জন্ম থেকেই মুরগিদের অপরিছন্ন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়, তারা জানতেই পারে না পরিচ্ছন্ন পৃথিবী কাকে বলে
মাংসের জন্যে ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মুরগি, ‘হত্যা’ করা হয়
- Total Shares
মোরগ প্রজাতির যোগাযোগ রক্ষার ক্ষমতা প্রবল। তাদের তিরিশ প্রকারের বেশি স্বর ক্ষেপনের এবং তা গ্রহণের বিদ্যা জানা আছে। শুধু তাই নয়, ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনায় উঠে এসেছে আরও এক চমকপ্রদ তথ্য। তা হল, মোরগ ও মুরগিদের কৃষ্টিগত জ্ঞান বর্তমান। যা তারা পরিবাহিত করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
কিন্তু আপামর জনগণ এ সব নিয়ে চিন্তিত নয়। তাদের কাছে এদের একমাত্র পরিচয় হল এরা খাদ্য। সুস্বাদু মাংস। আমেরিকায় প্রতি বছর নয় বিলিয়ন মুরগি মারা হয় শুধুমাত্র তাদের মাংস খাওয়ার জন্য। আর ৩০৫ মিলিয়ন মুরগি ব্যাবহৃত হয় তাদের ডিমের যোগানের জন্য। বস্তুত সারা পৃথিবীতে ৫০ বিলিয়ন মুরগি মারা হয় প্রতি বছর তাদের মাংশ খাওয়ার জন্য।
২০০৮ সালে ভারতে যেখানে এই 'হত্যার' সংখ্যাটা ছিল ১.৩ বিলিয়ন, ২০১২ সালে তা বেড়ে হয় ১.৪ বিলিয়ন। সংখ্যাটা ক্রমশই বাড়ছে। হিসেবে চিনকে পৃথিবীর ২০ শতাংশ মুরগির যোগান দিতে হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চিনের মুরগি খাওয়ার প্রবণতা যেমন বাড়ছে, তেমনি ভারতেও যোগানের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান। ভারতে প্রতি বছর, বর্তমানে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মুরগি, ‘হত্যা’ করা হয় মাংসের জন্যে। পোল্ট্রি ফার্মে এই ব্রয়লারের মুরগির জন্মই হয় মৃত্যুর জন্য। মাংসের যোগানের জন্য।
একেবারে দেখে নেওয়া যাক কেমন হয় এই সব মুরগিদের বেড়ে ওঠা। কেমন ভাবে জীবন কাটায় এরা।
ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে ভারতের আনাচে কানাচে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে মুরগি ও তার ডিমের ব্যবসা। ভারতীয় ফার্মে শৈশব অবস্থায় কোনও মুরগিকেই তাদের বা-মায়ের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয় না। জন্ম থেকেই তারা থাকে আলাদা। এক অন্য প্রকোষ্ঠে আধো-অন্ধকারে। ফলে অপত্য স্নেহ পাওয়া তো দূর জন্ম থেকেই ছোট মুরগিগুলো ভুগতে থাকে একাতিত্ব এবং ধুলজনিত শ্বাস কষ্টে। সূর্যের আলো আর মুক্ত বাতাসে অভাবে তাদের মধ্যে গাছে ওঠা বা বাসা তৈরি করার স্বাভাবিক প্রবণতা গুলো তৈরিই হয় না। বরং শ্বাস জনিত বিভিন্ন অসুখে তারা ভুগতে থাকে। লক্ষ করা যায় বহু অসামঞ্জস্য। তাদের বেড়ে ওঠা যেহেতু স্বাভাবিক নয় তাই তাদের দেহের গঠনেও বিভিন্ন অসামঞ্জস্য দেখা যায়।
ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে ভারতের আনাচে কানাচে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে মুরগি ও তার ডিমের ব্যবসা
ব্রয়লারের মুরগির মূল কনসেপ্টটাই হল কম সময় বেশি মাংস উৎপন্ন করা। তাই তাদের প্রতিদিনকার খাবারে মেশানো হয় এক প্রকার স্টেরয়েড যাতে মুরগিগুলো সময়ের আগে বেড়ে ওঠে। এই সময়ের আগে দেহের বৃদ্ধি একটা ভয়ঙ্কর ধারণা ও পদক্ষেপ। এতে যেমন প্রকৃতির নিয়মকে উলঙ্ঘন করা হয়, তেমনি পাশাপাশি এরফলে সুকুমার বৃত্তিগুলো ও বিনষ্ট হয়।
শোনা যায়, মহাকাব্যে রাবণ নাকি জন্মেই বড় হয়ে গিয়েছিলেন। রাবণের মা তার শৈশব দেখেননি। শৈশবহীন একটা জন্মে যেমন বহু কিছু না পাওয়া আছে তেমনি না পাওয়ার বিপদও আছে।
এক্ষেত্রেও তাই। ব্রয়লারের শিশু মুরগিগুলোকে মাংসের লোভে যে ভাবে স্টেরয়েড দিয়ে রাতারাতি বড় করা হয়, তার ফলে দেখা যায় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা। মুরগিগুলোর পা ও শরীরের অন্য অঙ্গে স্বাভাবিক গতি এতে নষ্ট হয়। পায়ে জোর না পাওয়া, শরীরে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতাহীন মুরগিগুলো আক্রান্ত হয় হার্ট অ্যাটাকে। অর্গান ফেলিওর ও অঙ্গ বিচ্যুতির দরুন এদের ফার্মের জীবন আরও দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। এক অসহায় প্রজাতি হয়ে এরা ধুকতে থাকে জীবন যন্ত্রনায়। খোঁড়াতে থাকে কষ্টে।
