উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সরকারি চিকিৎসকদের, ভুগবে গ্রামবাংলা
চিকিৎসকরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ হারালে গ্রাম থেকে শহরে রেফার হবেই
- Total Shares
সরকারি চাকুরিরত ডাক্তাররা তিন বছর গ্রামে পরিষেবা দিলে এমডি, এমএস, ডিপ্লোমা (স্নাতকোত্তর, সংক্ষেপে পিজি) এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সরকারি কোটায় (সংরক্ষিত আসনে) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। যেহেতু গ্রামের পরিবেশে কাজ করতে হয়, তাই (চাকরি করেন না, শুধু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন) তাঁদের ওপেন ক্যান্ডিডেটদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে খুব কম চিকিৎসকই চাকরি করতে করতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে পারবেন। তাই ২০০২ (বা তারও আগে) থেকে যোগ্য প্রার্থীরা রাজ্যের মোট পিজি আসনের ৪০ শতাংশ ডিগ্রি ও ৫০ শতাংশ ডিপ্লোমা আসনে ভর্তি হবার সুযোগ পেতেন। এমসিআই-এর এই নিয়ম সব রাজ্যেই প্রযোজ্য। কোনও কোনও রাজ্যে এর চেয়েও বেশি আসনে চাকুরিরত চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ আছে। এই অধিকার ডাক্তারদের দীর্ঘ কষ্টার্জিত অধিকার, যা গ্রামের মানুষের স্বার্থেও বটে। কারণ তিন বছর গ্রামে কাজ করলে পিজি করার সুযোগ পেতে অনেক ডাক্তারই কাজে যোগ দিতেন এবং পিজি পাশ করার পরও ডিএইচ, এসডিএইচ, এসজিএইচ এবং সুপারস্পেশালিটি হসপিটালেই এঁরা কাজ করবেন বা করেন। পিজি করার পরে অতিরিক্ত বেতন হয় মাত্র দেড়শো টাকা। পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত এই পরীক্ষায় বসা যায়। ডাক্তারদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৫ বছর করা হয়েছে,তাই আমরা মনে করি ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই পরীক্ষায় বসার সুযোগ থাকা উচিৎ। সরকারি চাকুরিরত ডাক্তারদের কোয়ার্টার্স বেহাল, কাজের পরিবেশ ভীষণ অসম্মানজনক, স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী ও কর্পোরেট হাসপাতালের তুলনায় বেতন অনেক কম, তার সঙ্গে কাজের জায়গায় মার খাওয়ার ভয় আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে ডাক্তারদের কাছে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হল একমাত্র আকর্ষণীয়। তা কমিয়ে দিলে ডাক্তাররা সরকারি চাকরিতেযোগ দেবেন কেন?
ছবি সৌজন্য: সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম
ডিপ্লোমার ক্ষেত্রে দু'বছর এবং ডিগ্রির ক্ষেত্রে তিন বছর সবেতন পড়ার সুযোগ যাঁরা পান তাঁদের ট্রেনি রিজার্ভ বলা হয়। ২০১৬ সালের আগে যে সমস্ত চাকুরিরত প্রার্থী এন্ট্রান্স পরীক্ষায উত্তীর্ণ হতেন, তাঁদের প্রায় সকলেই এই সুযোগ পেতেন। অল্প কয়েকটি আসন ফাঁকা থাকলে সেখানে ওপেন ক্যান্ডিডেটরা ভর্তি হতেন। যাঁরা এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন (চাকুরিরতদের) এই সংখ্যাটা তিনশোর কাছাকাছি বা কখনও তারও বেশি হত। কিন্তু ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাস্থ্যভবনের এক নির্দেশিকায় বলা হয়, চাকরিরত চিকিৎসকদের মাত্র ১০ শতাংশ পড়ার সুযোগ পাবেন। গত দু’বছর ধরে সেই হিসাবে সংখ্যাটা তিনশো থেকে কমিয়ে আনা হল ১৯০-এর কাছাকাছি। তারপর থেকে এই ধারাই চলে আসছে।এ বছর সংখ্যাটা ১৮০। ১৯০-এর উপরে যে আসনগুলো এতদিন সরকারি ডাক্তাররা পেতেন, তা চলে গেল ওপেন ক্যান্ডিডেটদের দখলে, যাঁরা মূলত বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালে পরিষেবা দেবে।
যাঁরা গ্রামের গরিবদের চিকিৎসা করবেন, তাঁদের উচ্চশিক্ষায় বাধা দেওয়া হল। এই সিদ্ধান্ত কি গরিব মানুষের স্বার্থে? যেখানে পরিকাঠামো এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাবে জেলা থেকে শহরে রোগীর রেফার বৃদ্ধি পায় এবং একটা অংশ কর্পোরেট হাসপাতালে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়।
প্রতিবছর টিআরের সংখ্যা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়। প্রশ্ন জাগে এর পিছনে কোন ষড়যন্ত্র নেই তো?
