সত্যিকারের মেধার মতো কৃত্রিম বুদ্ধিও এখন আমাদের জীবনে ঘোর বাস্তব
সাধারণত একটি আশঙ্কা করাই হয় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেকারত্ব বাড়াবে ব্যাপক হারে
- Total Shares
তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে ঘর করছেন না এমন লোকের দেখা মেলা আজ দুর্লভ। খুব সাধাসিধে জীবনযাপন করা ব্যক্তির জীবনেও অন্ততপক্ষে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল ঢুকে পড়েছেই, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহারিক জিনিসের মতো। আর এই মায়াজালে যাঁরা জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁরা আজকাল নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন কোনও এক অদৃশ্য বন্ধু যেন আপনার সেবায় সদাই মজুত। এ যেন সেই আলাদিনের আশ্চর্যপ্রদীপের দৈত্যের মতো। ফেসবুকং ফোটো আপলোড করলে সে চিনে নেয় আপনার সঙ্গীকে, হোয়াটসঅ্যাপে আপনার বন্ধুকে মেসেজ লেখার সময় ভুল টাইপ করলে সে ঠিক করে দেয় নিমেষে, এমনকি আপনার রাতে ঘুম কম হলেও আপনাকে সাবধান করে দেয় পরম বন্ধুর মত। এহেন বন্ধুর সেবায় ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে গেলেও আপনি নিশ্চয় কখনও কখনও ভেবেছেন কে এই বন্ধু! একবিংশ শতকের আলাদিনের দৈত্যের নাম এআই বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
এ তো গেল আপনার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় পর্ব। এ বার তা হলে জেনে নেওয়া যাক আপনার বন্ধু কাজ করে কী করে?
তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে ঘর করছেন না এমন লোকের দেখা মেলা আজ দুর্লভ
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স অনেকাংশে কাজ করে আমাদের মানব বুদ্ধিমত্তা বা হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সের মতোই। বিশেষ করে বুদ্ধিমত্তার একটা বড় অংশ, আইডেন্টিফিকেসন এবং ক্লাসিফিকেশন, যাকে আমরা বাংলায় বলি শনাক্তকরণ ও শ্রেণিবিন্যাস, সেটা কাজ করার পদ্ধতি প্রায় একই। একটি শিশু জন্মানোর পর তাকে যেমন চারপাশের প্রাণী, উদ্ভিদ বা বস্তু বিশেষ চেনানো হয় উদাহরণ এর মাধ্যমে, এক্ষেত্রেও এআই সফটওয়্যার কে প্রথমে "ট্রেইন” বা প্রশিক্ষিত করা হয় কয়েকটি উদাহরণ এর মাধ্যমে। তবে হ্যাঁ, উদাহরণের সংখ্যার হয়ত ফারাক আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, কারণ মানব বুদ্ধিমত্তা খুব কম সংখ্যক উদাহরণের উপরেই কাজ করে। আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য “ট্রেইনিং সেট” বা প্রয়োজনীয় উদাহরণের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে একটি মানব শিশুর শিক্ষা হয় তার এক সার্বিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এবং সর্বোপরি ভাষা পরিচয়-- এই সব ব্যবহার করে হয় তার সার্বিক অভিজ্ঞতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে এই সার্বিক অভিজ্ঞতাটা স্বাভাবিক নয়, একজন ইঞ্জিনিয়ার কে সেটা ডিজাইন করতে হয় ছোট ছোট অনেক আর্টিফিসিয়ালি ইনটেলিজেন্ট সফটওয়্যার একত্রিত করে।
এ ছাড়াও আরও অনেক দিক আছে, যেখানে খুবই সাফল্যের সঙ্গে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগ হচ্ছে। আসলে তথ্যপ্রযুক্তির সাথে মানুষের ঘর করা যত বাড়ছে, প্রতিনিয়ত ডিজিটাল ডেটা তৈরি হচ্ছে ততো বেশি। আর এই প্রভূত পরিমাণ ডেটা’র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা মানুষের পক্ষে প্রায় অসাধ্য। যেমন ধরুন আজকাল একদিনে যত হেলথ ব্লগ লেখা হচ্ছে, বা প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ রিসার্চ পেপার বা জার্নাল পাবলিশ হচ্ছে, কোনও মানুষের পক্ষে সেসব পড়ে একটা সম্যক ধারনা নিজের কাজে লাগানো প্রায় অসম্ভব তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া। আর সেখানেই ব্যাবহার হচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আরেক বড় হাতিয়ার - “ন্যাচারাল ল্যাঙ্গোয়েজ প্রসেসিং” বা স্বাভাবিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ। আজকের আর্টিফিসিয়ালি ইনটেলিজেন্ট সফটওয়্যার ইংরাজি ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণির ভাষা অনেকাংশে বুঝতে সক্ষম আপনার আমার মতোই। তাই এই দুর্বার গতিতে তথ্য তৈরি হওয়ার যুগে, কোনটা কাজের খবর খুঁজে বার করে তার থেকে প্রয়োজনীয় অংশ উপস্থাপন করার একটা গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছে বিভিন্ন আর্টিফিসিয়ালি ইনটেলিজেন্ট সফটওয়্যার।
একবিংশ শতকের আলাদিনের দৈত্য’র নাম এআই বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স
এআই-এর আরেকটি বড় ব্যবহারিক দিক হল “অটোমেশান” বা স্বয়ংক্রিয়তা। তথ্য প্রযুক্তির জগতে অটোমেশান নতুন কিছু না। তথ্য প্রযুক্তি জন্মের আদি যুগ থেকে আমরা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দেখছি। টিকিট কাটা বা টাকা তোলার ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র মানুষের কাজের ভার লাঘব করেছে অনেকদিন। কিন্তু এই ধরণের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র সবটাই “ইন্সট্রাকশন বেসড” বা নির্দেশ ভিত্তিক। কয়েকটি পূর্বপরিকল্পিত উপায় এর মাধ্যমেই আমরা এইসব স্বয়ংক্রিয় মেশিনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। আজকের দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ এই স্বয়ংক্রিয়তাকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। হোটেলের রিসেপশন, কলসেন্টার বা অন্যান্য অনেক জায়গায় যেখানে আমরা উল্টোদিকের মানুষটির সঙ্গে সাধারণত কথা বলতে অভ্যস্ত, সেখানে ধীরে ধীরে প্রবেশ ঘটছে স্বয়ংক্রিয় রোবটের। আর হ্যাঁ, এসবই হচ্ছে কোনও সার্ভিস কম্প্রোমাইস না করেই। অর্থাৎ আপনি কথা বলবেন রিসেপশনে দাঁড়ানো কোনও এক যন্ত্রমানব বা যন্ত্রমানবীর সঙ্গেই, যেমনটি বলছিলেন আগে। এরই একটু ছোট সংস্করণ আপনার আইফোনের সিরি, বা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের গুগল নাও, অথবা আপনার ড্রয়িং রুমে শোভা পাওয়া আমাজন ইকো।
এতো গেল আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কাজের পরিধি। কিন্তু এই ব্যাপারে গত পাঁচ-সাত বছরে সবচেয়ে বেশি হইচই শোনা যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বয়স কি তাহলে তাই?
