ধর্ম রক্ষা করতেই নাকি গৌরী লঙ্কেশ হত্যা: সীমারেখা কে ছাড়ান, শিল্পী নাকি হত্যাকারী

লঙ্কেশ নিহত, এখন হত্যাকারী ও হত্যার প্রতিবাদীদের নিয়ে খোলাখুলি বিতর্ক দরকার

 |  7-minute read |   17-06-2018
  • Total Shares

প্রকৃত অর্থে যাঁরা শিল্পী, তিনি মাইকেলাঞ্জেলো বা আমাদের দেশের অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বা বর্তমান সময়ে যাঁরা রয়েছেন, শিল্পী বলে যাঁদের আমরা প্রণম্য বলে মনে করি, তাঁদের যে দায়িত্ববোধ, তাঁদের যে কল্পনাবোধ, বা তাঁদের যে মানসিকতা বা তাঁদের যে মননের গঠন – আজকের শিল্পের ইতিহাস কোথাও এই প্রমাণ পায়নি যে তাঁরা ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনও মানুষের ধর্মীয় চেতনায় কোনও ভাবে আঘাত করেছেন। আঘাত করার মতো কোনও মানসিকতা তাঁদের মধ্যে নেই।

প্রতিটা ধর্মের সঙ্গেই শিল্পকলা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ইসলামি চিত্রকলার ব্যাপকতা আমরা দেখেছি মুঘল চিত্রকলায়। খ্রিস্ট ধর্ম যবে থেকে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে তার নির্ভরতাও হল এই চিত্রকলাই। সিস্টিন চ্যাপেলের গায়ে চিত্রাঙ্কন হয়েছে, বাইজেন্টাইনের দেওয়ালে চিত্রাঙ্কন হয়েছে, এমনকি হিন্দু ধর্মেরও কথা যদি বলা হয়, তারও প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে শিল্পকলাই সৃষ্টি হচ্ছে। মহাবলীপুরম, ইলোরা প্রভৃতি তার উদাহরণ। জৈন ধর্মের ক্ষেত্রে একই ভাবে ভাস্কর্ষ তো হয়েইছে, জৈন পুঁথিচিত্র হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রে বিরাট শিল্পকলার সম্ভার রয়েছে অজন্তা, ভারহুত, সাঁচী প্রভৃতি জায়গায়। বৌদ্ধ ধর্ম যখন প্রসার লাভ করল তিব্বতে, তখন থঙ্কা চিত্র তৈরি হচ্ছে, চিনে যখন প্রসারিত হচ্ছে টুং ওয়াংয়ের রেশমপথে গুহার গায়ে শিল্প সৃষ্টি হয়েছে।

madona_new_061718052732.jpgম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড

ব্যক্তিগত ভাবে বিচার করলে দেখা যাবে বিশ্বশিল্পের সম্ভারের সঙ্গে ধর্ম অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। আমরা সে সব শিল্পকলাকে তো ভালোবাসতেই শিখেছি। ভারতের যে কোনও শিশু যদি খ্রিস্টধর্ম নাও বোঝে সে কিন্তু ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড ছবিটিকে ভালোবাসবে। বিশ্বের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষ বা অন্য ধর্মাবলম্বী যাঁরা রয়েছেন তাঁরা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল অজন্তা দেখতে আসেন। আসলে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মকেই দেখছেন। তাই শিল্প বা শিল্পকলা কখনও কাউকে অযথা আঘাত করা শব্দটি শেখায়নি। শিল্পী হয়তো কোনও বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন। তাঁদের ধর্মচেতনাকে আঘাত করার কোনও ব্যাপার থাকে না।

