ভোটের চমক ছাড়া মোদীর সংরক্ষণ মডেলে একটিমাত্র ভালো দিক আছে
দেশ এগোবে তো? সরকারি ১০০টি পদের মধ্যে বুদ্ধি-বিচক্ষণতার মাপকাঠিতে নিযুক্ত হবেন ৪০ জন
- Total Shares
ভোটের বাজারে নরেন্দ্র মোদী যে আসল খেলাটি খেলে দিয়েছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ধর্মের ভিত্তিতে নয়, অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণ। গরিব দরদী মোদীর বিরোধিতা করতে পারবেন না মমতা-মায়াবতী-মুলায়ম কেউই। কংগ্রেস তো সঙ্গে থাকার কথা দ্বর্থ্যহীন ভাষায় বলে দিয়েছে। অতএব সংবিধান সংশোধন করে নিলেই হল।
আম আদমির দল থেকে খাস আদমির দল – বিরোধিতা হবে না ঠিকই। কিন্তু সমস্যা হল, দেশ এগোবে তো? সরকারি ১০০টি পদের মধ্যে বুদ্ধি-বিচক্ষণতার মাপকাঠিতে নিযুক্ত হবেন ৪০ জন, বাকিরা সুযোগ পাবেন নীচু জাত ও গরিব (মানে মাসে ৮ লক্ষ টাকার কম রোজগার) বলে।
নতুন করে সংরক্ষণের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে (সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)
স্কুলের বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একবার প্রবল বিতর্ক বেধেছিল সংরক্ষণ নিয়ে। সংরক্ষণ উচিত কিনা। পদবী বিচার করলে আমি উচ্চবর্ণের হিন্দু। খুব সঙ্গত কারণেই আমি সংরক্ষণের বিরোধী হব বা 'হওয়া উচিত', যদিও আমি তা নই। সংরক্ষণ আমি চাই, তবে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের মডেলেও নয়, নরেন্দ্র মোদীর মডেলেও নয়... কংগ্রেসের মডেলে তো নয়ই।
কংগ্রেসের মডেল কোনটি? একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। ভীমরাও আম্বেদকরের নামের প্রসঙ্গ এলেই আমাদের মনে দলিতদের কথা চলে আসে। মনে রাখতে হবে দলিত হিসাবে নয়, সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁকে আমরা সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসাবে নয়, মনে রেখেছি দলিত হিসাবে। এটা হল কংগ্রেসের মডেল। ইংরেজিতে যাকে বলে আইডেন্টিটি পলিটিক্স।
প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং সংরক্ষণ চালু করেছিলেন এক দশকের পুরনো মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করে, সেখানে বিবেচ্য বিষয় শুধুমাত্র জাত-পাত। তাতে সমস্যা হল, যাঁরা ততটা যোগ্য না হলেও চাকরি পাচ্ছেন তাঁরা সহকর্মীদের কাছে তো সম্মান পান না (অন্তত আড়ালে) এবং সাধারণ লোকজনও তাঁদের কোটার লোক বলে কটাক্ষ করে থাকেন। কটাক্ষ না বলে একে বিদ্রুপ বললে ঠিক বলা হবে। যাঁরা যোগ্যতার সঙ্গে সরকারি চাকরি করছেন এই বিদ্রুপ তাঁদেরও পিছু ছাড়ে না, বহু লোককেই বলতে শুনেছি, কোটার আর পাঁচজনের চেয়ে ভালো... আমাদের মতো কাজ পারে না... ক’দিনের মধ্যেই প্রোমোশন হয়ে যাবে...।
রাহুল গান্ধী: সংরক্ষণ বিলের বিরোধিতা করতে পারবেন না কংগ্রেস (সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)
সর্বেশষ হল মোদীর মডেল। এতদিন ছিল শুধুমাত্র জাতের হিসাবে সংরক্ষণ, এখন অর্থনীতির ভিত্তিতে সংরক্ষণ করে গরিব-মসীহ্ হতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাতে আগে যা ছিল তা রয়ে গেল, কিন্তু মুশকিল হল সংরক্ষণ বেড়ে তা ৬০ শতাংশের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না, এ জন্যই সংবিধান সংশোধন করা জরুরি।
অবাস্তব ভাবনা না ভেবে, কোনও জাতপাতের অঙ্ক বিন্দুমাত্র না ঘেঁটে একটা ছোট লাইন জুড়ে দিলেই সংরক্ষণ নিয়ে কেউ যেমন খুব একটা বিরোধ করতে পারবে না তেমন সংরক্ষণের প্রকৃত সুবিধাও সকলে ভোগ করবেন এবং এমন একটি সময় আসবে যখন কেউ আর সংরক্ষণ নিয়ে মাথাই ঘামাবেন না।
করতে হবে সাধারণ একটা কাজ: যদি ক-বাবু সংরক্ষণের সুবিধা নেন তা হলে তাঁর পরের দুই প্রজন্ম (পুত্র-কন্যা, পৌত্র-পৌত্রী তবে বাদ দৌহিত্র-দৌহিত্রী) সংরক্ষণের সুবিধা নিতে পারবেন না। গোড়ার দিকে যাঁরা সংরক্ষণের সুবিধা নিয়েছেন এখন তাঁরা অনগ্রসর নেই, কিন্তু তাঁদের ছেলে-মেয়েরা সুবিধা পাওয়ায় যাঁরা প্রথম দিকে সুবিধা পাননি তাঁরা অনগ্রসরই রয়ে যাচ্ছেন। তাতে সংরক্ষণের সুবিধা থেকে একশ্রেণীর লোকজন বঞ্চিতই রয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সকলেই সংরক্ষণের আওতায় আসবেন। (সামাজিক কাঠামোর কথা বিবেচনা করেই বাদ দৌহিত্র-দৌহিত্রীকে বাদ দেওয়া উচিত)। তাতে তিন প্রজন্ম অর্থাৎ ১০০ বছরের মধ্যেই তিন গুণ লোক সুবিধা পেয়ে যাবেন।
অর্থাৎ সংরক্ষণের তালিকায় যোগ হবেন তাঁরাই প্রকৃতই যাঁদের কথা ভেবে সংরক্ষণ।
সংরক্ষণের সুবিধা যাঁরা ভোগ করতে চান তাঁদের কতজন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে প্রস্তুত? সরকারই বা সেনাবাহিনীতে সংরক্ষণের কথা ভাবছে না কেন? না ভাবাই স্বাভাবিক। দেশের সীমান্তরক্ষার মতো গুরুভার সকলের হাতে সঁপে দেওয়া যায় না। তা হলে দেশগড়ার ভার কেন মধ্যমেধা ও নিম্নমেধার হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে? তাঁরা কেন শিক্ষকতা করবেন? যিনি নিজেই ভালো ছাত্র ছিলেন না বলে সব অধ্যায় বুঝে উঠতে পারেননি তিনি কী ভাবে সেই কঠিন অধ্যায়গুলি ছাত্রদের পড়াবেন?
