বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিমা দাস: ইংরেজি জানা কি একান্ত জরুরি?

সাফল্য কথা বলছে, শুভেচ্ছায় ভাসছেন স্বর্ণপদকজয়ী

 |  7-minute read |   14-07-2018
  • Total Shares

হিমা দাস। বাঙালি নন, অসমের মেয়ে। মাতৃভাষা অসমিয়া। তিনি আর এইটুকু পরিচয়ে আটকে নেই। অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে ৪০০ মিটার দৌড়ে বিশ্ব চ‍্যাম্পিয়ন। গোটা ভারতের মুখ তিনি এখন। ৫১.৪৬ সেকেন্ডের দৌড়ে তিনি বিশ্ব সেরা!! ভারতীয়দের মধ‍্যে এমন সাফল‍্য এই প্রথমবার এল।  অভিনন্দনের বন‍্যা বয়ে চলেছে সোনা জেতার পর। ঠিক তার আগের ধাপের (সেমিফাইনালের) খবর ক'জন রেখেছিলেন? তা হাতে গোনা যেত হয়তো। ইন্ডিয়ান অ্যাথলেটিক ফেডারেশন সংস্থার অফিশিয়াল টুইটার হ‍্যান্ডল— বার্তা পাঠিয়ে ফলোয়ারদের জানায় সব আপডেট। সেমিফাইনালের বাধা টপকে যাওয়ার পর হিমা'র ইন্টারভিউ নেয় টুর্নামেন্টের সম্প্রচারের দায়িত্ব থাকা টিভি ক্রু। সেই ইন্টারভিউ ভিডিও ক্লিপকে নিয়ে হিমার ফাইনালে লড়ার আপডেট দেওয়া হয়। যিনি এই কাজটি করছিলেন, তিনি হিমার ডেয়ারডেভিল স্বভাব আর চ‍্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতার আঁচ দিতেই বোধহয় লিখেছিলেন কথাগুলো। " ... ঝরঝরে ইংরেজি বলতে না পারলেও, সেখানেও তিনি তাঁর সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।"

বেচারা-টুইটার হ‍্যান্ডেল কর্তা!! জানতেনই না , এই কথাগুলো কী বুমেরাং হয়ে উঠবে !! এত্তো ট্রোল হবে!!!

হিমা এখন সেলিব্রিটি। ১৮ বছর বয়স। অসমের অনামী এক গ্রামের চাষির মেয়ে। পাঁচ নম্বর সন্তান— সবচেয়ে ছোট। ফুটবলই খেলতেন। স্কুল ফুটবলে ওর তীব্র গতিতে ছোটা অন‍্যদের  থেকে আলাদা করে চেনাত। গেমস টিচার ওকে টিম গেম থেকে সরে একা দৌড়ের দিকে ঠেলে দেন।  শুরু হয় দৌড়। বাবার চাষের খেতেও দৌড়ত সে। রাজ‍্য অ্যাথলেটে জুনিয়র পর্যায়ে নজর কাড়া শুরু। এরপর রাজ‍্য দলে। অসম থেকে আজ সে ভারতের। ছোটবেলা থেকে অসমিয়া ভাষায় কথা বলা। হিন্দির নাগাল পায় সাই আর রাজ‍্য দলের হয়ে দৌড়তে নেমে। তার কাছে ইংরাজি ভাষা তো অদ্ভুতুড়ে লাগারই কথা।

নিজের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা হাতড়ে দেখলাম, সেওয়াগও তো ভারতীয় দলে এসে হিন্দিতেই কথা বলত। ফুটবলাররাও তাই। দক্ষিণের অনেকে হিন্দি যাও বা বুঝতো, বলতেই পারত না। সাংবাদিক হয়ে ইন্টারভিউ নেওয়ার আগে জেনে নিতে হয়েছে, হিন্দি না ইংরেজি, কোন ভাষায় ইন্টারভিউ নিতে হবে।  হিমাকে সেই টিভি রিপোর্টারটি সেটাও জিজ্ঞেস করতে পারেননি বলে আমি নিশ্চিত। কারণ, তিনি বিদেশিনী। হিন্দিও জানেন না। আমাদের মেয়েটি অসমিয়া জানে। হিন্দিও জানে। কিন্তু ইংলিশ জানেই না, এটা মানতে পারলাম না ভিডিও ক্লিপিংটা দেখে। তিনটি প্রশ্ন ইংলিশে ক‍রা, সে বুঝেই উত্তর দিয়েছে। উত্তর দিয়েছে নিজের স্টাইলে। উত্ত‍র দিয়ে ছিল ভয়-ডরহীন ভাবে। তাতে ছিল জমাট আত্মবিশ্বাস। বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল, ফাইনালটাও জিততে চায়।