body_ajanta_061718052749.jpgঅজন্তার গুহাচিত্র

সমাজ বদলেছে, সময়ও বদলেছে। এই বদল ভালো ভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, এক একজন ব্যক্তি-মানুষ তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কয়েকটি বিষয়কে দেখা শুরু করছেন। তাই আমাদের মনে হচ্ছে, শিল্পী বোধহয় সীমা লঙ্ঘন করলেন। সরস্বতীকে নগ্ন কেন আঁকা হয়েছে এবং কেন সেটি মকবুল ফিদা হুসেন এঁকেছেন এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সেই বিতর্ক অবশ্য শিল্পী সমাজের নয়। আমার মধ্যেও কোনও বিতর্ক নেই। কারণ আমার কাছে সরস্বতী একটি চেতনা। তাঁকে আমি নগ্ন হিসাবে দেখছি না, আমি তাঁর সম্পূ্র্ণ স্বরূপ দেখছি। সারস্বত বলতে তো আমরা পাণ্ডিত্য বুঝি। সেই চেতনার রূপ একজন আঁকছেন। তিনি কেন নগ্ন, তিনি একই ভাবে হজরত মহম্মদের ছবি আঁকতে পারবেন কিনা, এই সব প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন তখন মনে হয় যে অনেকে ভাবছেন মকবুল ফিদা হুসেন নিজে মুসলমান কিন্তু তিনি সরস্বতীকে নগ্ন করে এঁকে ফেললেন। কিন্তু আমরা যদি চোল-ব্রোঞ্জের সরস্বতী দেখি, সেখানে নটরাজ আছেন, অন্য রূপেও শিব আছেন, কালী আছেন—তাঁরাও তো নগ্ন। তা হলে তো সেই প্রশ্নও উত্থাপন করতে হয়।

body_pagoda_061718052858.jpgজাপানে জলই সরস্বতীর স্বরূপ, ছবি: বিনয় বেহল

যাঁরা প্রকৃত শিল্পী তাঁদের ক্ষেত্রে সীমারেখা, লক্ষণরেখা এসব প্রশ্ন অবান্তর। তাঁরা এমন কোনও কাজ করেন না যাতে মানুষের আবেগে আঘাত লাগে, কারণ মানুষের আবেগটাই তাঁদের সম্পদ। আঘাত করা প্রকৃত শিল্পীর কাজ নয়। যাঁরা এই লক্ষণরেখার প্রশ্ন তোলেন, এটা তাঁদের মননগত, মানসিক গঠনগত ও প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। তাঁদেরও দোষ দেওয়া যায় না।

এটা শুনেছি যে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকারীকে গুরুদ্বারে প্রতিজ্ঞা করানো হয়েছিল। কেউ বলছেন ২০ জন অ-মুসলমানকে হত্যা করলে তোমার স্থান হবে জন্নতে, কেউ বলছেন তুমি ৪০ বার হনুমানের নাম নিয়ে ৫০ জন মুসলমানকে হিন্দু করতে পার তা হলে ঈশ্বরের অশেষ কৃপা পাবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে হতাশাজনক মনন-গঠনের সাহায্যে মস্তিস্ক বিপথে চালিত হয় এবং এই সব বিপথগামী মানুষের শিকার হন তাঁরাই যাঁরা সমাজকে নতুন রূপে দেখতে ও ভাবতে শেখান, সংস্কারের পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

গৌরী লঙ্কেশের প্রসঙ্গে আসা যাক। অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক হলেও যাঁকে হত্যা করা হয়ে গেছে, আমরা তো তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারছি না। তবে এটা জানি যে যিনি তাঁকে হত্যা করেছেন, তাঁর একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। যাঁরা হত্যা করেছেন এবং যাঁরা সেই হত্যার ছক কষেছেন, তাঁদেরও একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমরা যদি বিতর্কের মঞ্চে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করি, তা হলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমাদের দেশে যে বিষয়ে এখনও চর্চা শুরু হল না, আমি সেই চর্চার দিকে নজর দিতে চাই। যিনি হত্যা করেছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং যাঁরা হত্যার প্রতিবাদ করছেন তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি—এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রবল ভাবে বিতর্ক হওয়া দরকার যাতে প্রত্যেকে যোগ দিতে পারবেন। আর প্রত্যেকের জানা দরকার কার যুক্তি কী। যিনি হত্যা করলেন এখন তাঁরও জানা ও বোঝা দরকার যে তিনি কেন হত্যা করলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কতটা ঠিক বা কতটা ভুল সেটাও আমাদের বোঝা দরকার। যিনি হত্যা করেছেন তাঁকে যদি ফাঁসিও দেওয়া হয়, তা হলে দেখা যাবে আরেজন গৌরী লঙ্কেশকে অন্য একজন হত্যা করলেন।