আলো নেই। বাতাস নেই। অর্পযাপ্ত থাকার জায়গা। অধিকাংশ মুরগিই ছোট্ট খুপড়ি প্রকোষ্টে দাঁড়িয়ে থাকে এক পায়ে। সারাদিন সারারাত। কেউ বা কারো পিঠে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গায়ের উপর উঠে যায় অন্য মুরগি। ফলে ঠেসাঠেসি যেবং উপর্যুপরি লড়াই শুরু হয়। আসে ক্লান্তি।
তারা ভাবে মুক্তি আসবে কবে? মুক্তি আসে। তাদের বয়স যখন মাত্র ছয় বা সাত সপ্তাহ হয়, তাদের পা বেঁধে খাঁচার মধ্যে ঠেসে ঢুকিয়ে ট্রাকে করে পাঠানো হয় বিভিন্ন বাজারে।
এই বাজারে আসার পর্বটিতেও থাকে নিদারুন কষ্ট। হয়ত ট্র্যাক দাঁড়িয়ে আছে একটা গোটা দিন। মুরগিগুলো বন্ধ ট্রাকের তদপরি বন্ধ খাঁচার মধ্যে অন্ধকারে প্রায় শ্বাস প্রস্বাসহীন অবস্থায় অপেক্ষা করে। হয়ত খাবারই জুটল না সেদিন। তার উপরে ছোট্ট খাঁচায় একজনের উপর আর একজন গায়ে মাথায় চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে অথবা বসে আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ডানা ঝাপটানোর সুযোগ নেই। একটু শরীরটা সরাবে তারও সুযোগ নেই। তার উপরে ছড়িয়ে আছে বিষ্টা।
এই বিষ্ঠার সমস্যা মুরগিদের গোটা জীবনকাল আচ্ছন্ন রাখে। জন্ম থেকেই তাদের এমন অপরিছন্ন প্রকোষ্ঠে রাখা হয় যে তারা জানতেই পারে না পরিচ্ছন্ন পৃথিবী কাকে বলে। ভারতীয় ব্রয়লার মুরগির ব্যবসায়ীরা মনেই করেন না যে এই সব জীবদেরও পরিছন্ন পরিবেশের প্রয়োজন আছে। তাদের সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য। ফলে মুরগিদের বিষ্ঠা ও খাবার জায়গা একই। ফলত তারা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগতে থাকে। মানসিক সমস্যা নাই বা বললাম। কারণ, মানুষ, আজ অবধি নিজের ছাড়া, আর কারোর মানসিক বিস্তার বা সমস্যা নিয়ে কোনও কালে মাথা ঘমায়নি। তা ভেবেছে, যা করেছে নিজের জন্য।
য়স যখন মাত্র ছয় বা সাত সপ্তাহ হয়, তাদের পা বেঁধে খাঁচার মধ্যে ঠেসে ঢুকিয়ে ট্রাকে করে পাঠানো হয় বিভিন্ন বাজারে
কিন্তু গবেষক ও মনস্তত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন মোরগ বা মুরগিদেরও একটি মন আছে। ম্যামেলস বা স্তন্যপায়ি প্রাণীদের মতো তাদেরও ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তা বর্তমান। গবেষণায় উঠে এসেছে তারাও সামাজিক প্রাণী - এক সঙ্গে গল্প করতে, সময় কাটাতে সমবেতভাবে খাবার সংগ্রহ করতে, গাছে উঠতে, ধুলস্নান বা সূর্যের আলোয় শুয়ে খুনসুটি করতে তাদের জুড়ি মেলা ভার।
গবেষকরা বলছেন এই প্রজাতিটিও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসে, তাদের প্রতি দায়বদ্ধ। গবেষকরা দেখিয়েছেন, এদের মানুষের মতো “complex social structure” লক্ষ করা যায়। এমনকি, অন্য প্রজাতির সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতাও এদের আছে। মানুষের মতো এরাও জটিল মানসিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। পারে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে।এদেরও ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা আছে। এমনকি আছে কৃষ্টি জ্ঞান, যা তারা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে কুকুর, বিড়াল বা মানুষের মতো এদেরও ব্যক্তিত্বের বিভিন্নতা বা স্তর বর্তমান।
এদের মধ্যে কেউ চটপটে, সাহসী আবার কেউ কেউ শান্ত, লাজুক, চিন্তাশীল।
রবিবার সকালে, জামার হাতা গুটিয়ে, যখন আপনি বলেন, এটা দাও, নানা ওই বড়টা, কিংবা ওদের শেষ চিৎকার উপেক্ষা করে যখন বলেন লেগপিস্-টা বড় রাখবে, তখন কি ভাবেন এসব কথা?
দূর, এত ভাবলে খাব কখন? ঠিকই তো, এ পৃথিবী শুধু মানুষের।

