সচেতনতার অভাব রয়েছে ভদ্রেশ্বরে, শহরের বুকে রয়েছে বহু খাটাল
শৌচাগার থাকলেও তা ব্যবহারের অভ্যাস হয়নি, অভাব উপযুক্ত নিকাশির
- Total Shares
হুগলি নদীর পশ্চিমতীরে ছোট শহর ভদ্রেশ্বর। ৮.২৮ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে থাকা এই শহরে প্রায় দেড়শো বছর আগে গড়ে উঠেছিল পুরসভা। এখন এখানে রয়েছে মোট ২২টি ওয়ার্ড।
শহরের বুকে গঙ্গার তীর ঘেঁসে গড়ে ওঠা অন্য শহরের মতো এই শহরেও রয়েছে একের পর চটকল, যাকে এই শহরের অন্যতম ল্যান্ডমার্কও বলা চলে। শহরে যখন একের পর এক চটকল গড়ে উঠছে, তখন রুজি-রুটির টানে প্রচুর শ্রমিক এখানে আসতে শুরু করেন, তাঁদের বেশিরভাগই হিন্দিভাষী রাজ্যের। ধীরে ধীরে তাঁরা এই শহরের বাসিন্দা হয়ে যান।
এই শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দাই হিন্দিভাষী রাজ্যের
গঙ্গার ধার ঘেঁসে জিটি রোডের দু’পাশে তখন থেকেই ঝুপড়ি-বস্তির রমরমা। প্রথমে ঘরের প্রয়োজনে ও পরে বাড়তি আয়ের আশায় শহরের নানা প্রান্তে গজিয়ে উঠতে থাকে খাটাল, মূলত মোষের। শহরে জনসংখ্যার চাপ বাড়তে থাকে সময়ের সঙ্গে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আবর্জনার স্তূপ। শৌচালয় দীর্ঘদিন ধরেই ছিল বিলাসিতা। চটকল ও বিভিন্ন কলকারাখানার শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের লোকজন শৌচকাজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন গঙ্গার ধারকেই। সেই অভ্যাস পুরোপুরি চলে গিয়েছে, এ কথা হলফ করে বলা যাবে না।
হিন্দি ভাষাভাষীদের একটা বড় অংশের মানুষের বাস এখানে। শিক্ষার হার এখানে তুলনামূলক কম থাকায় পরিবেশ দূষণ রোধ ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তাঁদের মধ্যে সচেতনতার অভাব স্পষ্ট। যে কারণে শহরে পাকা ঢালাই রাস্তা ও হাল আমলের এলইডি আলো দিয়ে উন্নয়ন করা হলেও, শহর জুড়ে আবর্জনার নরক যন্ত্রণা থেকে মানুষ এখনও রেহাই পাননি। গঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা চটকল ও অন্যান্য কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি গঙ্গায় এসে পড়ছে। সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শ্রমদপ্তর ও স্থানীয় পুরসভার নজরদারী ভীষণ ভাবে জরুরি।
কেন্দ্রে নতুন সরকারের আমলে স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প ও এ রাজ্যে নির্মল বাংলা প্রকল্পে বাড়ি বাড়ি শৌচালয় তৈরি হলেও অনেককেই এখনও শৌচালয়মুখী করে তোলা যায়নি। তাঁরা খোলা আকাশের নীচে গঙ্গার ধারে রাস্তায় বড় নর্দমায় শৌচকাজ করেন। এই সমস্ত বিষয়গুলির ক্ষেত্রেও স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি জরুরি।
ভদ্রেশ্বর স্টেশন রোডের বিরাট এলাকা নিয়ে কয়েকশো খাটাল রয়েছে
ভদ্রেশ্বর স্টেশন রোডের বিরাট এলাকা নিয়ে কয়েকশো খাটাল রয়েছে। খাটালগুলির পরিবেশ যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনি খাটালের গবাদি পশুর মলমূত্রে পরিবেশের দফারফা। খাটালগুলিতে পর্যাপ্ত জল ও দুর্বল নিকাশির কারণে শহরে দূষণ বাড়ছে। পুরসভার স্যানিটারি বিভাগের একজন মাত্র স্যানিটারি ইনস্পেক্টর থাকায়, সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। ভদ্রেশ্বর পুরসভার শুধুমাত্র খাটালগুলিতে নজরদারির জন্য আলাদা কমিটি গড়া উচিৎ। এ ছাড়া দক্ষিণ ২৪ পরগনার আদলে যদি এখানে অপ্রচলিত শক্তির মাধ্যমে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ গোবর কাজে লাগিয়ে গ্যাস উৎপাদন করা যায় তাহলে পরিবেশ দূষণ যেমন আটকানো যাবে তেমনি জ্বালানিরও সাশ্রয় হবে।
স্থানীয় নেতাজি মাঠের কাছে কয়েক বিঘা জমির উপরে রয়েছে পুরসভার ভাগাড়। সেখানেই জাইকা প্রকল্পের মাধ্যমে হয়েছে ভার্মি কম্পোজ প্ল্যাট। সেখানে পচনশীল ও অপনশীল বর্জ্য আলাদা করে সার তৈরি ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করার কাজ চলছে। বড় বড় ট্রাকে ও হাত গাড়িতে শহরের জঞ্জাল তোলা হলেও সেই জঞ্জাল পরিকল্পনা মাফিক প্ল্যান্টে নিয়ে কাজে লাগাতে হবে।
শহরকে পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা
শহরকে পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত রাখতে এতটুকুই যথেষ্ট নয়। সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। তাই পুর এলাকার বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রী, ক্লাবসংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে নিয়ে সারা বছর পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা মূলক শিবির করতে হবে পুরসভা ও স্থানীয় প্রশাসনকে। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন বড় বড় ধর্মীয় উৎসব, যেখানে প্রচুর মানুষ বাইরে থেকে এখানে সড়ো হন, তাঁদের জন্য ভ্রাম্যমান শৌচালয়ের ব্যবস্থা করা উচিৎ। পরিবেশ রক্ষার আবেদন জানিয়ে মাইকে প্রচার লিফলেট বিলি করা দরকার, তবে দেখতে হবে সেই লিফলেট যেন আবার জঞ্জাল না বাড়ায়।
পুসভার সাফাই বিভাগের কর্মীরা দিনের আলোতে যেভাবে কাজ করেন রাতে ও তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। এছাড়া যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার জন্য নাগরিকদের জরিমানা করা যায়। শহরের বিভিন্ন মন্দির মসজিদ ও অন্য ধর্মীয় স্থান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র সিনেমা হল – যেখানে বহু মানুষের সমাগম হয় সেখানে পরিবেশ দূষণ রোধের আবেদন জানিয়ে ফ্লেক্স-ব্যানার টাঙানো যেতে পারে। জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পরিবেশ রক্ষা কমিটি গঠন করে বাসিন্দাদের নিয়ে কাজ করলে দারুণ ফল মিলতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া, যেমন ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেও লোককে সচেতন করা যায়।