body_gauri_061718052916.jpgগৌরী লঙ্কেশ। হত্যায় অভিযুক্তের বয়ান, ধর্মকে রক্ষা করতেই তিনি গুলি চালান

আগামী দিনের গৌরী লঙ্কেশদের হত্যাকারীরাও এখন এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছেন। খোলাখুলি বিতর্ক যদি না হয়, কারও পক্ষেই অন্যের মানসিকতা উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। খোলাখুলি বিতর্ক হলেই বোঝা সম্ভব আমরা কী কোনও ভাবে আমাদের জোরালো কলমের আড়ালে কোনও দুর্বল মানুষকে দুঃখ দিয়ে ফেললাম? বিভিন্ন মামলায় আমরা আইনজীবীদের বিতর্ক শুনি, রায় শুনি, কিন্তু হত্যাকারীরা কী বলছেন, তার একটা খোলাখুলি আলোচনা শোনা খুব দরকারি, তা তিনি শিক্ষিত হোন বা না হোন। খোলাখুলি বিতর্ক না হলে সমাজও উপযুক্ত ভাবে তৈরি হবে না।

সমাজ যখন তাদের মানসিকতা বুঝতে পারবে, তখন বোঝা যাবে স্কুলস্তরে কী ধরনের শিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন, কোন দেশের কী পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতাদের কী ধরনের পদক্ষেপ করা দরকার, কোনও দেশের কোনও গোষ্ঠীর বা কোনও এক শ্রেণীর একে অপরের বিরুদ্ধে কী ধরনের আচরণ হওয়া উচিৎ। এ জন্যই খোলামেলা বিতর্ক হওয়া দরকার।

আবার সীমারেখার প্রসঙ্গে আসি। সঠিক মানুষ ও সঠিক শিল্পী কখনও সীমারেখা লঙ্ঘন করেন না। তাঁরা তাঁদের মতো করে একটা কাজ করেন। কেউ নগ্ন দেবদেবীর মূর্তি আঁকলেও তিনি সেটি তাঁর মতো করে এঁকেছেন, কারও ধর্মে আঘাত দেওয়ার জন্য তিনি এ কাজ করেননি। গৌরী লঙ্কেশও যখন কোনও কথা বলেছেন তখন তিনিও কোনও সীমারেখা ডিঙোতে চাননি। তিনি তাঁর কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর কথা যাদের গায়ে লাগল, কেন গায়ে লাগল? খোলাখুলি বিতর্ক সেই উত্তর দিতে পারে। ধরে নিচ্ছি কেউ মনে করছেন যে তিনি আমাদের চেতনায় বারে বারে আঘাত করছেন, তাই তাঁকে হত্যা করা দরকার। কিন্তু কেন আঘাত করছেন? আমাদের কোন জায়গাগুলো ধরিয়ে দিচ্ছেন? এটাও দেখা দরকার। ধর্মচেতনা মানুষের তৈরি।