জাতীয় সংস্থার যিনি টুইটার হ্যান্ডেল সামলান, তাঁর ভালো লেগেছিল, ভয়-ডরহীন হিমার ভাঙাচোরা ইংরেজিতে উত্ত‍র দেওয়ার সময়কার বডি ল‍্যাঙ্গুয়েজটা। তাই ও ভাবে লিখেছিলেন। সাত পাঁচ ভাবেননি। কিন্তু ভাবা উচিৎ ছিল। আমাদের ভালো দিকটাকে বেশি করে সামনে আনা উচিৎ ছিল। সেমিফাইনালের দৌড়ের ক্লিপিং দিয়ে খবরটা ছড়িয়ে দেওয়া যেত। অবাক হতে হয়, আমাদের অ্যাথলিটরা তো এখন হামেশাই বিদেশে নানান প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যায়, তখন ম‍্যানেজার হওয়ার জন‍্য কত কীর্তির খবর পাই। কিন্তু এই ম‍্যানেজাররা প্রচার মাধ‍্যমের সময় সফল ক্রীড়াবিদদের পাশে থাকেন কী?

ক্রিকেট, ফুটবল (এশিয়ান গেমসে খেলার ছাড়পত্র না পেলেও) আজ যে কোনও দলের সঙ্গে মিডিয়া ম‍্যানেজার রাখে। আইসিসি কিংবা ফিফা বিশ্ব চ‍্যাম্পিয়নশিপ হলেই নিজেদের আনুবাদক রাখে। এই যে ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলছে, প্রেস কনফারেন্সে তো ফ্রেঞ্চ ভাষায় বলছে ওদের ফুটবলাররা। কই, কেউ কিছু লিখছেন?

তা হলে, ফেডারেশনের অফিশিয়াল টুইটার হ‍্যান্ডেলে এর উল্লেখ কেন করতে হল? আসলে পরাধীনতার হীনমন‍্যতা থেকে এখনও আমরা অনেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। ক্রিকেটেও দেখেছি, পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটার টিভি ইন্টারভিউ দিতে চাইতেন না (এখনও আছে, তবে সংখ‍্যায় কম) ইংরেজিতে বলতে হবে বলে। আমাদের প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ী দলের অধিনায়ক কপিলদেবও শুরুর দিকে চোস্ত ইংরেজি বলতেই পারতেন না। তাতে তো তাঁর সাফল‍্য আটকায়নি। 

ওরা খেলোয়াড়। ওদের ভাষা অন‍্য। পারফরম‍্যান্স— ওদের ভাষা।

হিমাদের জন‍্য জাতীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোর ভাবা উচিৎ। প্রশিক্ষণ শিবিরে অন‍্য ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি স্পোকেন ইংলিশও শেখানোর ব‍্যবস্থা করুক। আর ম‍্যানেজার যাকেই করা হোক, তার করণীয় কি কি তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া হোক। তার মধ‍্যে বাধ‍্যতামূলক হোক— প্রচার মাধ‍্যমের সামনে আমাদের আগামী দিনের প্রতিভাদের যেন একা ছেড়ে না দেন। কাজের চাপ বেশি থাকলে, দলের সঙ্গে পেশাদার যোগ‍্য ব‍্যক্তিদের মিডিয়া ম‍্যানেজার করে পাঠানো হোক। যে কোনও পর্যায়ে খেলার মাঠের সাফল‍্যে সফল ক্রীড়াবিদদের প্রচার পাওয়া আজকের দুনিয়ায় খুব জরুরি। এটা বুঝতে জাতীয় সংস্থা এবং সরকারি কর্তারা আরও কতো সময় নেবেন? হিমার সাফল‍্যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিমেষে ট‍্যুইট করে শুভেচ্ছা বার্তা ছড়ালেন।

অনেকেই জানেন না, হিমার টুইটার অ্যাকাউন্ট নজর কাড়া সাফল‍্যের পর কেউ বানিয়ে দিয়েছে। বেচারি, হয়ত এ সবে এখনও রপ্তই নয়। হ‍্যাশট‍্যাগ (#) দিয়েই দেশের হুজ হু'রা শুভেচ্ছা টুইট করে চলেছেন। হিমা না জানলেও চলবে। মিডিয়া জানছে। আম জনতা জানছে। স্রেফ দেখনদারি।  অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান থেকে শুরু করে সচিন তেন্ডুলকার-বিরাট কোহলি , পিটি ঊষা -- কেউ বাদ নেই। রাষ্ট্রপতি তো অসমিয়া ভাষার টুইট করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

অসম এখন বিজেপি'র শাসনে চলা রাজ‍্য, তাতে কি, হিমা তো 'দাস'-- এক পাশের রাজ‍্যের ভারতীয় প্রতিভা। তাই এ রাজ‍্যের মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এমন বিশ্বজয়ীর জন‍্য টুইটারে শুভেচ্ছা জানাতে দেরি করেননি। 

হিমা কী এসবের খোঁজ রাখলেন? দরকার কী? আমরা খোঁজ তো পেলাম আরও এক প্রতিভাবান নারীর।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

DIPANKAR GUHA DIPANKAR GUHA @dg_1965

The writer is a Senior Sports Journalist

Comment