বর্ণময় চরিত্রের অভাবে ধুঁকছে বাংলার ফুটবল

অপহরণ করলে মুক্তিপণ লাগত না, উল্টে টাকা নিয়ে সই করতে যেতে হত

 |  3-minute read |   15-04-2018
  • Total Shares

অষ্টআশি সালের এক দুপুর। একটি অফিস টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেছি। কিন্তু টার্মিনাল বিল্ডিং থেকে বেরতেই শুরু হল বিপত্তি। বিমানবন্দরের বাইরে থেকে রীতিমতো অপহরণ করা হল আমাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি গাড়িতে বসিয়ে সোজা নিয়ে যাওয়া হল শিয়ালদহের একটি হোটেলে। পরে বুঝলাম ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তারা কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন। এই অপহরণের মজাটা হল, আমাকে কোনও মুক্তিপণ দিতে হবে না। উল্টে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময় ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলে আমি মুক্তি পাব। ঠিক হল, পরেরদিন সই-সাবুদ হবে।

সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। তখনকার দিনের অধিকাংশ ফুটবলারই বাবা-মা, দীক্ষাগুরু, ছেলেবেলার প্রশিক্ষক বা পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম না করে তাঁদের আশীর্বাদ না নিয়ে সই করতেন যেতেন না। আমিও বেঁকে বসলাম। সাফ জানিয়ে দিলাম যে বড়দের প্রণাম না করে আমি কোনওমতেই সই করতে যাব না। দীর্ঘ টালবাহানার পরে অনুমতি এল। ঠিক হল, আমি হোটেল থেকে সরাসরি বাড়িতে যাব তারপর একটি নির্দিষ্ট সময় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সই করতে যাব।

কিন্তু ইস্টবেঙ্গল কর্তারা বুঝতেই পারেননি যে পাখি উড়ে যাবে। সে বছর মোহনবাগানই খেলতে চেয়েছিলাম আমি। বাড়ির লোকেরাও তাই চেয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে দেখি মান্নাদা (শৈলেন মান্না) বসে আছেন। আর কালবিলম্ব না করে সোজা ছুটলাম সই করতে। অন্য দলের কর্তারা আমার নাগাল পাওয়ার আগেই আমি মোহন বাগানের অনুকূলে সই করলাম।

শুধু আমাকে নিয়ে নয়, ময়দানে কান পাতলেই এ রকম গল্প আরও শোনা যেত। কৃশানু দে, বিকাশ পাঁজি, সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, মহম্মদ ফরিদ, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, তরুণ দে আমাদের সময় বা তার আগের যুগের প্রায় প্রত্যেক ফুটবলারের এই ধরণের অভিজ্ঞতা কখনও না কখনও হয়েছে। তখন এই বৈশাখ মাসে শুরু হত নতুন মরসুমের জন্য দল বদল। আর এই ধরণের নাটকীয় কাণ্ড ঘটত দলবদলকে ঘিরে।

আমি ১৯৮৮ সালের গল্পটা বললাম। আর এখন ২০১৮। ব্যবধান মাত্র তিরিশ বছরের। আর এই তিরিশ বছরে বাংলার ফুটবল যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। দলবদলের সময় আর কোনও নাটক হয় না। বলতে গেলে দল বদলের সেই জৌলুসটাই আর নেই। কেউ খুব একটা খোঁজখবর রাখেন না। কেউ আর তাঁদের প্রিয় ফুটবলারদের সই দেখতে সুতাকরিন স্ট্রিটের ওই সরু গলিটায় আর অপেক্ষা করেন না।

body1_041518042544.jpgবাঙালি ফুটবলার দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়

আসলে বাংলার ফুটবলে চরিত্রের অভাব দেখা দিয়েছে।একে তো বাঙালি ফুটবলার দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। আর যারা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে চরিত্র কোথায়?

একমাত্র ভাইচুং ভুটিয়া বা সুনীল ছেত্রীর মতো কয়েকজন ফুটবলারকে বাদ দিলে ১৯৯০ বা তার পরবর্তী দশকে উঠে আসা ফুটবলারদের নিয়ে কোনও ক্রেজ নেই। এখনও আমাকে, সুব্রত ভট্টাচার্যকে, বিকাশ পাঁজিকে পুজো উদ্বোধন বা কোনও ফুটবল ম্যাচ উদ্বোধনে অতিথি করে নিয়ে যাওয়া হয়, বর্তমান প্রজন্মের কোনও ফুটবলারকে নয়। এর পিছনে কারণ একটাই, চরিত্র নেই।

আসলে আজকালকার ফুটবলাররা নিজেদের ভবিষ্যতের বিষয় অত্যন্ত সচেতন। কিন্তু ক্লাবের প্রতি বা ফুটবল খেলার প্রতি স্বতস্ফূর্তটুকু নেই। ইস্টবেঙ্গল হোক মোহনবাগান হোক বা মহমেডান স্পোর্টিং, এগুলো শুধুমাত্র ক্লাব নয়, এগুলো বাংলার ফুটবলের তথা ভারতের ঐতিহ্য। আর এই ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের কাঁধে,, তাঁদের যদি ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকে তাহলে কী ভাবে হবে?

body_041518042657.jpgইস্টবেঙ্গল হোক বা মোহনবাগান ক্লাবগুলো ফুটবলের ঐতিহ্য

আমরা অর্থের পিছনে ছুটতাম না। ভালো মানের ফুটবল খেলা, সারাবছর ফিটনেস ধরে রাখা, ক্লাব ও সমর্থকদের প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল। বছরে ১৫-১৬টা করে টুর্নামেন্ট খেলতাম। বড় দলগুলোতে খেলার সুবাদে বেশির ভাগ টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলতাম। অর্থাৎ ম্যাচের সংখ্যা বেড়ে যেত। এর পর জেলার হয়ে খেলা, রাজ্যের হয়ে খেলা ও জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা। তার উপর আবার অফিস ম্যাচ। তাই সারা বছর ফিট থাকতেই হত। কোনওদিনও অভিযোগ করিনি। জানতাম, আমার কাজ ফুটবল খেলা এবং আমাকে সারা বছর ধরেই ভালো ফুটবল খেলতে হবে।

ফুটবলের সুবাদেই আমার নাম-ডাক। তাই তো নিজের ভবিষ্যৎ নয়, ভালো ফুটবল খেলাটাই আমাদের সময়ের ফুটবলারদের মূল লক্ষ্য ছিল। আর ভালো ফুটবল খেলেই আমরা সমর্থকদের প্রিয় হয়ে উঠেছি। ভালো ফুটবল খেলেই গড়ের মাঠে এতগুলো চরিত্রের সৃষ্টি হয়েছে।

চরিত্র চাই চরিত্র।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SISHIR GHOSH SISHIR GHOSH

Former National Footballer.

Comment