সংরক্ষণ-বিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশে, দেখলেন ঢাকা-প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রী

লড়াই শেষ, কিন্তু আমার ছবিগুলো তো রয়েই যাবে

 |  3-minute read |   17-04-2018
  • Total Shares

“ওরা যুদ্ধ যুদ্ধ আওয়াজ তুলেছে”

একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রথমে একটু নার্ভাস ছিলাম। তারপর যখন ছবি তোলা শুরু করলাম, তখন বুঝলাম একজন চিত্র সাংবাদিক হিসেবে কাজের কোনও বিশেষ ক্ষেত্র থাকতে নেই। ধীরে ধীরে আমিও বাংলাদেশের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের অংশ হয়ে গেলাম। যে বিষয়টি আমার সঙ্গে থেকে গেল তা হল অভিজ্ঞতা আর অন্যদিকে বাংলাদেশে যতদিন সংরক্ষণ সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়টি আলোচনার অংশ হয়ে থাকবে, ততদিন আমার বা আমাদের ছবিগুলো থেকে যাবে সময়ের দলিল হিসেবে।

গত ৮ই এপ্রিল (রবিবার) বিকেলবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী জমা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন টিএসসি চত্বরে। তাদের দাবি ছিল, বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যে ৫৬% সংরক্ষণের আওতায় রয়েছে, তার সংস্কার। প্রাথমিক ভাবে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। প্রসঙ্গত, তারা কিন্তু সংরক্ষণ-বিরোধী আন্দোলন করেনি, তারা সংরক্ষণ ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবি জানায়। আন্দোলনকারীরা ৫৬%-এর মধ্যে যে ৩০% কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য বরাদ্দ আছে, তা সংস্কারের আহ্বান জানায়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী এবং মহিলাদেরও সংরক্ষণ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলেছিল তারা।

শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ধীরে ধীরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির দিকে এগোতে থাকে। রাত ৮টা নাগাদ আন্দোলনকারীরা যখন স্লোগান সহযোগে শাহবাগ মোড়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তখন পুলিশ তাদের উপর কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট নিয়ে হামলা শুরু করে এবং অবশেষে লাঠিচার্জও করা হয়।আন্দোলনকারীদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রায় সারারাত ধরে ছাত্র-পুলিশ অস্থির সংঘর্ষ চলতে থাকে। অন্তত ১০০ জন ছাত্র আহত হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রধান দল আওয়ামি লিগের পৃষ্ঠপোষক ছাত্রদল (ছাত্রলিগ) আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পরে এবং তাদের উপস্থিতি নিয়ে জলঘোলা হতে শুরু করে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খবর আসতে থাকে ছাত্রলিগের একাংশ আন্দোলনটিকে নৈতিক ভাবে সমর্থন করছে আর অন্য আর একপক্ষ এর বিরোধিতা করে চলেছে।

ইতিমধ্যে ঢাকার রাস্তায় পুলিশ-ছাত্র বিরোধ চরমে পৌঁছায়। যা পরবর্তী দু'দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অবশেষে সরকার ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সংসদ ভবনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বিবৃতিতে জানান যে, তিনি কোটা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটাচ্ছেন এবং কোনও সংস্কারের ঝুঁকি তিনি আর নিচ্ছেন না। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্র কোটা মুক্ত হল।

ইতিহাসের দিকে নজর দিলে একটা বিষয় লক্ষ করা যাবে - বিশ্বের খুব কম দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে এমন ভুমিকা পালন করেনি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষকশিক্ষিকারা অবিশ্বাস্য ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরিণাম তো স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ছাত্র আন্দোলন এখানেই থেমে থাকেনি, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী এরশাদ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দলনে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

সেই অভিশপ্ত রবিবার রাতে ঝামেলা শুরুর আধ-ঘণ্টা পর আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। কাঁদানেগ্যাসের প্রভাবে তখন দমবন্ধ হয়ে আসা অবস্থা। কিছুক্ষণ পরে এক আন্দোলনকারী এসে তাঁর গামছার একাংশ ছিঁড়ে আমাকে দেন যাতে আমি নাকে জড়িয়ে নিতে পারি। রাস্তা বন্ধ করে চারিদিকে আগুন জ্বালিয়ে ওরা স্লোগান দিচ্ছিল “আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো”। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর কণ্ঠে এই স্লোগানে তখন মুখরিত শাহবাগের চত্বর। শাহবাগের আকাশে-বাতাসে অবশ্য বুলেটের গন্ধ।

কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী হওয়া অবস্থায় আমিও সাক্ষী থেকেছি বহু ছাত্র আন্দোলনের। ২০১৪ সালের হোক কলরব আন্দোলন তার অন্যতম। বাংলাদেশে চলে আসি পাঠশালা থেকে চিত্র সাংবাদিকতা এবং ডকুমেন্টারি ফোটোগ্রাফি নিয়ে পড়ব বলে। ক্যামেরা প্রথম থেকেই আমার কাছে সমাজ পরিবর্তনের যন্ত্র এবং একই সঙ্গে অস্ত্র। বাংলাদেশ বা কলকাতা নয়, বিষয়টি যে কোনও দেশের যে কোনও আন্দোলনেের ছবি ধরার মত সাহস রাখব ভবিষ্যতে যদি সুযোগ দেওয়া হয় এবং পৌঁছে দেব আমার শহর-সহ সারা বিশ্বে।

প্রাথমিক ভাবে সাংবাদিকের আগেও আমি একজন ছাত্রী যে নিজের দেশেও এই ধরণের বৈষম্যের শিকার। তাই আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি যে গোটা আন্দোলন কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। গোটা রাত ধরে এই ধরণের আন্দোলন ক্যামেরাবন্দি করতে পেরেছি বলে।

লড়াই শেষ। কিন্তু আমার ছবিগুলো তো রয়েই যাবে।

body_041718025356.jpg

body_041718124701.jpg

body1_041718124717.jpg

body3_041718124731.jpg

body4_041718124744.jpg

body2_041718124816.jpg

body5_041718124836.jpg

body6_041718124851.jpg

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TANIYA SARKAR TANIYA SARKAR

The writer is student of photography, Pathshala-South Asian Media Institute, Dhaka.

Comment