যে পাঁচটি কারণে শ্রীকান্ত মোহতাকে দোষী সাব্যস্ত করা সহজ হবে না
চুক্তিভঙ্গের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা করা যেতে পারে, যার সঙ্গে চিটফান্ড মামলার সম্পর্ক থাকবে না
- Total Shares
সেই ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদীপ্ত সেনের গ্রেপ্তারি দিয়ে শুরু। এ যাবৎ, চিটফান্ড মামলায় সিবিআই-এর গ্রেপ্তার হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের প্রচুর রাঘববোয়াল। রাজ্যের মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংসদ, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান সাংবাদিক, চিত্রতারকা থেকে শুরু করে ক্রীড়া সংগঠক - কোনও পেশারই পরিচিত মুখ বাদ যাননি।
তালিকায় নবতম সংযোজন শ্রীকান্ত মোহতা। রোজভ্যালি মামলায় সম্প্রতি সিবিআই এই প্রযোজককে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের অধিকর্তা।
শ্রীকান্তের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, ৭০টি সিনেমা বানিয়ে দেবেন বলে তিনি রোজভ্যালির কাছ থেকে ২৪ কোটি টাকা নিয়েছিলেন। সিনেমা বানাননি। টাকাও ফেরত দেননি। সিবিআই দাবি করেছে, রোজ ভ্যালির আমানতকারীদের এই টাকা দিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি কিনেছিলেন। এমনকি, বিভিন্ন অর্থ লগ্নি সংস্থাকেও নাকি তিনি মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি কিনতে বাধ্য করেন।
বছর কয়েক আগে সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট শ্রীকান্তকে ডেকে জেরা করেছিল। সিবিআই জানিয়েছে, গত দু’মাস ধরে নোটিস দিয়ে বারবার ডাকা হচ্ছিল তাঁকে। কিন্তু তিনি আসেননি। তাই গত সপ্তাহে দক্ষিণ কলকাতার কসবার কাছে তাঁর অফিস থেকে শ্রীকান্তকে গ্রেপ্তার করেন সিবিআইয়ের গোয়েদারা।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর শ্রীকান্তের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইন বিষেশজ্ঞরা মনে করছেন শ্রীকান্তের বিরুদ্ধে যা অভিযোগ তা প্রমান করা সিবিআইয়ের কাছে খুব সহজ হবে না। অর্থাৎ, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করতে যথেষ্ট নয়।
কিন্তু কেন?
নিছকই চুক্তি
রোজভ্যালির সঙ্গে শ্রীকান্তের প্রতিষ্ঠান শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ৭০টি সিনেমা তৈরি করে দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল। যার জন্য রোজভ্যালির তরফ থেকে ২৪ কোটি টাকা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর সঙ্গে চিটফান্ডের সম্পর্ক কোথায়? শ্রীকান্ত নিজে চিটফান্ডের ব্যবসা করেননি। তিনি শুধু অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে পয়সা নিয়েছিলেন সিনেমা বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
টাকার সূত্র কী
সিবিআইয়ের দাবি, এই ২৪ কোটি টাকা রোজভ্যালির আমানতকারীদের। ধরে নেওয়া যাক, এই দাবি সত্য। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণে শ্রীকান্তকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন লোকের বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা নিয়ে থাকি। বেআইনি উপায়ে এই অর্থ না নেওয়ার মানে আমাদের এই অর্থপ্রাপ্তি ন্যায্য। শ্রীকান্তের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। চুক্তি পত্রে সই করে আইন মেনে এই টাকা হস্তান্তর হয়েছিল। আর, এ ক্ষেত্রে, শ্রীকান্ত নিজের সাফাইয়ে দাবি করবেন যে অর্থের সূত্র জানা তাঁর কাজ নয়। শুধুমাত্র পরিষেবার বদলে (এ ক্ষত্রে পরিষেবার প্রতিশ্রুতি বাবদ) তিনি এই টাকা নিয়েছিলেন।