আমরা জানি যে প্রত্যেক ব্যবহারিক প্রয়ুক্তি’র পেছনে লুকিয়ে থাকে কোন এক বিজ্ঞানের আবিষ্কার। মজার ব্যাপার হল এই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে যে বিজ্ঞানের অবদান আছে, তার আবিষ্কার হয়েছে অনেকআগেই। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের জীবনে এর ব্যবহার এর জন্য যে প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো দরকার, তা ছিল প্রায় হাতের নাগালের বাইরে। তাই অনেক দিন পর্যন্ত গবেষণা ঘরের বাইরে এর তেমন কোন ব্যবহারছিল না বললেই চলে। তথ্যপ্রযুক্তি’র পরিকাঠামোগত দিক, যা আমরা সাধারণত হার্ডওয়্যার নামে জানি, বিগত কয়েক দশকে তার প্রভূত উন্নতির ফলেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছাপ আজ আপনার আমার মোবাইলে, গাড়িতে, অফিসে, এমনকি হয়ত বেডরুম এর মধ্যেও। তবে এই নিয়ে নিরন্তর গবেষণা আজও চলছে।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য “ট্রেইনিং সেট” বা প্রয়োজনীয় উদাহরণের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়
এ ছাড়াও “এ আই” নিয়ে হইচই এর আরেকটা কারণ হল সফটওয়্যার সম্বন্ধে আমাদের বিগত বেশ কয়েক বছর ব্যাপী ধারনা। এতদিন সফটওয়্যার বলতে আমরা মোটের উপর, ডিটারমিনিস্টিক বা নির্ণায়কপদ্ধতির কথাই জেনে এসেছি। অর্থাৎ কিনা সফটওয়্যারটি একটি ফিক্সড প্রোগ্রাম-নির্ভর। এইরকম সফটওয়্যার যতবারই চালানো হোক, একটি ইনপুট এর জন্য একই আউটপুট তৈরি করে। কিন্তু কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা যুক্ত সফটওয়্যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রোবাবিলিস্টিক বা সম্ভাব্য পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। তাই বিভিন্ন সময়ে এক ইনপুট এর জন্য একই আউটপুট নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব এবং তা কাম্যও না - কারণসময়ের ফারাকে একটি আর্টিফিসিয়ালি ইনটেলিজেন্ট সিস্টেমের জ্ঞানের পরিধির পরিবর্তন হওয়া খুব স্বাভাবিক। আমাদের নিত্যনৈমিত্যিক জীবনে এই রকম তথ্য প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে চলা একটু নতুনঅভিজ্ঞতা বইকি।
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আপনার কতটা পরম বন্ধু। কিন্তু তার সাথে হয়ত আশঙ্কাও করছেন এই বন্ধুই একদিন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে?
“এ আই” এর আরেকটি বড় ব্যবহারিক দিক হল “অটোমেশান” বা স্বয়ংক্রিয়তা
সাধারণত একটি আশঙ্কা আছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেকারত্ব বাড়াবে ব্যাপক হারে। আমি মনে করি এটি একটি সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ মানুষের কিছু দক্ষতার দাম যেমন কমবে, তেমনিই বাড়বে কিছু দক্ষতার কদর। কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা এবং উৎপাদিত দক্ষতা মধ্যে ফাঁক পূরণ না হওয়া পর্যন্ত একটি ছোট পর্যায়ে অস্থিরতা থাকতেপারে, কিন্তু কয়েক বছর সময়ের মধ্যে তা পূরণ হয়ে যাবে বলেই আমার ধারনা। তবে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঁধে গুরুদায়িত্ব থাকবে এই ফাঁক যথাসম্ভব পূরণের।অনেকে অবশ্য চিন্তিত হবেন এই ভেবে যে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা আসলে অনেক উচ্চমানের এবং সে দক্ষতা সকলের থাকবে না। তাদের জানা দরকার যে ক্রমশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি ও তার ব্যবহারের মধ্যে একটা তফাত তৈরি করা হচ্ছে। যত দিন যাবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠবে বলেই আমার ধারণা। আর তার জন্য কাঙ্ক্ষিত দক্ষতাও হবে অনেক সহজ লভ্য।