সিস্টিন চ্যাপেলের গায়ে যিশুর নগ্ন ছবি এঁকেছিলেন মাইকেলেঞ্জেলো। কাউন্সিল অফ ট্রেন্ট হওয়ার ফলে পরবর্তীকালের পোপ শিল্পীদের দিয়ে সেই সব নগ্ন চিত্রের গায়ে গায়ে কাপড় পরিয়ে দিয়েছিলেন। মাইকেলেঞ্জেলো তো আর লক্ষণরেখা পার করতে চাননি, তিনি তাঁর অশেষ ভালোবাসা দিয়ে ঘাড় ও মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে, বহু কষ্ট স্বীকার করে সিস্টিন চ্যাপেলের ছবি এঁকেছিলেন। সেই ছবি জন্যও পরবর্তীকালের বিচারে মাইকেলেঞ্জেলোকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তিনি যতগুলো নগ্ন চিত্র এঁকেছিলেন, অন্য শিল্পীকে দিয়ে তাঁদের কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাউন্সিল অফ ট্রেন্টও একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি কী দেখছেন, তাঁর সামনে যে দৃশ্য রয়েছে তা তিনি গ্রহণ করতে পারছেন কিনা।

body_christine_061718052931.jpgসিস্টিন চ্যাপেলের চিত্রকলা

খাজুরাহো ও কোনার্কের বিশেষ কয়েকটি মূর্তি চুনকাম করে দেওয়ার জন্য তো প্রস্তাবনা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর কাছে। সেই প্রস্তাবনা ঠেকিয়েছিলেন নন্দলাল বসু ও সীমান্ত গান্ধীর মতো ব্যক্তিরা। অর্থাৎ সীমারেখা লঙ্ঘনের ব্যাপার নয়, বরং শিল্পীরা এবং গৌরী লঙ্কেশের মতো মানুষ অনেক বেশি সচেতন থাকেন, যাতে তাঁদের কাজে কারও আঘাত না লাগে। উল্টোদিকে যাঁরা এই কাজগুলো করেন, তাঁদের সচেতনতার বড় অভাব।

ধর্ম বাঁচাতে তাঁরা এ কাজ করেছেন। ধর্ম কী? ধর্ম বাঁচানো বলতে কী বোঝায়? মানবিকতা বোঝাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাঁরা তো ঈশ্বরকেই বিশ্বাস করেন না। যদি তিনি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতেন, তিনি বলতেন, গৌরী লঙ্কেশকে তুমি জন্ম দিয়েছ, তিনি আমার মানবচেতনাকে বা বিশ্বাসকে হত্যা করেছেন, তুমি যাঁকে জন্ম দিয়েছ, তুমিই তার শাস্তি বিধান কর। আর ঈশ্বর নিজে শাস্তি দেন না, মানুষকে দিয়ে দেওয়ান, তার জন্য তো সংবিধান রয়েছে, কোন অপরাধের কী শাস্তি সে তো নির্ধারিত করা আছে। ভারতে তো সংবিধান রয়েছে, তার দ্বারস্থ হতেই পারেন যে কেউ।

khajuraho_body_061718052952.jpgখাজুরাহোর মন্দিরের শিল্পকলা নিয়েও বিতর্ক ছিল

হত্যায় অভিযুক্ত যে ধর্মকে বাঁচানোর কথা বলছেন সেই ধর্ম কী? তা কি এতটাই ভঙ্গুর যে গৌরী লঙ্কেশের মতো একজন মানুষ তাকে ধ্বংস করে দিতে পারেন? তাঁর একটা বা একাধিক লেখায় সেই ধর্ম অপবিত্র হয়ে যাবে? আমাদের ধর্মের পরিধির কাছে ১০০ কোটি মানুষও ছোট, এই ধর্ম নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে পাশ্চাত্যে। যাঁরা এই ধর্মের রক্ষায় প্রাণ নিচ্ছেন এবং প্রাণ দিচ্ছেন, তাঁরা এই ধর্মের কতটুকু বোঝেন?

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

DEBDUTTA GUPTA DEBDUTTA GUPTA

Art Critique & Art Historian | Attached to St. Xavier's University

Comment