চুক্তিভঙ্গ
গ্রেপ্তারের পর রোজভ্যালির কর্নধার গৌতম কুন্ডু সিবিআইয়ের কাছে দাবি করেছিলেন যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি শ্রীকান্ত। অর্থাৎ, ২৪কোটি টাকা নিয়ে তিনি সিনেমাগুলো তৈরি করেননি। তার মানে চুক্তিভঙ্গ করেছেন। গৌতমের দাবি, টাকাও ফেরত দেননি তিনি।
শ্রীকান্ত মোহতাকে দোষী সাব্যস্ত করা বেশ কঠিন হবে [সৌজন্যে: ফেসবুক]
প্রশ্ন উঠবে গ্রেপ্তরের পর জেরার সময়ে এই অভিযোগ কেন করলেন গৌতম? চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তিনি আগেও করতে পারতেন।
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক সরকারিভাবে অভিযোগ করার আগে শ্রীকান্তকে সময়ে দিচ্ছিলেন গৌতম। কিন্তু তার আগেই সিবিআই তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাই জেরার সময়ে তিনি এই অভিযোগের সুযোগ পেয়েছিলেন।
কিন্তু, মোদ্দা কথা, এই অভিযোগ সত্যি হলেও শ্রীকান্তের বিরুদ্ধে বড়জোর চুক্তিভঙ্গের বা জালিয়াতির মামলা চলতে পারে। অর্থাৎ, রোজভ্যালির সঙ্গে তিনি জালিয়াতি করেছেন। লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ আদায় করে নেওয়ার পরেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি তিনি। কিন্তু এর সঙ্গে চিটফান্ড মামলার সরাসরি যোগাযোগ থাকবে না।
প্রভাবিত করা
শ্রীকান্তের বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ আনা হয়েছে। যা চিটফান্ড মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া প্রতিটি রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধেই আনা হয়েছিল। অর্থ বা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে চিটফান্ড কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে টাকা আত্মসাদ করা।
কিন্তু এই অভিযোগ প্রমান করা খুব শক্ত। মানে, প্রভাব খাটানোর অভিযোগ বা হুমকি দেওয়ার অভিযোগ প্রমান করা শক্ত। তথ্যপ্রমান কী ভাবে যোগাড় হবে? কী ভাবে প্রমান হবে যে চিটফান্ড কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে নিজের ইচ্ছেতে কিংবা কোনও পরিষেবার বিনিময়ে অভিযুক্তদের অর্থদান করা হয়নি?
শ্রীকান্তের ক্ষেত্রে প্রমান করা তো আরও দুষ্কর? কারণ তিনি একেবারে লিখিত চুক্তি করে এই টাকা নিয়েছিলেন। চুক্তিপর্বের সময়ে রোজভ্যালির তরফ থেকেও প্রভাব খাটানো বা হুমকির কোনও অভিযোগ করা হয়নি।
শাসক দলের ভাণ্ডারে
সিবিআইয়ের দাবি, শ্রীকান্ত নাকি রোজভ্যালির কাছ থেকে টাকা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি কিনেছিলেন। এমনকি, বিভিন্ন অর্থ লগ্নি সংস্থাকেও নাকি তিনি মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি কিনতে বাধ্য করেন। সাদামাটা বাংলায়, শ্রীকান্ত চিটফান্ড কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে টাকা তুলে তা শাসকদলের হাতে তুলে দিয়েছেন।
ছবি কেনা অন্যায় নয়। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে আমানতকারীদের টাকা হাতিয়ে তা দিয়ে ছবি কেনা কি অন্যায়? প্রথমটাই (অর্থাৎ প্রভাব খাটানোর তত্ত্ব) যদি প্রমান না করা যায় তাহলে পরের অভিযোগই প্রমান করবেন কী ভাবে?
পাল্টা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে শ্রীকান্তকে। "আপনি চুক্তিবদ্ধ হয়ে টাকা নিয়ে চুক্তিরক্ষা করলেন না। অথচ, ছবি কিনে বেড়াচ্ছেন।"
কিন্তু শুধুমাত্র এই প্রশ্নের উপর ভর করে মামলা সাজানো সহজ নয়।
এর হাজার একটা যুক্তিপূর্ন জবাব এতদিনে তৈরি করে ফেলেছেন শ্রীকান্ত।

