কর্মসংস্থানে সঙ্কট: তথ্য বলছে নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ বিজেপি সরকার
২০১৪য় কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি, এখন সেটাই বুমেরাং হতে পারে
- Total Shares
কথায় আছে, তরুণ প্রজন্মই দেশের ভবিষ্যৎ। ২০১৪ সালে সেই তরুণ প্রজন্মের ভোটেই ক্ষমতায় এসে ছিলেন নরেন্দ্র মোদী ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী থেকে উঠে আসা এই ভোটারদের সিংহভাগই সেই বছরই প্রথম বার ভোট দিয়েছিল কিংবা সবেমাত্র স্নাতক হয়েছিল।
ক্ষমতায় এলে দু'কোটি কর্মসংস্থান করবেন তিনি - মোদীর এই প্রতিশ্রুতি তাদেরকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়েছিল।
অনেকটা 'আচ্ছে দিনের' প্রতিশ্রুতির মতই এই প্রতিশ্রুতিটিও ক্রমেই হাস্যাস্পদ হয়ে উঠেছে।
কয়েকটি তথ্যের উপর এবার নজর দেওয়া যাক।
২০১৪ লোকসভায় মোদী জয়ের বড় ভূমিকা ছিল দেশের তরুণদের [ছবি: পিটিআই]
লেবার ব্যুরোর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ ও ২০১৬ সালের (এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর) কর্ম সংস্থানের সংখ্যা বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সংখ্যা যথাক্রমে ১.৫৫ লক্ষ ও ২.৩১ লক্ষ ছিল, যা প্রধানমন্ত্রী মোদীর দেওয়া দু'কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির মাত্র এক শতাংশ।
লেবার ব্যুরোর ২০১৬ সালের একটি সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে যে সকল পেশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি - যেমন বয়ন, চর্ম, অটোমোবাইল, খনিজ, গহনা, পরিবহণ, তথ্যপ্রযুক্তি এবং তাঁত - সেই সব শিল্পেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সবচাইতে বেশি কমেছে।
মোদী যখন নোটবন্দি ঘোষণা করেন তখন দেশের কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি বেশ খারাপ ছিল। নোটবন্দির ফলে তা আরও বেশি করে খারাপ হল।
হিসেবে বলছে, নোটবন্দি ও জিএসটি চালু হওয়ার ঠিক পরে পরেই দু'কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছিল।
অৰ্থনৈতিক বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে দেওয়া কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল যে নোটবন্দির প্রভাবে জর্জরিত কৃষকরা।
কৃষিশিল্পের কর্মসংস্থানের উপর নোটবন্দির প্রভাব এতটাই পড়েছিল যে ২০১৬ সাল থেকে সরকারি ভাবে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ঘোষণা করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
২০১৮ সালে কর্মসংস্থানের অবস্থা বেশ কাহিল।
দেশের বেকারত্ব বেড়েই চলেছে [ছবি: পিটিআই]
সিএমআইই-র তৈরি করা রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ ভারতীয় কর্মহীন হয়েছে। ২০১৮ সালে ডিসেম্বর মাসে দেখা যাচ্ছে ৩৯ কোটি ৭ লক্ষ মানুষের রোজগার আছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রিপোর্ট ঘেটে দেখা যাচ্ছে সে সময়ে ৪০ কোটি ৭৯ লক্ষ মানুষের কাজ ছিল।
এর চেয়েও খারাপ খবর রয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে গত ২০ বছরে ভারতের বেকারত্বের হারের সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি হয়েছে।
একে তো কর্মসংস্থানের অভাব, তার উপর বেতন কম। দেশের ৮২ শতাংশ পুরুষ ও ৯২ শতাংশ মহিলা মাসে দশ হাজার টাকার কম আয় করে থাকেন।
মোদীর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারাটাকে ক্ষমা করে দেওয়াই যায় যদি দেখা যায় যে সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষার সব রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সরকার তো কোনও চেষ্টাই করেনি।
কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোতে বর্তমানে ২৪ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। সাংসদে একটি প্রশ্নোত্তর পর্বে এই তথ্য জানা গিয়েছিল।
প্রারম্ভিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলোতে এখনও ১০ লক্ষেরও বেশি শূন্যপদ রয়েছে। আরও একটি প্রশ্নোত্তর পর্বে জানা গিয়েছে দেশ জুড়ে সশস্ত্র বাহিনীগুলোতে প্রায় ৪.৪ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। রাজ্যগুলোর সশস্ত্র বাহিনীগুলোতে প্রায় ৯০,০০০ মতো শূন্যপদ রয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আরও ৫.৪ লক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু এই শূন্যপদগুলোকে পূর্ন করার কোনও চেষ্টাই সরকার করছে না কেন? বিশেষ করে স্বাধীনতার পরে বর্তমানেই যখন দেশের কর্মসংস্থান সবচাইতে বেশি সঙ্কটজনক অবস্থায় রয়েছে।
দেশের প্রতিটি নাগরিক যাতে কাজ পায় তার জন্য ২০০৫ সালে ইউপিএ সরকার একটি আইন প্রণয়ন করেছিল, সেই সময়ে এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সম্প্রতি সমাজকর্মী অরুণা রায় প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি মারফত অভিযোগ জানিয়েছেন যে বর্তমান সরকার এই আইনকে পাত্তাই দিচ্ছে না। চিঠিতে বলা হয়েছে এই আইন দিয়ে রূপায়িত প্রকল্পের টাকা সব শেষ হতে বসেছে। কিন্তু নতুন অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে না।
তথ্যগুলো খুব পরিষ্কার। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত বছর লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনার সময়ে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন গত কয়েক বছরে প্রায় এক কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের তথ্য দিয়ে তিনি তাঁর দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। দেশের মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রবীণ শ্রীবাস্তব স্বয়ং এই তথ্য মানতে চাননি।পরবর্তী কালে সরকার লোকসভায় জানিয়েছিল যে ২০১৪ সালের পর থেকে কতটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গিয়েছে সেই বিষয়ক কোনও তথ্য সরকারের কাছে নেই।
বেকারত্ব সমস্যা দূর করতে ব্যর্থ মোদী সরকার [ছবি: পিটিআই]
মোদীর ব্যর্থতা পরবর্তীকালে বিজেপি নেতাদের কথাতেও প্রতিফলিত হয়েছে।
২০১৮ সালে নীতিন গডকড়ি জানিয়েছিলেন, "কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেও কোনও লাভ হবে না কারণ উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আমাদের হাতে নেই।"
গত বছর রাজস্থান বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় সে রাজ্যে ঘটে যাওয়া কয়েকটি গণপ্রহারের ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে জানিয়েছিলেন, "বেকারত্বের ফলে এই ধরণের গণপ্রহারের মতো ঘটনা বেড়ে চলেছে।"
এই সরকার যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে তা বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই সরকারের তরফ থেকে চেষ্টা করারও কোনও লক্ষণ নেই।
২০১৪ সালে যে কর্মসংস্থানের দোহাই দিয়ে বিজেপি সরকারে এসেছিল, ২০১৯ সালে সেই কর্মসংস্থানই পথে বসাতে পারে বিজেপিকে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

