সরকারি প্রকল্পের নাম নিয়ে এত উৎসাহ কেন রাজনৈতিক দলগুলোর
বাজপেয়ীর প্রকল্পের নাম বদলেছে ইউপিএ, ফের নতুন নাম দেন মোদী, মমতা বলছেন প্রকল্প তাঁর
- Total Shares
হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, তার ছাতার নাম ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু—কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে।” -- হ য ব র ল, সুকুমার রায়
সে অবশ্য নাম বদল করত না!
আসন্ন লোকসভা লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে বিজেপি ক’টি আসন পাবে? বিজেপি বলছে ২২টি। বিজেপি ক’টি পাবে তা নিয়ে চিন্তিত নন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃমমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি চান তৃণমূল পাক রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনই। এ জন্য তিনি জেলায় জেলায় সফর করছেন। এবং সাগরমেলার আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সফর করে দলের পাশাপাশি প্রশাসনকেও তিনি বলে দিয়েছেন, রাজ্য সরকার যে প্রকল্পে ব্যয় করছে সেই প্রকল্পে যেন কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও প্রকল্পের নামগন্ধ না থাকে।
অর্থাৎ, স্বচ্ছ ভারত থাকবে না, সেই প্রকল্পে লিখতে হবে নির্মল বাংলা। ফসল বিমা যোজনায় যাতে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম ব্যবহার না করা হয়, সে ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন প্রশাসনিক আধিকারিকদের। মুখ্যমন্ত্রীর ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পরে তা নিয়ে প্রচারও কম করেনি রাজ্য সরকার। কিন্তু কন্যাশ্রী হোক বা আবাস যোজনা, এই সব প্রকল্প কি সত্যিই এই রাজ্যের? তর্ক শুরু করার আগে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বাগ্মী সাংসদ, দীর্ঘদিন রাষ্ট্রসঙ্ঘে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শশী থারুরের একটা পুরোনো টুইটে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
Why we in @INCIndia insist this is a name-changing government, not a game-changing one! pic.twitter.com/Opdj3n2xaV
— Shashi Tharoor (@ShashiTharoor) 15 June 2017
কংগ্রেস সাংসদের দাবি, নরেন্দ্র মোদী আসলে ইউপিএ সরকারের আমলের প্রকল্পগুলির নাম বদল করে দিয়েছেন। তবে তাঁর দাবির পরে বিজেপি সরকার চুপ করে বসে থাকবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রী একের পর এক উদাহরণ তুলে ধরে দেখিয়েছেন কী ভাবে অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রকল্পগুলো নাম বদলে নিজেদের প্রকল্প বলে চালিয়েছে ইউপিএ সরকার।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অন্য একটি বক্তৃতায় জানান, ফ্রিডম অফ ইনফর্মেশন অ্যাক্টকে নাম বদলে রাইট টু ইনর্মেশন অ্যাক্ট করেছে ইউপিএ, অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে করা অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনাকেই নাম বদলে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন করেছে ইউপিএ সরকার, তাঁর সময়ের সর্বশিক্ষা অভিযানকে নাম বদলে শিক্ষার অধিকার আইন করেছে ইউপিএ সরকার। নিবিড় পরিচ্ছন্নতা প্রকল্পকে বদলে ইউপিএ করেছে নির্মল ভারত।
নির্মল ভারতের কথাই ধরা যাক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার নাম বদলে করে দিলেন স্বচ্ছ্ব ভারত অভিযান এবং এই রাজ্যের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার তার নাম বদলে করে দিলেন নির্মল বাংলা।
নরেন্দ্র মোদী সরকার যে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্প চালু করেছে ২০১৫ সালে, সেই প্রকল্প ২০০৯ সালে চালু করেছিল ইউপিএ সরকার। তবে তারও অনেক আগে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে শিবরাজ সিং চৌহ্বান মধ্যপ্রদেশে চালু করেছিলেন লাডলি লক্ষ্মী যোজনা। এই প্রকল্পেই ১ লক্ষ ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেই প্রকল্পই কেন্দ্রীয় সরকার হয়ে পরে নাম বদলে কন্যাশ্রী নামে এ রাজ্যে চালু হয়। মধ্যপ্রদেশের প্রকল্পটি তাদের নিজস্ব ছিল?
প্রকল্পের উৎসে পৌঁছানো খুব মুশকিল। সবই চলছে নকল করে, যাকে এই যুগের ভাষায় বলা হয় কন্ট্রোল সি+ কন্ট্রোল ভি, মানে কপি-পেস্ট।
শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, নামে কী আসে যায়! কিন্তু আসে যায় বৈকি। রাজনৈতিক লড়াই যখন হয় কার্যত অন্তঃসারশূন্য তখন নামেই সবকিছু আসে যায়। যে গণতান্ত্রিক দেশে গণ-কে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হয় না, যেখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লেজ কুকুরকে নাড়ায়, সেখানে নাম নিয়ে অনেক কিছু আসে যায়।
আমাদের ছোটবেলায় অর্থনৈতিক উদারীকরণ ছিল না। বিদেশি জিনিসের খুব কদর ছিল। তখন একটা মজার অনুগল্প বা চুটকি শুনেছিলাম। সেটা এই রকম: আমেরিকা একটি সূচ বানিয়েছে যেটি চুলের চেয়ে একশো ভাগ সরু। সেটি দেখে বিচারকরা যখন স্থির করে ফেলেছেন যে সূক্ষ্ম জিনিস বানানোয় আমেরিকার মতো পারদর্শী আর কেউ নেই তখন রাশিয়া সেই সূচে সুতো পরানোর গর্ত করে সুতো পরিয়ে দিল। যখন রাশিয়া শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা নিতে চলেছে তখন ভারত গিয়ে সেই সূচে একটি ট্যাগ ঝুলিয়ে দিল, যাতে লেখা মেড ইন ইন্ডিয়া!
প্রশাসনিক অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (টুইটার)
এখনকার দস্তুরও তাই। পুরস্কার পেতেই হবে, সেই পুরস্কার হল জনগণেশের আশীর্বাদ। সে জন্য জনহিতৈষী প্রকল্প চাই। না পেলে ওই প্রকল্পের গায়ে ট্যাগ ঝুলিয়ে দাও।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৩ কোটি। এঁরা পিভি সিন্ধুর জাত খোঁজেন, কিন্তু ভোট দেওয়ার আগে দেখেন না সরকারের সাফল্য কী। এঁরা রাজনৈতিক বক্তৃতার শেষে একবারও নেট ঘেঁটে দেখেন না এই বক্তব্যের সত্যতা কোথায়। সেই সুযোগই নেন আমাদের দেশের রাজনীতিকরা। ভোটের আগে বা ভোটের কথা ভেবে তাঁরা পুরোনো মদ নতুন বোতলে ঢেলে দেওয়ার মতো নাম বদলাতে থাকেন।
শুধু প্রকল্পের মধ্যেই এই প্রবণতা সীমাবদ্ধ রয়েছে এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। সর্ব ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা রয়েছে। একটিমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া।
পরীক্ষার হলে নকল করা নিষেধ।