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা প্রথম রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, কোনও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক বোমা দরকার নেই, শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দিলেই হল। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে যে নীতি প্রণীত হয় সেখানে বলা হয় কোটা থাকবে না, তবে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। আরও গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলা হয়েছিল। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে বিচার করলে তা হবে – কোনও জাতপাত-ধর্ম বা অন্যকিছুর ভিত্তিতে কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কোনও কিছু সংরক্ষণ করা যাবে না।
তা ছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, সেই কাজে দক্ষতাকেও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা আছে।
ভোটের আগে মোক্ষম অস্ত্র ছেড়েছেন নরেন্দ্র মোদী (সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)
দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে আবার ভারতে ফেরা যাক। আমাদের দেশে শিক্ষা থেকে চাকরি, সর্বত্র কোটা চালু না করে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবুক সরকার, সেটা মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে। যেমন চতুর্থ শ্রেণীতে রাজ্যভিত্তিক পরীক্ষা হোক। যারা মেধাতালিকায় প্রথম ১০০০ বা ৫০০০-এর মধ্যে থাকবে তাদের মধ্যে যাদের উচ্চশিক্ষার সঙ্গতি নেই সরকার তাদের সহায়তা করবে। দশম শ্রেণী ও দ্বাদশ শ্রেণীর পরেও তাই। এর মধ্যে সরকার তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে যাতে রাজ্যস্তর ও সর্বভারতীয় স্তরের প্রবেশিকায় পরীক্ষার জন্য তাঁদের প্রস্তুত করার। যাঁরা সুযোগ পাবেন অর্থ যেন তাঁদের কাছে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
তবে এ ক্ষেত্রে আরও একটা ব্যাপার নিশ্চিত করতে হবে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও কেউ দেশের বাইরে যেতে পারবেন না, গবেষণার জন্য যেতে পারেন যদি সেই গবেষণার সুযোগ বা পরিস্থিতি দেশে না থাকে। তবে তা প্রমাণ করতে যেন ওই মেধাবী ছাত্রছাত্রীর গবেষণার সময় না পার হয়ে যায় সেটাও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তাতে দেশ তৈরি হবে মেধার বিকাশের মাধ্যমে। জাতপাতের ভেদাভেদও ধীরে ধীরে লঘু হতে শুরু করবে।
এ দেশে গবেষণার পরিকাঠামো নেই বললেই চলে। সরকারের উচিত দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত ১০টি করে বিশ্ববিদ্যালয় বেছে সেখানে বিশ্বামানের পরিকাঠামো তৈরি করে এবং বিশ্বমানের মেধা যুক্ত করে গবেষণা চালু করা। তাতে মেধার নিষ্ক্রমণ (ব্রেন ড্রেন) রোখা যাবে জোর না করেই।
তথাকথিত উচ্চবর্ণের জন্য যে সংরক্ষণের ভাবনা নরেন্দ্র মোদী ভেবেছেন তাতে রাজনৈতিক ভাবে তাঁর কী লাভ হবে সেই প্রসঙ্গ বাদ দিলে একটামাত্র সদর্থক দিকের কথা বলা যায়, এই প্রথম অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণের ভাবনা সরকারের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রয়োজনের ভিত্তিতে সংরক্ষণের একে প্রথম ধাপ হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। গরিবের সংজ্ঞা বদল করতে সময় লাগবে না, এখন দরকার দেশে যে ৪৯.৯ শতাংশ সংরক্ষণ রয়েছে জাতপাতের ভিত্তিতে, সেখানেই সংরক্ষণ হোক আর্থিক প্রয়োজনের নিরিখে। বাধা আসবে বিরোধীদের থেকে, তবে ভোটের পরে ক্ষমতায় যে রাজনৈতিক দলই আসুক না কেন, তাদের এই পদক্ষেপ করা উচিত।
২ টাকা কিলো দরে চাল দিয়ে চিরকাল দেশের গরিব মানুষকে গরিব করে রাখলে ভোটের চাল ভাতে বাড়বে বটে কিন্ত দেশের উন্নয়ন মাঠে মারা যাবে।

