হতেন যদিও সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতাই ছিল মহর্ষি দয়ানন্দের আধ্যাত্মিকতার মূল কথা।

এ ক্ষেত্রে যুক্তিটা খুবই সরল – সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্যই একজন জীবন অতিবাহিত করবেন।

ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে শান্তি কী, তা বুঝতে হলে ভারতীয়দের ও পাকিস্তানে থাকা তাদের ভাতৃসমদের বুঝতে হবে যে, মানুষের জীবনের মূল্য দিয়ে রাজনীতি করতে করা হল অপরাধ ও মানসিক বিকারগ্রস্ততার মিশ্রণের চেয়ে বেশি কিছু নয়। দুর্ভাগ্যজনক হল, অহং বোধের উপরে ভিত্তি করেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক বেদনাদায়ক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বস্তুতপক্ষে এই সম্পর্কের নেপথ্যে রয়েছে প্রতিবেশীর সম্পর্কে উগ্র মনোভাব, এই সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা একেবারেই বিরল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিপুল ভাবে ব্যর্থ হলে তবেই একটি রাষ্ট্র প্রবল ভাবে অসদুপায় অবলম্বন করে। তারা দেশের মানুষের জন্য ভালো কী করেছে তা তুলে ধরার মতো কিছুই তাদের থাকে না। এমন ব্যর্থ প্রশাসন কাউকে শত্রু বলে প্রতিপন্ন করে সে ক্ষতি করে ফেলতে পারে বলে তার উপরে হামলা করতে থাকে।

3aaaa_030519023620.jpgভারত ও পাকিস্তানের থাকা তাদের ভাতৃসমদের বোঝা উচিত যে, মানুষের জীবনের বিনিময়ে রাজনীতি করা খুবই খারাপ। (ছবি: রয়টার্স)

সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হল, সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তানের হত্যালীলার প্রভাবের উপরেই ভারত-পাকিস্তান সমীকরণ নির্ভর করে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, পাকিস্তান ক্রমাগত আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রে শান দিয়ে গেছে – ভারতের তুলনায় চিরকালই পাকিস্তান অনেক পিছনে, তাই ভারতকে বিদ্ধ করা এবং ভারতের সামনে সঙ্কট তৈরি করাই পাকিস্তানের কাছে নায়কোচিত ব্যাপার।

কিন্তু তারা ভারতের সমকক্ষ নয় হলে বারে বারে লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করবে এটা পুরোপুরি হঠকারী ব্যাপার।

যারা সমকক্ষ হতে না পেরে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে তাদেরও উচিত যারা এগিয়ে রয়েছে তাদের চেয়ে অনেক বেশি ভালো আন্তর্জাতিক সম্পর্ত তৈরি করা। তাই যারা এগিয়ে রযেছে তাদের অতিক্রম করতে গেলে তাদের নিজেদের ক্ষমতার ব্যাপারে ধারনা থাকা দরকার। পাকিস্তানে জঙ্গিরা আমোদপ্রমোদ করছে, পিছিয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে তারা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে উন্মাদের মতো আচরণ করছে।

ভারতের কাছে টিকাকরণ কর্মসূচি: উপযুক্ত জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকায় যে আন্ডারডটি গর্জনরত সিংহকে ছাড়িয়ে যেতে উদ্যত হয়েছে তাকে কী ভাবে কব্জা করা যাবে? আমাদের কঠোর হেত হবে, এবং বুঝিয়ে দিতে হবে যাতে পাকিস্তান এই দেশের উপরে তার কর্তৃত্ব করার প্রবণতা, তাদের অসঙ্গত আচরণ ও উস্কানি দেওয়া থেকে তাদের শত যোজন দূরে থাকতে হবে।

এর ফল হল পুলওয়ামা।

সুতরাং একই ভাষায় ও আগ্রাসী ও দুর্নিবার ভাবে জবাব দেওয়ার অর্থ হল অক্ষমতার অহংকে আরও প্রকট করা। যারা দুর্বল হয় তারাই বেশি করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, যদি না এটা কেমলমাত্র অহংয়ের প্রকাশ না হয়ে থাকে। যদি কারও অহংয়ে ঘা লাগে তবে তিনি কী ভাবে প্রত্যুত্তর দেবেন সেটা বলা মুশকিল। তবে পরমাণুক্ষমতায় বলীয়ান হওয়াটা বেশ অশুভ লক্ষণ বলেই মনে হয়।

(ঈশ্বরের) অশেষ করুণা যে আমরা আমরা এখনও সবচেয়ে খারাপ সেই পরিস্থিতি থেকে এখনও অনেক দূরে রয়েছি। ফেলে আসা সেই বস দিনের রক্তাক্ত যে সব স্মৃতি আমদের রয়েছে তা থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি যে কঠোর ভাবে মোকাবিলা করার ফল কী হতে পারে। কোনও পরিস্থিতির ফল কী হতে পারে সেটা আন্দাজ করতে পারা এবং ভবিষ্যৎকে দর্শন করার ক্ষমতাই হল জ্ঞান।

3modi-imran-copy_030419091434.jpg ভারতকে মনে রাখতে হবে যে তারা এমন একটি আন্ডারডগ রাষ্ট্রের মোকাবিলা করছে যে দেশটির একটি মিথ্যা দম্ভ রয়েছে। (ছবি: পিটিআই)

ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও কিছু ভেবে নিয়ে নিয়ে মানুষের যে উদ্দীপনা হয় তা হল লোহার চশমা পরে ভবিষ্যৎ দর্শন করা। কিন্তু আমরা কখনোই জানতে পারি না যে ভবিতব্য কী ভাবে আমার সামনে এসে হাজির হবে। এটাই জানি না যে আমাদের কোনও সদিচ্ছা থাকলে তাই বা ভবিষ্যতের জন্য কতটা ঠিক। ইতিহাসের এই পরিহাস নিয়ে যথার্থই বলেছেন হেজেল, তাঁর কথায়, মনশ্চক্ষু দিয়ে ভবিষ্যৎ দর্শনের মধ্য দিয়েই মানুষের সব উদ্যোগ শেষ হয়ে যায়। শেষ হাসিটা হাসার ক্রমতা শুধুমাত্র ইতিহাসেরই আছে।

এই জন্যই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির ব্যাপারে কিঞ্চিৎ হাস্যরস থাকা বাঞ্ছনীয়। সমস্যা হল ইতিহাস ও মানুষের পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকে গুটিকয়েক ব্যক্তি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের মাত্রাজ্ঞান একেবারেই নেই। যখন একবার মুচকি হাসলেই কাজ হয়ে যায়, তখন তাঁরা গর্জন করছেন।

ইতিহাস বহু তর্জনগর্জনকারী নায়ককে দেখেছে। এমন মনে হয়েছে যেন পুরো বিশ্বই কাঁপতে কাঁপতে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়বে। কিন্তু বিনয়ী বিশ্ব দিনের শেষে তাঁকি গ্রহণ করেছে, অন্য আর পাঁচজনের মতোই, রাজা থেকে কাঙাল এমকি নগন্য প্রাণীও বিলীন হয়ে হয়ে গেছে তার সঙ্গে।

এই ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার দেশের নেতাদের।

কিন্তু ক্ষমতা ও যুদ্ধোন্মাদদের এই তৃণভূমিতে মানবতার স্থান যৎসামান্য – যাঁদের এই সব উন্মাদের মধ্য থেকে আলাদা করা যাবে না, সেই জন্যই আমাদের সন্ন্যাসী ও ফকিরদের দরকার, যাঁরা এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যেও ভারসাম্যীন হয়ে পড়ে উন্মাদের মতো আচরণ করবেন না।

উন্মাদ লোকজন হলেন ডায়োজেনেসের মতো। করিন্থে গিয়ে ছিদ্রান্বেষীদের সেই জনককের সঙ্গে দেখা করতে যান আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (যাঁরা মানুষের রক্তের বিনিময়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন তাঁরা কেন মহান সেটা আমার কাছে এখনও ধাঁধার মতো)। ওই শহরে সকলেই আলেজান্ডারের কথা শুনতে হাজির হয়েছিলেন, একা ডায়োজেনেস যাননি, তাই আলেকজান্ডার নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাতে অবশ্য ডিয়োজেনেসের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি।

সম্রাট তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?”

আমার কোনও সমস্যা তৈরি কর না।

এটাই হল ক্ষমতা ও আড়ম্বরের মধ্যে পার্থক্য। বিশাল বিশাল আড়ম্বরের ফানুস ফুটো করে দেওয়ার জন্য একটা বাক্যই যথেষ্ট।

4aaaa_030519023656.jpgএটা কি গান্ধী ও তাঁর শিক্ষাকে স্মরণ করার সময়? (ছবি: রযটার্স)

শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শকদের একজন, নিজের দেবত্ব সম্বন্ধে যাঁর বিভ্রান্তি ছিল, তিনিও এমন কথা বলে আমাদের মতো অকিঞ্চিৎকর সৃষ্টি থেকে ঈশ্বরের দেওয়া আলোও আটকে দিতে পারতেন।

স্বাধীনতার নিহিত সত্যটি হল আপোষহীন সত্য। আমাদের স্বাধীনতার যুক্তি আমাদের এই বিশ্বের ত্রাণকর্তারূপী অতিমানবিক ভাবের উপরে নির্ভর করে না, নির্ভর করে সেই সূক্ষ জ্যোতির উপরে যে জ্যোতি নির্ভর করে মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র স্থাপন করতে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে আমরা যে ব্যক্তির মধ্য থেকে অতিমানবীয় ছটা দেখতে চাইছি তা দেখতে পাচ্ছি, তবে সেই আলোর কথাই আমি বলতে চাইছি যে আলোর কথা বাপুকে হত্যা করার পরে নেহরু বলেছিলেন, যে আলোকের ছটায় আমাদেরই মতো কোনও সৃষ্টি অমরত্ব লাভ করেন – এবং তাঁর সেই আলোকবর্তৃকা উদ্ভাসিত হতেই থাকে – হাজার হাজার বছর ধরে, যেখানে আজকের প্রবল সব নায়করা তাঁর চরণতলেই রয়ে যান।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SWAMI AGNIVESH SWAMI AGNIVESH

Author is a social activist.

Comment