২০১৫ সালে স্বাস্থ্য ভবন এক নির্দেশিকায় বলে, যাঁরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, এসএনসিইউ, এইচডিইউতে কর্মরত, তাঁরা টিআর পাবেন না। আমরা তখন বলেছিলাম, ক্যান্ডিডেটরা তো বলেননি যে তাঁরা গ্রামে যাবেন না, পোস্টিং তো আপনারা দিয়েছেন। ২০১৬ সাল থেকে তাঁদের টিআর দিতে বাধ্য হয়েছিল।
ছবি সৌজন্য: সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম
সরকারের যুক্তি হল, এত সংখ্যক ডাক্তারকে একসঙ্গে ছাড়লে গ্রামের পরিষেবা ব্যাহত হবে। হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের মাধ্যমে কম সময়ে নিয়োগ সম্ভব। তাছাড়া প্রতিবছরই যদি এই একই সমস্যা হয়, তবে তা নিরসন করা হয় না কেন? এখনই ৬০০-র বেশি চিকিৎসক সার্ভিসে যোগ দিতে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে, তাঁদের দিয়ে তো এই শূন্যস্থান পূর্ণ করা যায়। কিছু বললেই সরকারি আধিকারিকরা বলেন, টাকার অভাব নেই। তা হলে নিয়মিত নিয়োগ করে স্থায়ী সমাধান করা হয় না কেন? রাজ্যের গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে ৯০ শতাংশ এবং ডিএইচ, এসডিএইচ, এসজিএইচ হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি যেখানে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি। মাল্টি-সুপার হাসপাতালগুলিতে অনুমোদিত পদ, কত জন ডাক্তার থাকা উচিৎ, ওয়ার্ড-প্রতি নার্সের সংখ্যাই বা কী হওয়া উচিৎ, তা কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। নামে ‘সুপার স্পেশালিটি' হলেও নিউরোলজি বা কার্ডিওলজির মতো সুপার স্পেশালিটি বিভাগ তো অনেক দূরের কথা, রোগীর সংখ্যার অনুপাতে সামান্য মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, শিশু প্রভৃতি বিভাগগুলির স্পেশালিস্ট ডাক্তারই অমিল নতুন তৈরি নীল-সাদা ভবনগুলিতে। এই রকম পরিস্থিতিতে সরকারি চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর পাঠে বাধাদান স্পেশালিস্ট ডাক্তারের অভাবের বিষটিকে আরও জটিল করে তুলবে।
প্রতি বছর মোটামুটি ২৫০০ জন এমবিবিএস ও ১৩৫০ জন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার পাশ করে বের হন। ২০১৫ সালের একটা হিসেবে রাজ্যে ৩৪৫৩টি পদের মধ্যে ১৫৬৮টি বিশেষজ্ঞের পদ ফাঁকা। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাবে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালগুলি যেখানে বেসরকারি কর্পোরেট হাতে যেতে বসেছে, সেখানে প্রশ্ন জাগে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নপূরণ করতে পারতেন, তাঁদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কার স্বার্থে?

